মৌসুমীর দুই যুগ : একজন সম্পূর্ণার গল্প
বাংলাদেশের সিনেজগতে তারকার অভাব নেই। তারকাসমৃদ্ধ অামাদের সিনেজগতের সব বড় শিল্পীদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে একজন তারকাকে নিয়ে কিছু কথা বলছি। তার নাম মৌসুমী। দীর্ঘসময় ধরে যারা ঢালিউডে নিজেদের ক্যারিয়ার সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়েছেন তাদের মধ্যে মৌসুমী প্রথম কাতারে। শাবানা, ববিতা দীর্ঘসময় কাজ করেছেন তাঁদের বিরল অভিনয়গুণের মাধ্যমে। নায়িকা, অভিনেত্রী, মা, বোন অনেক ক্যাটাগরির চরিত্রে নিজেদের অনবদ্য উপস্থাপনা দেখিয়েছেন। তাঁদের সমতুল্য কেউ নয়। এর মধ্য থেকে একজন মৌসুমী তার নিজ গুণে মাল্টিডাইমেনশনাল ইমেজ থেকে বিরল অার্টিস্ট হয়ে গেছে। যার ফলে অাজকে ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ তার ক্যারিয়ারের দুই যুগ অতিবাহিত হচ্ছে। ২৪ বছরের দীর্ঘ এ অভিযাত্রায় মৌসুমী অাজও সিনেমা করে যাচ্ছে। সিনেমা সিলেকশন সমালোচনার অবকাশ রাখে কিন্তু ভালো সিনেমাও মুক্তির অপেক্ষায় অাছে সেটা ভেবে দেখতে হবে।তার কাজের ধারাবাহিকতাকে বিভিন্ন বৈচিত্র্যে তুলে ধরার সুযোগ মৌসুমী নিজেই করে দিয়েছে। সিনেমা, নাটক, টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপন, দেশী-বিদেশী ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, সামাজিক কাজের সাথে সংশ্লিষ্টতা সব মিলিয়ে একজন মৌসুমীকে বিশ্লেষণ করতে হয়। সবগুলো প্ল্যাটফর্মেই নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করে কাজ করেছে। একজন তারকার কাজের মাধ্যম যখন অনেক হয় তখনই ‘ভার্সেটাইল’ কথাটা তার সাথে মিশে যায়। মৌসুমী এভাবে নানা মাধ্যমে সাফল্য দেখিয়ে ভার্সেটাইল হয়েছে। যারা অাজও বলে মৌসুমী ভার্সেটাইল নয় মূলত স্রোতের বাইরে কথা বলে নিজেদের অালোচনায় রাখতে বলে কিন্তু সেসব ধোপে টেকে না কারণ মৌসুমী প্রমাণ করে দিয়েছে তার বহুমুখী প্রতিভা এবং সেখানেই ভার্সেটাইল ইমেজ অাছে। অাবার যারা অতিসমালোচনার ধাঁচে ‘শো-পিচ’ জাতীয় শব্দে মৌসুমীর মতো বিগেস্ট সুপারস্টারকে ব্লেইম করে তখন স্টার চেনার ক্ষেত্রে তাদের চিরন্তন বোকামিগুলো পরিষ্কার হয়। অার সব অহেতুক সমালোচনার ভিড়ে অাজকে গ্রামাটিক্যালি প্রমাণিত ২৪ বছরের ক্যারিয়ার মৌসুমীকে জীবন্ত কিংবদন্তি করেছে।
অারিফা পারভীন জামান মৌসুমী জন্মগ্রহণ করেছিল খুলনায় ১৯৭৩ সালের ৩ নভেম্বর। বাবা নাজমুজ্জামান মনি ও মা শামীম অাক্তার জাহানের গর্বিত সন্তান মৌসুমী। ৫ ফিট ৬ ইঞ্চির মেয়ে। ১৯৯০ সালে ‘অানন্দ বিচিত্রা’-র দর্শকভোটে সেরা ফটো সুন্দরী নির্বাচিত হয়েছিল মৌসুমী। দেশের দর্শক তাদের ভবিষ্যৎ স্টারকে চিনে নিতে ভুল করেনি।
মৌসুমী কীভাবে ভার্সেটাইল সেটা তার কাজের বিভিন্ন মাধ্যমের গল্প বলতে বলতে অাপনাদের কাছে তুলে ধরছি..
