রিভিউ/ নবাব সিরাজউদ্দৌলা : এক আশাব্যঞ্জক ট্র্যাজেডি
বাংলার ইতিহাসে মানুষটি ভীষণ ভীষণ জীবন্ত। আর বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নবাব সিরাজউদ্দৌলা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ১৯৬৭ সালের ১২ জানুয়ারি মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত চলচ্চিত্র। সেই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক চিত্রালীতে সিনেমাটির রিভিউ করেন আহমেদ জামান চৌধুরী। প্রকাশ হয়ে ২০ জানুয়ারি। বিএমডিবি পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি তুলে ধরা হলো।
প্রযোজনা: মাহবুবা রহমান; চিত্রনাট্য, সঙ্গীত ও পরিচালনা: খান আতাউর রহমান, চিত্রগ্রহণ: বেবী ইসলাম; সম্পাদনা: বশীর হোসেন; শব্দগ্রহণ; এম এ জহুর; ভূমিকাংশে: আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা জামাল, আতিয়া চৌধুরী, এম এ সামাদ, এস এ খালেক, তেজেন চক্রবর্তী, রাজ, সামাদ, মঞ্জুর ও খান আতাউর রহমান।
বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিষাদময় জীবনটার মতো পরবর্তীকালের সিরাজউদ্দৌলা-চর্চার ইতিহাসটাও বিষাদাত্মক। ষড়যন্ত্র আর মিথ্যাচারের প্রেক্ষাপটে তরুণ সিরাজের জীবনটা যেমন শেষাবধি অবগাহন করেছিল ব্যর্থতার মধ্যে, ঠিক তেমনি পরবর্তীকালের সিরাজ-চর্চাও। জীবৎকালে তিনি যেমন কোন স্বীকৃতি পাননি, তেমনি মরণের পরেও। কি নিদারুণ পরিহাস!
অথচ এহেন পরিহাসের কবল থেকে আমরা কি এই হতভাগ্য চরিত্রটিকে মুক্ত করে আনতে পারতাম না? অন্তত তাঁর মৃত্যুর দু’শ বছর পরে যখন দেশের পট আবার বদলে গেছে। সিরাজের যুগের দু’শ বছর পরেও কেন আমরা পেলাম না তেমন কোন সত্যসন্ধ, যিনি নিরাসক্ত থেকে এই অন্তর্দ্বন্ধক্লিষ্টি চরিত্রটিকে বিশ্লিষ্ট করেছেন?
কি নিদারুণ পরিহাস যে, এসব আক্ষেপ ও প্রশ্নের পিঠে বলবার মতো যুক্তিগ্রাহ্য ভাষা বা জবাব আমাদের কণ্ঠস্বরে কি জিহ্বায় জন্ম হয় না।
গিরিশ ঘোষ কিংবা অক্ষয় মৈত্র অথবা শচীন সেনগুপ্ত একজন সিরাজের জন্ম দিয়েছেন অবশ্য যিনি ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা বর্ণিত লম্পট, দুরাচার আর অযোগ্য নৃপতি নন, বরং অন্য কিছু। কিন্তু এই ত্রয়ীর সিরাজ চরিত্রের পরেও অবকাশ ছিল, প্রয়োজন ছিল সিরাজ চরিত্রের মাত্রিকতা ফুটিয়ে তুলবার। এবং সিরাজউদ্দৌলা-চর্চাজনিত এহেন শূন্যতার মাঝেই এলো খান আতাউর রহমানের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্ররূপে যদিও, তথাপি সিরাজউদ্দৌলা চর্চার অঙ্গ হিসেবেই।
