রাজকুমার: আরেকবার আবেগী করবার চেষ্টা!
রাজকুমার; গল্প ও চিত্রনাট্য: হিমেল আশরাফ; অভিনয়: শাকিব খান, কোর্টনি কফি, তারিক আনাম খান, ড. এজাজ আহমেদ, ডি জে সোহেল, আহমেদ শরীফ, শিবলু মৃধাসহ অনেকে; প্রযোজনা: ভার্সেটাইল মিডিয়া; শুভমুক্তি: ১১ এপ্রিল (ঈদুল ফিতর), ২০২৪
এবারের ঈদের একমাত্র সিনেমা, যা বোঝার জন্য আমার দুইবার দেখতে হলো। প্রথমবার দেখলাম তাড়াহুড়ো করে। কোনোরকমে ঈদের নামাজ পড়েই ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দুরে চলে গেলাম সাভারের নবীনগরে। পরিচিত একজনের সাথে দেখা করতে ও সকাল সাড়ে ৯টার শো ধরতে। ঢুকতে ঢুকতে লেট হলো প্রায় ১৫ মিনিট। এরপর একদম শেষ ক্লাইম্যাক্সের সময়, ভোল্টেজ আপ-ডাউন করলো। হলের ভেতরে কারেন্ট চলে গেলো। গেলো আমার মনযোগ নষ্ট হয়ে। সবকিছু যখন ঠিক হলো, তখন দেখি মাঝে আরো ১৫ মিনিট মিসিং। সবমিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩০টা মিনিট চুনা খেয়ে আমার সিনেমাটা খুবই খারাপ লেগেছিল। এতোই খারাপ লেগেছিল যে কোনো রিভিউই দিতে মন চায়নি।
এরপর গতকাল (১৪ এপ্রিল) বাসার কাছে শ্যামলী সিনেমা হলে দ্বিতীয়বার দেখলাম সিনেমাটা। এবার আর সেই ভুল নয়, পুরো সিনেমা দেখলাম। পরখ করলাম। উপভোগ করার চেষ্টা করলাম। এবার পুরো সিনেমা দেখে আমার কিছু বিষয় উপলব্ধি হলো।
অল্প কথায় রাজকুমারের গল্প হলো, খুব কাছের একজন মানুষকে একবার দেখার আশায়, ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার আশায়, নায়কের আমেরিকা পাড়ি জমানোর চেষ্টা। চেষ্টার অংশটুকু প্রথমার্ধে কমেডির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। কমেডি অংশের গুরুদায়িত্ব অর্পিত ছিল ডা. এজাজ আহমেদ, শিবলু মৃধা এবং অবশ্যই শাকিব খানের নিজের ওপর। খুব দমফাটানো হাসির কিছু না হলেও, গল্পের টোন সেট করার মতো যথেষ্ট হাসির খোরাক ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।
গল্প যখন আমেরিকায় যায়, এরপর থেকে সিনেমাটা একটু একটু করে সিরিয়াস হতে থাকে। আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারি, স্যাম বা সামসুল কেনো আমেরিকায় আসার জন্যে এতো উতলা হয়েছিল। “প্রিয়তমা”র এরকম বীভৎস সাফল্যের পর “রাজকুমার” এর গল্পও যে শেষ পর্যন্ত একটা ইমোশনাল গতিপথ গ্রহণ করবে, এটা অনেকটা অনুমেয় ছিল। হয়েছেও তাই। সেটা আদতে বড় সমস্যা নয়। “রাজকুমার” কতটুকু সেই আবেগ তুলে আনতে পারলো, সেটা হলো আসল বিবেচনার বিষয়।
“প্রিয়তমা”র সাথে “রাজকুমার” এর গল্পে/চিত্রনাট্যে তেমন মিল নেই। তবে যেহেতু একই ঢঙ্গে বানানো, তাই স্বাভাবিকভাবেই দর্শক তুলনা দেবে। আমার কাছে “প্রিয়তমা”র তুলনায় “রাজকুমার”/এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ বেশি ভালো মনে হয়েছে। মূল কারণ একটাই, “রাজকুমার” এর চিত্রনাট্য অনেক বেশি গোছানো ছিল। “প্রিয়তমা”তে এই গোছানো ভাবটা দেখা যায়নি। প্রথম দুই ঘণ্টা যেমন-তেমন, শেষ ৩০-৪০ মিনিট সম্পূর্ণ অন্যরকম। “রাজকুমার” এ ফেলনা সিনের সংখ্যা তুলনামূলক কম। একদম শাকিবের এন্ট্রি সিন থেকে শুরু করে, ভিলেনের