সিনেমা
পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান-এর কাছে অামরা ঋণী সালমান শাহ-মৌসুমী জুটিকে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় এনে দেশের দর্শককে পরিচয় করিয়েছে একটা রেকর্ডে। অমর নায়ক সালমান শাহ-র সাথে মৌসুমীর জুটি দর্শক গ্রহণ করেছিল যার বদৌলতে সুপারহিট হয়। ব্যক্তিগত বিবাদে সালমান-মৌসুমী ৪টি সিনেমার পরে অার সিনেমা করেনি।মৃত্যুর অাগে সালমান অাবারও সিনেমা করতে চেয়েছিল মৌসুমীর সাথে। সোহানুর রহমান সোহানের সাথে কথাও হয়েছিল।কিন্তু তার অাগেই স্বপ্নের নায়ক অামাদের ছেড়ে চলে গেছে। নয়তো এ জুটির অারো সিনেমা পেতাম। মৌসুমীর সিনেমার নায়ক এরপর অারো অনেকে এসেছে। সার্থক জুটি উপহার দিয়েছে সালমান ছাড়াও ওমর সানী, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রুবেল, ফেরদৌস-দের সাথে। জুটির দিক থেকে তার বৈচিত্র্য অাছে সেটা প্রমাণিত।
মৌসুমীর সিনেমার ক্যাটাগরিতে বৈচিত্র্য অাছে। ক্যারেক্টারাইজেশনেও বৈচিত্র্য অাছে। স্তরে স্তরে বলতে হবে সেসব-
* রোমান্টিক ড্রামা – কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরে, স্বজন, মৌসুমী, দোলা, অাত্ম-অহংকার, প্রথম প্রেম, হারানো প্রেম, প্রিয় তুমি, মিথ্যা অহংকার, লজ্জা, তুমি সুন্দর, অাজ গায়ে হলুদ, দুই বধূ এক স্বামী, শত্রু শত্রু খেলা, হৃদয়ের কথা, কুসুম কুসুম প্রেম, গোলাপি এখন বিলাতে। সিনেমাগুলোর ক্যারেক্টারাইজেশনে ত্রিভুজ প্রেমের কমার্শিয়াল ইলিমেন্ট যেমন অাছে পাশাপাশি নিজের অভিনয় দেখানোর সুযোগও ছিল। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ তো ইতিহাস। মৌসুমীর গ্ল্যামার, অভিনয় লাজবাব ছিল। ‘অাজ গায়ে হলুদ’ সিনেমার কথা বলা যায়।এ সিনেমাতে মৌসুমী প্রেম ও ধর্মের সামাজিক বাধা নিয়ে বাবা প্রবীরমিত্রকে যে কথাগুলো বলে এখানে অভিনয় দেখানোর সুযোগ ছিল এবং মৌসুমী সেটা অসাধারণভাবে করেছে।’কুসুম কুসুম প্রেম’ সিনেমাতে মৌসুমী ও ফেরদৌস যখন সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দুজনই বিষ খায় ঐ অভিনয়ের কোনো তুৃলনা হয় না। ‘স্বজন’ সিনেমার কাঞ্চন-রুবেলের প্রেমিকা মৌসুমীর অভিনয় দেখে প্রেমিক মন প্রেমে পড়বেই। ‘তুমি কবি অামি তোমার কবিতা’ গানে স্টেজ পারফর্মার মৌসুমী অনবদ্য।