খান আতাউর রহমানের নবাব সিরাজউদ্দৌলা এদেশের মানুষের কাছে অনেক দিনের চেনা, আর ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র খান আতাউর এ ছবিতে উপস্থিত অনেক অচেনা আর অনেক অজানা পরিচয় সহ।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চিত্র সৃষ্টি হিসেবে কোন পংক্তিভুক্ত? একি সমস্যামূলক অথবা ঔপনিবেশবাদ বিরোধী কিংবা এক শুদ্ধ জীবনীচিত্র। আপাতদৃষ্টিতে এ-চিত্র ঐতিহাসিক এবং পারতপক্ষে জীবনীচিত্র। কিন্তু অনুচিন্তার অবকাশে বোঝা যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার অঙ্গে অনেক রূপ।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ঐতিহাসিক ছবি এই অর্থে যে, অষ্টাদশ শতকের উত্তর মধ্যাহ্নকালে এদেশের ললাটে পরাধীনতার চিহ্ন যখন হলো উৎকীর্ণ, তখনকার ঘটনাবলীর পটভূমিতেই সিরাজউদ্দৌলা প্রমূর্ত।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা সমস্যামূলক চিত্র এই অর্থে যে, এতে কেবল ব্যক্তিক নয়, সামাজিক সমস্যাও বিধৃত। বরং বলা চলে ফিরেঙ্গী বণিকদের আগমনের পর এদেশের সামন্ততান্ত্রিক ও কৃষিভিত্তিক সমাজ কাঠামোতে যে পরিবর্তন হয়ে উঠল সুস্পষ্ট তার প্রেক্ষিতই সিরাজের ব্যক্তিগত সমস্যা পক্ষ বিস্তার লাভ করেছে।
এটি উপনিবেশবাদ বিরোধী যা আজাদী আন্দোলনের স্মারক চিত্র-দলিল এজন্য যে, এখানে সিরাজউদ্দৌলার উন্মেষ ও বিলয় বিদেশী শক্তির বিরোধী এক অসহায় সেনানী রূপেই চিহ্নিত।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার আরেক পরিচয় জীবনী তথ্যচিত্র না হলেও জীবনীচিত্র রূপে অবশ্যই। এ ছবিতে এমন একটি চতুর্মাত্রিক চরিত্র উপস্থিত যিনি একই সঙ্গে নৃপতি, সংসারী, সেনানী এবং মানুষ।
এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার এসব পরিচয়াবলীই হেতুই বলি, খান আতাউর রহমান এখানে উপস্থিত অনেক অনেক অদেখা এবং অনেক অচেনা প্রয়োগ কুশলতা জনিত পরিচয় নিয়ে।
একটি ফিরেঙ্গী জনৈক দেশীয় কিষাণকে চাকাচ্ছেন- অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিরাজউদ্দৌলা (আনোয়ার হোসেন) মানুষের বেশে।
একটি অসহায় প্রজার ওপর এই ফিরেঙ্গী বণিকের অত্যাচার তিনি সইতে পারলেন না। দাদু নবাব আলীবর্দী খাঁ-র কণ্ঠস্বর তাঁর অন্তরকে করতে লাগল পীড়িত। দাদু ওদের সহ্য করিসনে। ওরা বাণিজ্যের নাম করে এদেশে এসে বইয়ে দেবে অত্যাচারের বন্যা। আর দেরি নয়। ফিরেঙ্গীকে লক্ষ্য করে খঞ্জর ছুঁড়ে মারলেন তিনি। এ-ই হচ্ছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, অত্যাচার ও অত্যাচারীকে যিনি সইতে পারলেন না এবং ফিরেঙ্গীদের অশুভ পদক্ষেপ সম্পর্কে যিনি সম্পূর্ণ সজাগ।
দ্রুতবেগে প্রাসাদে এলেন সিরাজউদ্দৌলা, দ্রুতপদে অগ্রসর হলেন মসনদের দিকে। শূন্য আসনটা তাকিয়ে আছে অনেক অর্থ নিয়ে। সিরাজ এই অর্থ বুঝলেন আর তা-ই বললেন সেই থমথমে পরিবেশে- ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব তোমার শেষ আদেশ আমি ভুলিনি জনাব’।– এবং এই হচ্ছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যিনি এদেশের বিজয় পতাকা সমুন্নত রাখবার জন্যে কৃতসংকল্প।
হঠাৎ শাড়ির খসখস আর চুড়ির রিনিঝিনি। সিরাজউদ্দৌলা সচকিত-কে ওখানে? এক নারী। কেন? কেন এসেছে সে? গুপ্তচর বৃত্তির উদ্দেশ্যে নবাবের মন ভোলাবার জন্য? তিনি এই অপরিচিতাকে পাঠালেন প্রাসাদের কারাগারে। এই হচ্ছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা- যিনি নারী মাংসের গন্ধ পেলেই আদিম আহ্বানে মগ্ন হন না।