প্রতিশোধ নেওয়া পর্যন্ত, সবকিছুকেই কম-বেশি ক্লোজার দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা ভালো লেখার একটা গুণ। যেখানে আপনি মূল চরিত্রের পাশাপাশি পার্শ্ব চরিত্রগুলোর শেষ পর্যন্ত কী হলো, সেটাও খুঁজে পাবেন। আমি কোর্টনি কফি বাদে মোটামুটি সব মূল চরিত্রের ক্লোজার খুঁজে পেয়েছি। তবে ডি জে সোহেল সিনেমার শেষে এসে কীভাবে শাকিবের নির্দিষ্ট লোকেশন খুঁজে পেলো, সিনেমাটা দুইবার দেখেও খুঁজে পাইনি। কমার্শিয়াল সিনেমা বিবেচনায়, ব্যাপারটা নিজের মনমতো আন্দাজ করে নিয়েছি।
কোর্টনি কফির নাম নিতে গিয়ে মনে পড়লো, এ সিনেমার সবথেকে দুর্বল চরিত্র হলো ওনারটি। যার এ সিনেমায় বেশি স্ক্রিনটাইম পাওয়ার সেরকম কোনো দরকার নেই। সেইসাথে যোগ করুন এক বালতি বাজে অভিনয়। আমার কাছে মনে হয়েছে উনি সিনেমাটা কী নিয়ে সেটাই বুঝতে পারেননি। অবশ্য না বোঝাটাই স্বাভাবিক। গল্পের মূল থিমটা একটু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের, যেখানে খুব সেন্সেটিভ একটা ইস্যু নিয়ে ডিল করা হয়েছে।
সিনেমার শেষদিকে দুইটি ক্যামিও ছিল, যার মধ্যে পুরুষ ক্যামিওটি আমার কাছে ভুল সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে। ওরকম এক্সপ্রেশনবিহীন একজনকে দেওয়া হলো তারিক আনাম খানের যুবক চরিত্র, ব্যাপারটা একটুও হজম হলো না। এখানে পরিচালক অন্য কোনো সিদ্ধান্ত বিবেচনায় আনতে পারতেন। তবে নারী ক্যামিওটি আমার ভালো লেগেছে। উনিও আহামরি অভিনেত্রী নন, কিন্তু এইবার উনি ভালো করেছেন কারণ উনি ওনার কমফোর্ট জোনে থাকার মতো একটা চরিত্র পেয়েছেন। ছোট, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্যামিও ছিল।
এছাড়া তারিক আনাম খান স্পেস কম পেলেও খুব ইফেক্ট ফেলার মতো কিছু সিকোয়েন্সে ছিলেন। ভালো একটা ক্লোজার পেয়েছেন আহমেদ শরীফের চরিত্রটিও। ওনার চরিত্রের মাধ্যমে সিনেমাতে দেশপ্রেমমূলক মনোভাব ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এ সিনেমায় তিনি ভয়েস দেননি। এছাড়া অল্প কিছু সময় বর্ষীয়ান অভিনেত্রী দিলারা জামানকেও দেখা গিয়েছে।
শাকিব খানের ভালো অভিনয় দেখা গিয়েছে এ সিনেমাতে। বিশেষ করে ইমোশনাল সিনে শাকিব একশো তে একশো। পাবনার আঞ্চলিক টানের সংলাপেও তিনি মানিয়ে গেছেন, কমেডিও মোটামুটি ভালো করেছেন। তবে কফির সাথে শাকিবের রোম্যান্স জমেনি। এছাড়া ফাইট সিনে বরাবরই শাকিব দুর্বল, এই দুর্বলতা এবারেও স্পষ্ট। প্রচুর চিটশট ইউজ করে ফাইট সিন সাজানো হয়েছে। এতো হাক-ডাক দিয়ে ফাইট সিনটার প্রশংসা করা হলো। কিন্তু আমার দেখে মনে হলো এরকম ফাইট সিন আমাদের ডিএইচ চুন্নুরাও সাজাতে পারে।