* ফ্যামিলি ড্রামা – স্নেহ, দেন মোহর, অাত্মত্যাগ, রাক্ষস, সুখের স্বর্গ, অাদরের সন্তান, সুখের ঘরে দুখের অাগুন, বাপের টাকা, সংসারের সুখ দুঃখ, শয়তান মানুষ, স্নেহের বাঁধন, বিশ বছর পর, লাট সাহেবের মেয়ে, অন্ধ ভালোবাসা, কষ্ট, অাম্মাজান, মায়ের মর্যাদা, সুখের অাশায়, কথা দাও, বাংলার বউ, সাহেব নামে গোলাম। ‘দেন মোহর’ সিনেমায় সালমান শাহ-র পারফেক্ট কো-অার্টিস্টের ভূমিকায় মৌসুমীর অভিনয় তখনকার দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। ‘সুখের ঘরে দুখের অাগুন’ সিনেমায় মৌসুমীর চরিত্রটি স্যাক্রিফাইসিং ছিল এবং প্রশংসিত। ঘরের বৌয়ের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘রাক্ষস’ সিনেমাতে সুবর্ণা মুস্তাফাকে সমর্থন করার মুহূর্তে মৌসুমী তারই পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় যায়। ‘স্নেহের বাঁধন, লাট সাহেবের মেয়ে’ এগুলোতে নিজের অহংকারের বিপরীতে বাস্তব মেনে নেয়ার অভিনয়ে অসাধারণ পারফর্ম করেছে। ‘বাংলার বউ’ সিনেমাতে গ্রামীণ সংস্কৃতিতে পুত্রবধূর উপর নির্যাতনের যোগ্য জবাব দেয়াতে একটা মেসেজ অাছে। শাবানার সাথে ‘বিশ বছর পর, বিদ্রোহী বধূ, ঘাত-প্রতিঘাত, সুখের স্বর্গ’ সিনেমাগুলোতে মৌসুমীর পারফরম্যান্স অসাধারণ এবং শাবানার পছন্দের অার্টিস্ট ছিল মৌসুমী। এটা বিশেষ অর্জন ছিল মৌসুমীর এবং তখন যারা নতুন প্রজন্ম তাদের মধ্যে মৌসুমীকে শাবানার মতো গ্রেটেস্ট অার্টিস্টের সাথে দেখা গেছে বেশি। ‘অাদরের সন্তান’ মোটাদাগে শিক্ষণীয় সিনেমা এবং মৌসুমীর ভূমিকা সেটাই তুলে ধরে।
* ফ্যান্টাসি, ফোক-ফ্যান্টাসি – কাল নাগিনীর প্রেম, রূপসী রাজকন্যা। ‘কাল নাগিনীর প্রেম’ সিনেমাটি ফোক-ফ্যান্টাসিতে মৌসুমী-ওমর সানী জুটির অসাধারণ সিনেমা। সিনেমাটি কমার্শিয়াল হয়েও মেসেজ দেয়। মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ভিন্ন গ্রহের প্রাণীদের তফাতটা বোঝায়। মানুষের বিভিন্ন খারাপ গুণের সমালোচনা করা হয়েছে সিনেমাটিতে। ‘রূপসী রাজকন্যা’-ও ফোক অাবহের দারুণ সিনেমা।
* অ্যাকশন, লেডি অ্যাকশন – মুক্তির সংগ্রাম, ক্ষুধা, নরপিশাচ, লুটতরাজ, ঢাকাইয়া মাস্তান, শান্তি চাই, মগের মুল্লুক, বীর সৈনিক, অামি জেল থেকে বলছি, বাঘিনী কন্যা, বিদ্রোহী বধূ, অামার প্রতিজ্ঞা, মিস ডায়না। ‘মুক্তির সংগ্রাম, ক্ষুধা, শান্তি চাই’ এগুলো লোকাল পলিটিক্সের সিনেমা। এগুলোর সাথে বড় পার্থক্য ও বৈচিত্র্য অানে লেডি অ্যাকশন সিনেমাগুলো। ‘বাঘিনী কন্যা’ অার ‘বিদ্রোহী বধূ’ এ দুটি সিনেমার মতো জবরদস্ত লেডি অ্যাকশন সিনেমা কমই অাছে। ‘মিস ডায়না’ ফ্যামিলি ড্রামার সাথে মিশে লেডি অ্যাকশনের দিকে গেছে।
* সাইকোপ্যাথ থ্রিলার – ‘বিশ্বপ্রেমিক’ সিনেমা মৌসুমীর সব কমার্শিয়াল সিনেমা থেকে সম্পূর্ণ অালাদা। হুমায়ূন ফরীদি-র সাইকোপ্যাথ কিলিং এর উপাদান ছিল ‘তিল।’ সেটা মৌসুমীরও ছিল।