নবাব-বেগম লুৎফুন্নেসার মহলে নবাব সিরাজ এলেন এক মূর্তিমান অস্থিরতা নিয়ে। তারপর এক সময় স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এই বিপদের দিনে তাঁর পাশে থেকে লুৎফা যদি শক্তি না যোগান তা হলে? এবং এ-ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা যিনি সংসারী ও শুদ্ধ পত্নীপ্রেমী।
প্রাচীন ইতিহাসগুলোতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেভাবেই চিত্রিত হয়ে থাকুন খান আতাউরের সিরাজউদ্দৌলা এক শক্তিশালী ও বহুমুখী চরিত্র। কখনো তিনি বলশালী নৃপতি, কখনো ক্ষমাশীল, কখনোবা স্ববিরোধী, কখনো নিজস্ব মানুষের ওপর প্রত্যয়নিষ্ঠ, তথাপি শেষাবধি তিনি এমন এক মানুষ যিনি তাঁর নিজের ভূমিকাকে ভালোবাসেন অন্তর দিয়ে; আর এইহেতু কোন সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেন না, মৃত্যুকে সামনে দেখেও।
সিরাজউদ্দৌলার মতো একটি শক্তিশালী চরিত্র অবলম্বনে ছবি করবার সময় প্রয়োগকর্তার শক্তির কথাও বিবেচ্য। এই বিবেচনা করেই বলা যাচ্ছে সিরাজউদ্দৌলার চিত্রভাষ্য রচনার মতো স্পর্ধা বা শক্তি খান আতাউরের যে রয়েছে তা প্রমাণিত।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে একটা বড় কথা হচ্ছে এর পরিণত আবেদন নানাস্তরে ধরা পড়ে। যান্ত্রিক স্তরে এ ছবি এদেশীয় চিত্রশিল্পে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিষয়বস্তুর দাবিতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার উপস্থাপনায় ও আঙ্গিকে মঞ্চধর্মিতা ছায়া ফেলেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু এই মঞ্চধর্মিতা চলচ্চিত্রিক গুণবিমুক্তি নয়। ফলতঃ প্রায়শঃ সুন্দর সুন্দর চিত্রকল্পের সন্ধান পাওয়া যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলায়। উদহারণতঃ নৌকায় করে নবাব-দম্পতির পলায়নের দৃশ্যটির একটি অংশে যখন দু’জন শাহী রক্ষী দেখা গেল নদীর পারে, তখন তাদের পাশে একটি উৎপাটিত বৃক্ষটি বিশেষভাবে ইংগিতবহ। ছবির আলোকচিত্রে আরো নয়ননন্দনকর হতে পারতো যদি পরিস্ফুটিত গোলযোগ আরো কম হতো। শব্দগ্রহণও আরো সুষম হতে পারতো। তবে সম্পাদনা উচ্চমানের। অভিনয়ের স্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এমন অভিনয় অভিজ্ঞতায় আপ্লুত করে যা ভোলার নয়। নাম ভূমিকায় আনোয়ার হোসেন এক কীর্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। কি আবেগময়, কি অন্তর্দ্বন্দ্বময় সকল মুহূর্তেই এই শিল্পীর অভিব্যক্তি ও সংলাপ যখন দর্শককে তন্ময় করে রাখে। আনোয়ারের আগে সিরাজ চরিত্রে বহু অভিনেতা অভিনয় করেছেন, নাম কিনেছেন। আনোয়ার তাঁদের ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন কি? এ প্রশ্ন অবান্তর। কেননা, সিরাজউদ্দৌলা বলে আনোয়ার হোসেনকে ভাবতে মোটেও কষ্ট হয় না। আনোয়ারকে বলিঃ ‘আপনার দৃষ্টান্ত আপনিই।’ আনোয়ারা জামাল, ইতিপূর্বের ছবিগুলোতে থাকে রূপায়ণের চেয়ে ভংগি প্রদর্শনের জন্যেই বেশি ব্যস্ত রাখা হয়েছে- তিনি আলেয়ার চরিত্র প্রমূর্তনে যে এতটা উত্তরিত হতে পারবেন তা সম্ভবতঃ তাঁর পরম মিত্ররাও ভাবতে পারেননি।