শেখ রাজিবুল ইসলামের করা ডিওপির কাজ আমার কাছে দুই জায়গায় দুইরকম লেগেছে। দেশের অংশে চোখজুড়ানো, আমেরিকার অংশে মোটামুটি চলনসই। তবে ভালো কোয়ালিটির ক্যামেরা ইউজ করে সিনেমাটা বানানো হয়েছে, এটা স্বীকার করতেই হবে! নরমাল বাংলা চলচ্চিত্রের থেকে এটার ফ্রেমিং কোয়ালিটি আলাদা মনে হয়। তবে “রাজকুমার”-এর মিউজিক আমাকে খুব হতাশ করেছে। না ভালো হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, না ভালো হয়েছে গানগুলো। এই সিনেমার জন্য গানগুলো শ্রুতিমধুর হওয়া খুব প্রয়োজন ছিল। সেইসাথে গল্পের পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়, এমন গানের দরকার ছিল, যেমন ছিল প্রিয়তমার ‘ঈশ্বর’। সেরকমটা এবার হয়নি। ৬টা গানের কোনোটাই মন ভরাতে পারলো না। সেইসাথে ইমন সাহার করা বিজিএম আরো বাজে হয়েছে। সিনেমাটা আরো বেশি ইমোশনাল হতো, কিন্তু এই টিপিক্যাল বিজিএম সিনেমার মেরিট নষ্ট করেছে।
সিমিত রায় অন্তরের করা এডিটিং আমার কাছে মোটামুটি লেগেছে। “আমি একাই রাজকুমার” গানের টিকটক মার্কা এডিটিং নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। সেটা মূল সিনেমায় যতটা সম্ভব ঠিক করা হয়েছে। দুই-এক জায়গা ছাড়া বাকি সিনগুলোতে সেই ইফেক্টগুলো দেখিনি। তবে সিনেমার মেকআপ জুতসই হয়নি। শাকিব এইবার নিজের চেহারা ভাঁজ লুকোতে গিয়ে প্রচুর মেকআপ নিয়েছেন। আমি এই একজন নায়ক দেখলাম যে সবসময় চেষ্টা করে নায়িকার থেকে বেশি মেকআপ নেওয়ার, সুযোগ পেলে কখনোই সে ছাড়ে না। তারিক আনাম খানের গোঁফ দাঁড়ি মনে হয়েছে ফেইক, তার যুবক চরিত্রে যিনি ছিলেন তারটা ছিল আরো ফেইক, চুলের থেকে দাঁড়ি ঘন হয়ে গিয়েছে বেশি!
সিনেমায় একটা বাচ্চার কান্নার দৃশ্য ছিল, যেটা নিয়ে আমার ঘোর আপত্তি আছে। প্রায় দুই মিনিট যাবত স্ক্রিনে শুধুমাত্র বাচ্চার কান্না শুনিয়ে যাওয়া হলো, লাউড স্পিকারে। যেটা আমার কাছে অনেকবেশি জোরপূর্বক কান্না করানোর চেষ্টা মনে হয়েছে। কান্না আসার মতো পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারলে, মানুষ শাকিবকে বুড়ো দেখলেও কাঁদে। জোর করে কাঁদানোর কোনো প্রয়োজন হয়না। এটা আমার কাছে সিনেমার সবথেকে বাজে সিকোয়েন্স মনে হয়েছে।
বাজে সিকোয়েন্সের পাশাপাশি সিনেমার সবথেকে ভালো সিকোয়েন্সের কথাও বলতে হয়, সেটা হলো সিনেমার শেষ ক্লাইম্যাক্সে, যখন সামসুল কাউকে খুঁজতে গিয়ে… তার মুখে সুমিষ্ট ভঙ্গিমায় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পায়। কোনোরকম বিতর্ক যেন না হয়, সেরকম সৌন্দর্য মেইনটেইন করে সিকোয়েন্সটা সাজানো হয়েছে। এটা দেখে আমি মনে করি যেকারো মন জুড়িয়ে যাবে। আমাদের পাশের দেশের সিনেমাতে প্রায় সময়ই তাদের মূল ধর্মকে তাদের সংস্কৃতি হিসেবে প্রমোট করা হয়। আমরাই কেনো জানি সেটা তেমন একটা করি না। রায়হান রাফীর বানানো “পোড়ামন ২” এ আমি সম্ভবত প্রথমবার এরকমভাবে নাতে রাসুল (সা.) -কে প্রমোট করতে দেখেছিলাম। আজ “রাজকুমার” এ দেখলাম। আমরা যে ধর্মপ্রাণ সেটা বুঝানোর জন্য মাঝে মাঝে আমাদের সিনেমাতে এগুলো প্রমোটের প্রয়োজন।
সব মিলিয়ে এই ছিল আমার দৃষ্টিতে রাজকুমার। লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেলো, এরপরও মনে হচ্ছে আরো অনেক কিছু বলার ছিল। সবমিলিয়ে আমি বলবো সিনেমাটা প্রিয়তমার থেকে বেটার হয়েছে। হিমেল আশরাফ তার গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় উন্নতি করেছেন। তবে দুর্বলতাও আছে বেশকিছু, তন্মধ্যে অন্যতম হলো মিউজিক!
রেটিং: ৭/১০