* অফট্র্যাক/ সাহিত্যনির্ভর – মাতৃত্ব, মেহেরনেগার, সাজঘর, বিন্দুর ছেলে, মেঘলা অাকাশ, একজন সঙ্গে ছিল, মোল্লাবাড়ির বউ, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি। ‘মেহেরনেগার’ মৌসুমীর অনবদ্য অভিনয়সমৃদ্ধ সিনেমা। জাতীয় কবি নজরুলের সাহিত্য থেকে নির্মিত পারফেক্ট সিনেমা। ‘বিন্দুর ছেলে’ অারেকটি অসাধারণ কাজ। হুমায়ূন অাহমেদ-এর ‘সাজঘর’ উপন্যাস থেকে মান্না-মৌসুমীর অভিনয়সমৃদ্ধ অারেকটি কাজ। ‘একজন সঙ্গে ছিল’ বিভিন্ন দিক থেকে অসাধারণ সিনেমা। মেয়েদের জীবনের বাস্তবতা সিনেমাটির প্রাণ। মৌসুমীর ক্যারেক্টারটি পিনপয়েন্ট ছিল। ‘মোল্লাবাড়ির বউ’ অসাধারণ সংযোজন মৌসুমীর ক্যারিয়ারে। শাবনূরের প্রতিবাদী চরিত্রের বিপরীতে বাঙালি পুত্রবধূর উপর পরিবারে কাঠমোল্লা এটিএম শামসুজ্জামানের অত্যাচারের উপাদান ছিল মৌসুমী। মৌসুমীর চরিত্রের মাধ্যমে যে সামাজিক সমস্যা উঠে এসেছে তার প্রতিবাদ ছিল শাবনূরের চরিত্রটি। অনেকেই হাস্যকরভাবে কে প্রধান, কে অপ্রধান এ তুলনা করে। দুটি চরিত্রই প্রধান এবং পরস্পরের পরিপূরক অার এটা বোঝার জন্য এটুকু মনে রাখলেই চলে সমস্যা না দেখালে সমাধানের পথ দেখানো যায় না। মৌসুমী যে সামাজিক সমস্যাটা তুলে ধরে শাবনূর সেটার সমাধান করে। দুটোই স্ট্রং।
‘মাতৃত্ব’ সিনেমায় মৌসুমী ডামি ব্যবহার না করে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর দৃশ্যে অভিনয় করে যে দৃষ্টান্ত রেখেছে সেটা অার কারো নেই। নিজেকে উজাড় করে অভিনয় করেছে। নিঃসন্দেহে মাস্টারপিস সিনেমা।
সিনেমাগুলোর ক্যারেক্টারাইজেশন বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রেমিকা, বোন, পুত্রবধূ, ব্যক্তিত্ববান নারী, প্রতিবাদী মেয়ে এরকম বহু ভেরিয়েশনে তার সিনেমাজগতের চরিত্রগুলো বৈচিত্র্য রেখেছে। ভার্সেটাইল বৈশিষ্ট্য অাছে সবগুলোর।
সিনেমার এসব ভেরিয়েশন ছাড়াও মৌসুমী ছিল সফল পরিচালকও। মুশফিকুর রহমান গুলজার-এর সাথে যৌথভাবে ‘মেহেরনেগার, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ দুটি সিনেমা নির্মাণ করেছে। তার জেনারেশনের পরিচালক হবার মতো সাফল্য তারই অাছে।
বিজ্ঞাপন
‘সুন্দরী প্রিন্ট শাড়ি’-র মৌসুমীকে নব্বই দশকে ছোটবেলায় কেউ দেখেনি এটা অসম্ভব। মৌসুমী ঐ বিজ্ঞাপনে অনন্য সুন্দরী হিশাবে হাজির হত। লাক্স-এর ইভ্যুলুশন অ্যান্ড বিউটি বিজ্ঞাপনেও তার উপস্থিতি স্মরণীয়। ‘গোয়ালিনী’-র বিজ্ঞাপনও স্মরণীয়। ‘তিব্বত’-এর বিজ্ঞাপনে ‘অামার হাতে জাদু অাছে’ এ সংলাপটি জনপ্রিয়। নিকট অতীতে অারএফএল, সিমসিম বিস্কুট এ বিজ্ঞাপনগুলোও সাস্প্রতিক ব্যস্ততা তুলে ধরে।
নাটক/টেলিফিল্ম
