Select Page

মৌসুমী, কারে ভালোবাসো তুমি

মৌসুমী, কারে ভালোবাসো তুমি

মৌসুমী ভালোবাসে সালমান শাহ-কে। যে তাকে জন্মদিনের আয়োজনে গানে গানে মনের কথা বলেছিল -“ও আমার বন্ধু গো চিরসাথী পথচলার/
তোমার জন্য গড়েছি আমি মঞ্জিল ভালোবাসার।” তারপর সালমানের সাথে প্রেম দানা বাঁধলে সমাজ ও পারিবারিক চিরন্তন বাধার মুখে ঘর ছেড়েছিল। পাহাড়ে সংসার পেতেছিল কিন্তু সংসার অপূর্ণ থেকেছে। ঘাতকের বুলেট তার স্বপ্নকে শেষ করে দিয়েছে কিন্তু তারপরেও সে সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে ভালোবাসায় কারণ মৃত্যু যে তার প্রিয় ভালোবাসার মানুষটির কোলেই হচ্ছে তাই তার শেষ কথা-‘তোমার কাছ থেকে আমাকে আর কেউ আলাদা করতে পারবে না।’ সাধারণ কথা কিন্তু প্রেমের সার্থকতায় অসাধারণ। ছবির নাম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।

মৌসুমী ভালোবাসে ওমর সানীকে। মনের মানুষকে স্বপ্ন দেখে গেয়েছিল সবার সামনে-‘তুমি সুন্দরও আমার অন্তরও তুমি যে আমার সাধনা /তুমি আমার ভালোবাসার আরাধনা।’ গানে গানে ক্লাসিক নৃত্যে বাড়ির সবাইকে জানিয়েছিল অচেনা কাউকে ভালোবাসার কথা কেননা তখনও সানীর সাথে তার দেখা হয়নি। সেই চিরন্তন সমাজ ও পরিবারের বাধা এখানেও। শেষমেশ জীবন দিতে হয়েছে সানীর সাথেই। না পাওয়ার বেদনাকে একাকী বিধাতার কাছে গানে গানে বলেছিল মৌসুমী-“হৃদয় ভরে যদি প্রেম দিলে/কী সুখ পাও ও বুকে আগুন জ্বেলে /কেন জন্ম দিলে বিধাতা/কেঁদেই কাটে যদি জীবন/কেন ভাগ্য হলো এমন।” ছবির নাম ‘দোলা’।

মৌসুমী ভালোবাসে ওমর সানীকে। এক বসন্তের দিনে সানী তাকে হাত ধরে নৌকায় উঠিয়েছিল আর গেয়েছিল-“এলো বসন্ত আমার গানে/কোকিল বলে এসো বন্ধু হয়ে যাই রে।” বন্ধু তারা হয়েছিল তারপর প্রেম ও বিয়ে। বিয়ের পর দুর্ঘটনায় আবার আলাদা হয়ে যায় এবং নিজের স্বামী ও সন্তানকে আর চিনতে পারে না, সানী তাকে অতীত মনে করাতে থাকে গানে গানে-“হারানো প্রেমের স্মৃতি মনে করে দেখো/সুখেরও দিনগুলো কেন ভুলে আছো।” মৌসুমী পিয়ানো বাজায় আর সানীর কষ্টকে নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করে। ছবির নাম ‘হারানো প্রেম’।

মৌসুমী ভালোবাসে ওমর সানীকে। গরিবের উপর অত্যাচারের পর সেই গরিবের হাতেই পড়ে তারই প্রেমে পড়ে। বাবার জমিদারি সাম্রাজ্য ছেড়ে গরিবের বস্তিতে এসে তাদের একজন হয়ে যায় আর তার নাম হয়ে যায় ‘গরিবের রাণী’। মৌসুমী তখন গরিবের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। সানীর মাউথ অর্গানের সুরে রাতে বের হয়ে যায় প্রেমময় টানে তারপর গাইতে থাকে গান-“তুমি ডাকলেও আসি না ডাকলেও আসি /কী জাদু জানে পোড়া বাঁশেরও বাঁশি।”

মৌসুমী ভালোবাসে ওমর সানীকে। প্রিয় মানুষটি তখন ‘প্রিয় তুমি’। প্রিয়কে তাই গানে গানে জানায়-‘তুমি এমন কোনো কথা বোলো না /চোখে টলমল জলটুকু ফেলো না/আমি মরণেও কোনো ভয় পাই না/শুধু তোমাকে হারাতে চাই না।” জীবনে ‘প্রথম প্রেম’ আসলে মন যেমন উচাটন হয়ে ওঠে নানারকম অনুভূতি মনে খেলা করে তাকে মৌসুমী গানে গানে ব্যক্ত করে-“প্রেমনগরের জংশনে দেখা হলো দুজনে /দুটি মনে সবুজ বাতি জ্বলল/ঝিকিঝিকি ঝিকিঝিকি প্রেমের গাড়ি চলল।” ‘লজ্জা’ ছবির লজ্জা হয়ে মৌসুমী সেই অচেনা মানুষকে হৃদয়ে পুষে রেখেই ভালোবাসা জানায় গানে গানে-“জানি না তো কোন মধুমাসে/ভালোবেসে পাবো তারে কাছে/আমার চোখে সে যে ছবি হয়ে ভাসে/হারিয়ে গিয়ে আবার যেন নতুন হয়ে আসে।”

