রিভিউ/ লুটতরাজ মান্না
[কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘লুটতরাজ’ মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। অভিনয়ের পাশাপাশি এই ছবির প্রযোজক মান্না। সঙ্গে ছিলেন মৌসুমী, দিতি ও রাজীব। এটা মৌসুমীর সঙ্গে এই নায়কের প্রথম ছবি। তুমুল জনপ্রিয় পায় ‘লুটতরাজ’। ওই সময়ের একটি পত্রিকায় সিনেমাটির রিভিউ লেখেন বদর বখতিয়ার। চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে রিভিউর কাটিংটি সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে বেশকিছু লাইন অস্পষ্ট। এছাড়া পত্রিকার নাম বা তারিখ উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও বিএমডিবি মনে করেন, এটি পাঠকদের জন্য দারুণ একটি সংগ্রহ। পড়ুন।]
সিনেমা দিয়ে দেশপ্রেম প্রকাশের বেলায় কাজী হায়াতের যে ধরন, তা বেশ অদ্ভুত। দেশপ্রেমের বিরোধিতা প্রকাশ করে এমন সব নাম দিয়ে ভদ্রলোক ছবি বানান। দেশদ্রোহী, দাঙ্গা, ত্রাস, লুটতরাজ— এরকম। তারপর সর্বেসর্বা, বিপ্লবী, বীরবিক্রম, নায়ককে দিয়ে দূর করান দাঙ্গা, ত্রাস এবং তা করে তিনিই আত্মতুষ্ট হন যে মনে করেন এ জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তার প্রাপ্য। সেটা না পেলে জাতীয় পুরস্কারকে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। এই দাঙ্গা দূর করতে তার নায়ক ছবিতে পদে পদে দাঙ্গা বাধায় ত্রাসের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে নিজেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, দেশদ্রোহীদের নির্মূল করতে নিজে যা করে তা দেশদ্রোহিতারই পর্যায়ে পড়ে।
লুটতরাজ ছবিতে অবশ্য নিজে কোনো লুটে অংশ নেয়নি তবে জন্ম দিয়েছে নানা সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের। যার শেষভাগে আছে একরাশ খুন এবং খুন করে তার পুরস্কার দাবি করেছে এক বিরাট পুলিশ কর্মকর্তার কাছে, যেন ওটাই পুলিশের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। পুলিশ কর্মকর্তার চোখ ছলছল এবং মন গদগদ হয়ে পড়লেও তিনি তার হাতে হাতকড়া লাগিয়েছেন কাঁপা কাঁপা হাতে। রাশি রাশি খুনের জন্য তার সাজা হয়েছিল ১৪ বছর। কিন্তু ১৪ বছর নায়ক জেল খাটলে যে যৌবন হারিয়ে ফেলবে, ওদিকে সুঠাম স্বাস্থ্যের মৌসুমী হয়ে পড়বে বিগতযৌবনা। ইত্যাদি আগপাছ ভেবে ৪ বছর পরই নায়কের মুক্তির সুবন্দোবস্ত করা হয়। সে বেরিয়ে দেখে ঐ পুলিশ কর্মকর্তাই মৌসুমীকে নিয়ে জেলগেটে। আর খুন নয়, আর বঞ্চনা নয়- এবার একদার বাইজি মৌসুমীকে নিয়েই একদার পুলিশ ইন্সপেক্টর মান্না সংসার পাতার পথে পা বাড়ায়।
মান্নার জীবনে দুঃখজনক যে কয়েকটি বাঁক এসেছিল তার একটির মূলে ছিল এই মৌসুমী। মৌসুমী তার ঘরে ঢুকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে তাকে ফাঁসিয়ে দেয় ইজ্জত হরণের চেষ্টার দায়ে। আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে শেষে প্রমাণিত হয় মান্নার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র এখানেও কলকাঠির নিয়ন্ত্রক মৌসুমী। সেই এমন পূতপবিত্র চরিত্রে মান্নার চরিত্রকে নিয়ে এসেছিল আদালতে, অথচ আদালতে দাঁড়িয়ে তার জীবন-যৌবনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক রাজীবের ভীতিকে তুচ্ছ করে বলেছিল যে মান্না নির্দোষ। সে যা করেছে তা রাজীবের চাবুকের ভয়ে করা স্রেফ অভিনয়। অবশ্য এ কথা বলার আগে আদালতকে যাত্রামঞ্চ বানিয়ে যাচ্ছেতাই কিছু কাণ্ড করে। যাই হোক, মান্না বাঁচলো, চাকরিও ফিরে পেলো এবং মৌসুমীকে রাজীবের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ প্রহরার বন্দোবস্তও করল। কিন্তু ছবি শেষ দৃশ্যে আসার আগ পর্যন্ত ভিলেনের যে ক্ষমতা থাকে তাতে ওসব পুলিশ তো ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া মাছির মতো। অতএব মৌসুমীকে হজম করতে আরো কয়েক ঘা চাবুকের আঘাত। একদিকে পিঠে চাবুকের আঘাত অন্যদিকে হৃদয়ে তখন আঘাত করতে শুরু করেছে মান্নার হৃদয়। মান্নাকে নিয়ে মৌসুমী একটা গান ও নাচ কল্পনা করে ফেললো। এই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন হালের নামকরা ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। খুব সম্ভব ছবির যাবতীয় নাটকীয়তা ক্লাইম্যাক্সের চেয়ে এ জায়গাটাই দর্শক খেয়েছে সবচেয়ে বেশি।
এভাবেই ঘটনাপ্রবাহে মৌসুমী চরিত্রের দৃঢ় প্রবেশ। এর আগ পর্যন্ত বাইজি হয়ে কুৎসিৎ নেচে যাত্রার রুচিহীন দর্শকদের লেলিহান লোভের লক্ষ্যবস্তুই ছিল সে কেবল। নাচের সঙ্গে যে গান ছিল কুরুচি প্রদর্শনে তা আরেককাঠি সরেস। ‘ভরে যাবে তোমার মন- রয়েছে আরো অনেক গোপন আয়োজন’ এই ধরনের নিন্দনীয় কথার গানের মধ্য দিয়ে গীতিকার প্রকাশ করেছেন নিজেকে। গানগুলো চিত্রায়নে যে যত্ন করা হয়েছে এবং যেটুকু নৈপুণ্য দেখানো হয়েছে তা প্রশংসা দাবি করতে পারবে না ঐ কথাগুলোর জন্য।
মৌসুমী এভাবে প্রদর্শিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মান্নার মন-প্রাণ সর্বাঙ্গ ছিল দিতির একার এবং দিতিরটা মান্নার। এই সম্পর্ক সূচিত হয়েছিল লুটতরাজের ঘটনার মধ্য দিয়ে। দিভি গরম গরম বক্তৃতা দিয়েছিল তার কলেজের নির্বাচন উপলক্ষে, গরম বক্তৃতার সঙ্গে নরম দিতি- কলেজের সব ছেলেমেয়ে তাই এসে দাঁড়ায় তার পেছনে। এতে প্রমাদ গুনে এক রাজনৈতিক নেতার লেলিয়ে দেওয়া ছেলেরা তার বাসায় আসে নির্বাচনে না দাঁড়ানোর নির্দেশ নিয়ে। তার উদ্দেশ্যে দিতি এমন সব ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বললো যে, মনে হয়েছিল …. (অস্পষ্ট) কিংবা পরিচালকের মদদ আছে। কিন্তু তা তখন পর্যন্ত ছিল না। তাকে এবং তার মাকে ঘরে যাচ্ছেতাই পিটিয়ে গেলো সন্ত্রাসীরা; শুধু পেটানোতেই শেষ নয় । করা লুট করে নিয়ে গেলো ঘরের যা কিছু, এসব সন্তানের ক্ষেত্রে লুটের ঘটনা নতুন সংযোজন, তবে কি ছবির নাম লুটতরাজ রাখার স্বার্থেই এই ঘটনা ঘটানো।
হতে পারে; দাঙ্গা, ত্রাস, দেশদ্রোহী প্রভৃতি নাম যে আগেই ভেজে খেয়ে ফেলছেন কাজী হায়াৎ সাহেব। লুটের ঘটনা নির্বিঘ্নে শেষ করে যখন গাড়িতে উঠে বসেছে সন্ত্রাসী কিংবা লুটেরারা তখনি আগমন মান্নার। তারপর নায়কোচিত পিসিম-ত্রিসিম করে ওদের কুপোকাত এবং দিতির মনে ঢুকে যাওয়া। এরপর অবশ্য যোগাযোগহীনতায় বিচ্ছেদ ঘটে যায়। আবার মিলন হয়। তমালপুর নামক বাংলাদেশের (!) কোনো এক জেলায় এসে। আশ্চর্য ব্যাপার যে, ছবিতে পুলিশ-মন্ত্রী-এমপিতে দুর্নীতি উন্মোচনে সাহসের কোনো ঘাটতি নেই সে ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে জেলার ছদ্মনাম। ভাবসাব দেখে মনে হলো বাংলাদেশে জেলা কেবল ঐ তমালপুরই শুধু। দুর্নীতিবাজ এমপি, যার অঙ্গুলি হেলনে দিতির বাসায় লুটতরাজ হয়েছিল সে ঐ জেলার, দিতির অসৎ বাবার পোস্টিংও ওখানে, মান্নাও এখানকার ভারপ্রাপ্ত এসপি এবং যে জন দারোগাটি মান্নাকে ঝামেলায় জড়িয়েছে সেও ঢাকা থেকে বদলি হয়ে এলো এখানেই। আর এখানে আগে থেকেই বাস করছিল বাসু মিয়া নামের বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতার ব্যক্তি অর্থাৎ রাজীব। এসেই তার সঙ্গে লাগালাগি শুরু করে মান্না, পরিণাম ঘনাতে হয় তার হাতে চাবুকপেটা হয়ে। তার জন্য চাবুকপেটা হতে হয় দিতিকেও, বেচারি সেটা সহ্য করতে না পেরে বরং মরেই যায়। মরে গিয়ে নিজের অজান্তেই মৌসুমীর জন্য পোয়াবারো করে দিয়ে গেলো। মান্নার জন্যও।
নিজের টাকায় বানানো ছবিটিতে ব্যয় করা তিন ঘণ্টা উসুল করে নিয়েছেন মান্না। দারুণ কেটেছে তার ছবিটি। এএসপি হয়ে সারাক্ষণ ভারপ্রাপ্ত হিসেবে এসপির ক্ষমতা ভোগ করেছেন। অধঃস্তন অফিসারদের কিলঘুসি মেরেছেন। অনেকগুলো খুনের জন্য জেল খাটতে হয়েছে ৪ বছর এবং সারা ছবি দিভির সঙ্গে প্রেম করে শেষে পেয়েছেন মৌসুমীকে।
সবশেষে প্রশংসা করতেই হবে একটা বিষয়ের। ছবিতে এমপি, মন্ত্রী, ডিসি, পুলিশ সবাইকে দুর্নীতিবাজ এবং গডফাদারদের বশংবদ হিসেবে দেখিয়ে সাহসিকতার পরিচয় যেছেন নির্মাতারা। তবে এতোসব ঘটনা একসঙ্গে তাদের কল্পনার রাজ্য ছাড়া কোথাও সম্ভব নয়। নেই কল্পনার রাজ্য তমালপুর জেলা। এতো অপকীর্তির ক্ষেত্র হিসেবে কোনো জেলার নাম ব্যবহার করলে জেলাশুদ্ধ লোক নির্মাতাদের দিকে তেড়ে আসতো, তবেই বোধ হয় ছদ্মনাম ব্যবহার।
*বাংলা চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপে রিভিউয়ের পেপার কাটিং পোস্ট করেছেন কাব্য হোসাইন। রিভিউটি সেখান থেকে সংগ্রহ করা।