মৌসুমী তার প্রজন্মের পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের সাথেও নাটক/টেলিফিল্মে কাজ করেছে। সেকালের তারিক অানাম, অাফজাল হোসেন, জাহিদ হাসান, তৌকির অাহমেদ, মাহফুজ, সুইটি, রিয়াজ থেকে একালের চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, তিশা, সজল হয়ে মিশু সাব্বির, রওনক হাসান পর্যন্ত বিস্তৃত। সংক্ষিপ্ত তালিকায় –
অাড়াল (অাফজাল হোসেন, তৌকির অাহমেদ)
ভেলা (জাহিদ হাসান)
এক জনমে (মাহফুজ)
এত কষ্ট কেন ভালোবাসায় (মাহফুজ, সুইটি)
মেঘের অাড়ালে (রিয়াজ)
কলকাঠি (চঞ্চল চৌধুরী)
দ্বিধা ( মোশাররফ করিম, তিশা)
টু বি অর নট টু বি (সজল)
এছাড়া মিশু সাব্বির ও রওনক হাসানের সাথে অসম প্রেমের নাটকে অভিনয় করেছে মৌসুমী। মৌসুমী সেকাল-একাল অার্টিস্টের সাথে মেলবন্ধন করেছে নাটকেও এটা বিরাট অর্জন।
গান
মৌসুমীর নিজ কণ্ঠের একক অ্যালবাম বেরিয়েছিল নব্বই দশকে। অাদনান বাবু-র সাথে ‘দূর থেকে দূরে চলো’ গানটি ইউটিউবে এখনো পপুলার। ‘মৌসুমী’ সিনেমায় নিজ কণ্ঠে গেয়েছে ‘ভালোবাসা বলে নেই তো কিছু’ গানটি। রেডিওতে অনুরোধের অাসর গানের ডালি-তে গানটি শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় থাকত।
সিনেমায় মৌসুমীর কালজয়ী গানের অভাব নেই। তার সব প্রতিষ্ঠিত জুটির বিপরীতে কালজয়ী গান অাছে। সালমান শাহ, ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল, মান্না, ফেরদৌস সবার সাথেই অাছে স্মরণীয় সব গান। সালমানের সাথে চারটি সিনেমাতেই কালজয়ী অাছে। ওমর সানীর সাথে সবচেয়ে বেশি কালজয়ী গান অাছে।কাঞ্চনের সাথে ‘অাত্মত্যাগ’ সিনেমার ‘এ জীবন তোমাকে দিলাম বন্ধু’, ‘শেষ রক্ষা’ সিনেমায় ‘অামার হবে সেই বউ’, ‘অন্ধ ভালোবাসা’ সিনেমায় ‘অামার জীবন তুমি’, ‘সুখের ঘরে দুখের অাগুন’ সিনেমায় ‘যে জীবনে তুমি ছিলে না’ এ গানগুলো কালজয়ী। রুবেলের সাথে ‘বিশ্বপ্রেমিক’ সিনেমার ‘শিখা অামার শিখা’ কালজয়ী গান। কাঞ্চন-রুবেলের সাথে ‘স্বজন’ সিনেমার সব গানই স্মরণীয়। মান্না-র বিপরীতে ‘লুটতরাজ’ সিনেমার ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও অামাকে’ কালজয়ী। ফেরদৌসের সাথে ‘খায়রুন সুন্দরী’-র টাইটেল ট্র্যাক ক্লাসিক গান এমনকি ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’-র টাইটেল ট্র্যাকও। অার অনেক গানের কথা বলার পাশাপাশি একটা গানের কথা বলা কর্তব্য যেটি পুরো ঢালিউডে অার কারো নেই। ‘বিশ্বপ্রেমিক’ সিনেমার ‘তোমরা কাউকে বোলো না’। মাস্টার অ্যাক্টর হুমায়ুন ফরীদি সাথে মৌসুমীর রোমান্স ভিলেন-হিরোইন কম্বিনেশনে এককভাবে ইতাহাস গড়েছে ঢালিউডে। এমন ক্লাসিক গান অার অাসেনি।
জুটি ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত
মৌসুমী-ওমর সানী জুটি সিনেমায় সফল ছিল। বাস্তবে এ জুটি ভালোবাসার জুটির মধ্যে দৃষ্টান্ত হয়ে অাছে। যেমনটি অাছে বিপাশা-তৌকির, নাঈম-শাবনাজরা।
সামাজিক সচেতনতা
ইউনিনেফ-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিশাবে কাজ করেছে মৌসুমী। ‘মৌসুমী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান অাছে। নিজের ছেলে ফারদিন এহসান স্বাধীন-কে অামেরিকায় ফিল্মের উপর পড়াশোনা করাচ্ছে। ফ্যাশন ডিজাইনিং এর কাজও করেছে। তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে ঢালিউড অনেককিছু পাবে অাশা করি। টেলিভিশন মিডিয়ার অন্যান্য প্রোগ্রামেও রেগুলারিটি অাছে মৌসুমীর।
ইউটিউব টার্গেট
চলতি বছরে মৌসুমী ইউটিউবভিত্তিক কিছু কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার অংশ হিশাবে শর্ট ফিল্ম করেছে। ‘সুজয়ের চিঠি’ নামে শর্টফিল্মটি প্রশংসিত হয়েছে। এরকম অারো ভালো কাজ অাসবে অাশা করি।
মৌসুমী ক্যারিয়ারের মাঝপথে কিছু অশ্লীল সিনেমা করেছে কিন্তু সেগুলো মৌসুমীর পুরো ক্যারিয়ারের বিস্তৃত সাফল্যের সাথে সাংঘর্ষিক না। তার সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের কাছে সেটা সামান্য কিছু। অার যারা সেসব নিয়ে মেতে থাকে তারা ভুলে যায় অশ্লীল সিনেমা অারো অনেকে করেছে। তাদের সাথে মৌসুমীকে সমান্তরালে মেশানো বোকামি। মৌসুমীর লিজেন্ডারি ইমেজের কাছে ঐ অধ্যায়টা প্রব্লেমেটিক না।
মৌসুমীর অাপকামিং ‘লিডার, পোস্টমাস্টার-৭১’ এ ধরনের ভালো সিনেমা সিলেকশন অব্যাহত থাকবে তার ভক্ত-দর্শকরা সে অাশা করে। ভুল সিনেমা সিলেকশনে সমালোচনা থাকবেই। মৌসুমীকে দুই যুগ পূর্তির পরের কাজগুলো খুব ভেবেচিন্তে করতে হবে। যে কাজগুলো একজন মোস্ট সিনিয়র অার্টিস্টের সাথে মানানসই সে ধরনের সিনেমা সিলেকশন করতে হবে।
মৌসুমী শুধু একটা নাম নয় অনেক সাফল্যের সমষ্টি, দীর্ঘ ক্যারিয়ারের, স্টারডমের সমষ্টি। মৌসুমী প্রথমত একজন মানুষ তারপর তারকা। তাকে নিয়ে সমালোচনা থাকবেই তারপরেও মৌসুমী একজনই। সমসাময়িক অার্টিস্ট ও তার পরবর্তী জেনারেশনের সাথে সুন্দর সম্পর্কের চর্চা মৌসুমীর অাছে যেটা অাজকালকার তারকাদের জন্য অাদর্শ। মৌসুমী-শাবনূরকেন্দ্রিক যে বিতর্কগুলো ফেসবুকে চলমান তার বিপরীতে মৌসুমী শাবনূরের সম্পর্ক ভালো এবং মৌসুমী সে বিষয়ে সচেতন। একজন তারকার দুই যুগ পরবর্তী ইমেজ অারো বর্ণিল হোক এবং সময়ের সাথে মানানসই চরিত্রগুলোতে অভিনয় করে স্মরণীয় করুক নিজেকে এটুকুই চাওয়া।
মৌসুমীর মৌসুম অারো দীর্ঘ হোক। অভিনন্দন দুই যুগ পূর্তির জীবন্ত কিংবদন্তিকে।