মৌসুমী ভালোবাসে ইলিয়াস কাঞ্চনকে। ভুল করে কাঞ্চনকে হাইজ্যাকার বানিয়ে দিয়েছিল তারপর কাঞ্চনের পরিবার সেই অপমানে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কাঞ্চন বাবা হারায়, মায়ের কাছে হয় পর। মৌসুমীর সাথে বাঁধে বিরোধ, মৌসুমী জিদ মেটাতে গুন্ডা দিয়ে মারারও চেষ্টা করে। চেকের পাতা দিয়ে কিনতে চায় কাঞ্চনকে কিন্তু চেকের পাতায় লেখা বাবাকে ফেরত চায় কাঞ্চন এবং মৌসুমী দুর্বল হতে থাকে। একদিন সেজেগুজে সেই কাঞ্চনের কাছেই যায় তার আগে বাবাকে জানায় নিজের পছন্দের কথা। বাবা জানতে চায় ‘কে’ মৌসুমীর উত্তর ‘বেবী ট্যাক্সিওয়ালা’। উত্তরে মুচকি হাসির সেই সংলাপের মাঝে সমাজের ধনী-গরিব ব্যবধান এক ঝটকায় শেষ হয়ে যায় ভালোবাসার কাছে। কাঞ্চনের কাছে গিয়ে বৃষ্টিভেজা গানে গানে নিজের আর্তনাদ জানায়-“সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার/মন কেন যেতে চায় না।” কাঞ্চনকে জানায় মৌসুমী নিজে যাবে তার মায়ের কাছে, কাঞ্চনের প্রশ্ন ‘আপনি পারবেন?’ মৌসুমীর উত্তর ‘পারব।’ তাকে যে পারতেই হবে। অতঃপর কাঞ্চনের মায়ের ভুল ভাঙায় সত্য কথা বলে। কাঞ্চনের ছোটবোনের বিয়ে আটকে ছিল যৌতুকের জন্য মৌসুমী মুহূর্তের মধ্যে তা সমাধান করে দেয় সেটাও কাঞ্চনকে ভালোবেসে। ছবির নাম ‘আদরের সন্তান’। কাঞ্চনকে ভালোবেসে নিজের ভেতরের রোগকে পুষে রেখে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেয় মৌসুমী। কাঞ্চন টেলিফোনে বলেছিল মৌসুমীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো, যেই চাওয়া সেই কাজ। বৃষ্টির মাঝেও গাড়ি নিয়ে কাঞ্চনের বাড়ির সামনে হাজির মৌসুমী, গাড়ির হুইসেল শুনে কাঞ্চন উপর তলা থেকে লাফিয়েই মৌসুমীকে জড়িয়ে ধরে তারপর সে গান-“যে জীবনে তুমি ছিলে না/সে জীবন জীবন তো নয়।” এত রোমান্টিকভাবে যে সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল তার শেষটা হয় করুণ। বোনের জন্য নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে পুড়ে যেতে থাকে সেটাও বলে গানে গানে-“কাউকে পোড়াতে নিজে পুড়ে মরেছি/এই জ্বালা তো সয় না।” সবাইকে সুখী করে নিজেকে শেষ করে দিয়েই মৌসুমী ক্ষান্ত হয়। ছবির নাম ‘সুখের ঘরে দুখের আগুন’।

মৌসুমী ভালোবাসে আমিন খানকে। আমিন খান ডাক্তার অনেক ব্যস্ত। তাকে মনে করে মিষ্টি অভিমানে গায়-“আকাশে চাঁদ উঠেছে বাগানে ফুল ফুটেছে/ফাগুন হাওয়া বয়ে যায় উদাসী মন হয়ে যায়/ও বন্ধু বলো না তুমি কই।’ আমিনকে ভালোবেসেও বিয়ের সময় সমাজ ও ধর্মের বাধা সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবা কোনোভাবেই নিজের গন্ডি পেরোতে চায় না। শেষ পর্যন্ত মৌসুমীর ভালোবাসার জোর তাকে সফল করে তোলে। ছবির নাম ‘আজ গায়ে হলুদ’।