অন্যান্য চরিত্রে এস এ খালেক, রাজ, এম এ সামাদ, আবদুল মতিন, আতিয়া চৌধুরী, তুলিপ, মঞ্জুর, আলী মনসুর এবং সর্বোপরি খান আতাউর রহমান (মোহনলাল) স্বয়ং স্ব-স্ব চরিত্রে অনবদ্য। এটা বলা বোধ হয় অত্যুক্তি নয় যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পূর্বে ঢাকার কোন ছবির অভিনয়াংশ এত উচ্চাঙ্গের ও এত অন্তরস্পর্শী হতে পারেনি। এছবি প্রমাণ করেছে, আমাদের শিল্পীরা কত শক্তিমান- কেবল চাই সুযোগ্য পরিচালক, যিনি এই সুপ্ত শক্তি কাজে লাগাতে পারেন। পরিচালক খান আতাউর, অভিনেতা খান আতাউর ও অন্যান্যের পেছনে যে শ্রম ব্যয় করেছেন তা শেষাবধি বিফলে যায়নি আর এটাই তাঁর পুরস্কার।
সাহিত্যগত স্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বলিষ্ঠতায় ভাস্বর। প্রাচীন ও নবরচিত সংলাপের সংযোজন এ ছবিতে এমনভাবে নিষ্পন্ন যার ফলে একাধিক নয়, একটিমাত্র সংলাপই সমস্ত চরিত্রগুলোর প্রকৃতির রহস্যের উন্মোচন করেছে।
দার্শনিক ও নন্দনতাত্ত্বিক স্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যে অনুভূতি জাগায় তা কোনক্রমেই তাৎক্ষণিক নয় এবং সে অনুভূতি মহৎ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। সিরাজউদ্দৌলা কেবল কোন নৃপত্তির উত্থান-পতনের কাহিনী নয়। এ হচ্ছে মানব ভাগ্যের নির্মম ট্র্যাজেডি এবং ট্র্যাজেডির পরেও যে আশা আছে তাই এ ছবির মর্মে রয়েছে লুকিয়ে।
কিছু চরম স্তরে এ ছবি একটি অনুভূতিসিক্ত গাথা। অনুভূতিটি বিষাদাত্মক আর গাথাটি মানুষের অন্তরৈশ্বর্য বর্ণনায় বাঙময় আর সেইহেতু আশাব্যঞ্জক। নবার সিরাজউদ্দৌলা শেষ বিচারে ট্র্যাজেডি সন্দেহ নেই, কিন্তু এ ট্র্যাজেডি কান্নার সাথে আশারও জন্ম দেয়, নিজস্ব অস্তিত্বের মুকুরে চেহারা দেখবার জন্যে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলায় কি আমরা পাইনি তা দেখার অবকাশ কম- কেননা এ ছবির অবদানই বেশি। এ ছবির কিছু প্রলম্বিত দৃশ্যের যৌক্তিকতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কেউ কেউ হয়তো এটাও বলতে পারেন যে, সংলাপে শচীণ সেনগুপ্তের প্রভাব খান আতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিংবা হয়তো বলা যাবে আবেগ নিয়ে বড় বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো জরুরি নয় ছবির ক্যানভাসের প্রেক্ষিতে।
আর সেজন্যেই বলি, পাকিস্তানি চিত্রশিল্পের আঠারো বছরের ইতিহাসে ইতিহাসাশ্রয়ী চিত্রগুচ্ছের মধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা সর্বোত্তম এর সততা, সত্যনিষ্ঠা, সিরাসক্তি আর পরিবেশমুখীনতার জন্য। জয়তু খান আতাউর রহমান।
সূত্র: পত্র-পদ্রিতায় প্রকাশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচনা (১৯৫৬ – ২০০৯), সম্পাদনা: অনুপম হায়াৎ