মৌসুমী ভালোবাসে ফেরদৌসকে। পতিব্রতা নারী, স্বামী ছাড়া কিছুই যেন বোঝে না। সেই স্বামীর হাতেই খুন হতে হয় তাকে শুধুমাত্র অবিশ্বাসের জন্য, অন্যের কানকথার জন্য। তার কথা শোনার সামান্য প্রয়োজনও বোধ করে না ফেরদৌস। দা দিয়ে কুপিয়ে নৌকা থেকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। স্বামীর হাতে মরণেও যেন তার সুখ এত গভীর ভালোবাসা। ফেরদৌস সত্যটা জানার পর বিলাপ করতে থাকে কিন্তু না ততক্ষণে সব শেষ। ছবির নাম ‘খায়রুন সুন্দরী’। পরিবারের সব দায়িত্ব নিয়ে নিজেকে পাথরের মতো শক্ত করে এগিয়ে যায় মৌসুমী তারপরেও মনের মধ্যে ভালোবাসার মানুষটির জন্য রয়ে যায় গভীর টান। মেঘবৃষ্টির মতো জীবনে মৌসুমী বাস্তবতার নায়িকা হয়ে ওঠে যার পরিচয় আসে এভাবে-“কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি/মনে হয় তোমারই কাছে হারিয়ে গেছে এই দৃষ্টি।’ ছবির নাম ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’।

মৌসুমী ভালোবাসে মান্নাকে। বিয়ের পর মান্না সন্তান নিতে চায়নি কারণ বাবা ছিল পঙ্গু, অথর্ব, কথা বলতে পারত না। সন্তান হলে যদি তাদের সন্তানও তেমন হত সেই ভয়ে। মৌসুমী সত্যটা জানার পর স্বামীর প্রতি তার সম্মান আর ভালোবাসা আরো বাড়ে। গুলি খেয়ে মান্না মারা যাবার আগে মৌসুমীর কাছে ক্ষমা চায় ততক্ষণে পুলিশ আসে। মৌসুমী বলে-‘কাকে ধরতে এসেছেন? ও নেই।’ তারপর রিভলবার চালিয়ে দেয় নিজের মাথায়, নিজেও ঢলে পড়ে স্বামীর বুকে। ভালোবাসলে এভাবে ভালোবাসার মানুষের বুকেই মরা যায়। ছবির নাম ‘কষ্ট’। নিজের সব হারিয়ে সম্মান আর ভালোবাসার খোঁজ মৌসুমী পেয়েছিল মান্নার কাছে। অত্যাচারী রাজিবের কবল থেকে মৌসুমীকে মুক্ত করতে মান্না ছুটে যায় রাইফেল হাতে। মৌসুমী নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত না কিন্তু মান্নাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে থাকে। গানে গানে বলে-“আমার আপন বলে কেউ ছিল না আমার/কী যে ভাগ্য আমার দেখা পেলাম তোমার।” গান শেষ হলে চমৎকার হাসি দিতে দেখা যায় মৌসুমীকে। ছবির নাম ‘লুটতরাজ’।

মৌসুমী ভালোবেসেছে সেই মানুষটিকে যে তাকে নিষিদ্ধ পল্লী থেকে সমাজে সম্মানের জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। ছবির নাম ‘মেঘলা আকাশ’।
মৌসুমী ভালোবেসেছে রিয়াজকে, শাবনূরকে। যে রিয়াজ তার হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছিল এবং সাহসের সাথে বাবা এটিএমের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছিল : যে শাবনূর এটিএমকে মৌসুমীর কোপে হত্যা করা দেখে নিজের উপর দায় নিয়েছিল এবং রিয়াজকে বলেছিল-“বুবু সারাজীবন তোমার ভালোবাসার কাঙাল, তুমি তারে বুক ভইরা ভালোবাইসো।” সেই আত্মত্যাগী শাবনূরকে মৌসুমী এক নারী হয়ে আরেক নারীর অনুভূতিতে ভালোবেসেছিল। ছবির নাম ‘মোল্লাবাড়ির বউ।’ মৌসুমী ভালোবেসেছিল জা বিন্দুর ছেলেকে এবং দূরত্ব তৈরি হয়ে একসময় বিছানা নিতে হয় তাকে। শেষ অব্দি তার কাছেই সবাইকে ফিরতে হয়েছে। ছেলেটা ‘ছোট মা, ছোট মা’ বলে মৌসুমীর কাছে ছুটে যায়। মাতৃত্বের অগাধ মমতার ভালোবাসায় মৌসুমী তখন চিরন্তন আবেদনে চলে যায়। ছবির নাম ‘বিন্দুর ছেলে’।

মৌসুমী ভালোবেসেছে কাজী মারুফকে কাজলা দিদি হয়ে। সাদাসিধে ভাইটা সমাজের হীন মানুষদের দৃষ্টিতে পড়ে অপরাধজগতে চলে যায় তবুও কমে না বোনের মাতৃসম মমতা। মারুফ ফোন করলে মৌসুমী বলে-‘তুই বাসায় আসিস না কেন?’ এতটুকু কথাতেও অগাধ ভালোবাসা ভাইয়ের জন্য। ছবির নাম ‘ইতিহাস’।

মৌসুমী, কারে ভালোবাসো তুমি?
মৌসুমী, বলো কারে খোঁজো তুমি?
মৌসুমী ভালোবেসেছে চলচ্চিত্রে প্রেমিকা, স্ত্রী, বোন, মা হয়ে আর মৌসুমীকে সেসব সত্তায় খুঁজে নিয়েছি আমরা।


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply