রিভিউ/ সহজ ছবি ‘ভেজা চোখ’
১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি পায় শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘ভেজা চোখ’। মর্মস্পর্শী কাহিনি, তুখোড় অভিনয় ও হৃদয়ছোঁয়া গানের এ ছবিতে ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, চম্পা, নিপা মোনালিসা, মিঠুন, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকে। এক সময় ঝড় তোলা সিনেমাটির কোনো প্রিন্ট টিকে না থাকায় এখনো অনেকেই আফসোস করে থাকেন। ১৯৮৮ সালের ১ এপ্রিলের সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘ভেজা চোখ’-এর রিভিউ করেন মাহমুদা চৌধুরী। ওই লেখায় কোনো শিরোনাম ছিল না। বিএমডিবির পক্ষ থেকে একটি বিকল্প শিরোনাম দিয়ে লেখাটি তুলে ধরা হলো—
দুই দশক ধরে ছবির জগতে বসবাস— শিবলী সাদিক; প্রাথমিক পর্বের ব্যবসায়িক ব্যর্থতার দরুণ ‘তিনকন্যা’ ও ‘নীতিবান’-এর মতো কুরুচিকর ছবি নির্মাণে লিপ্ত হন। দ্বিতীয় পর্বের তিন নম্বর ছবি ‘ভেজা চোখ’-এ এসে রথের মুখে উল্টো দিকে সরিয়ে দিলেন।
অন্তঃশক্তির প্রতিজ্ঞায় অটল যুবক সন্ন্যাসীর মতো, তিনিও যে শরীর থেকে ধ্যানে পৌঁছানোর অভিলাষী। সহজ রীতির অনুসরণে নির্মিত এই ছবির শরীরে ছড়িয়ে থাকে মনোযোগ ও অভিজ্ঞতার স্পর্শ। গল্পটি এই রকম: আলালের ঘরের দুলাল জীবন। নিয়মের পথ ধরে না, চলাটাই তার পণ। মৃত্যুর শমন জারি হতেই আরো বেপরোয়া হলো সে। প্রিয় সখি প্রিয়ার ভালোবাসাও তাকে সেই মরণকামী ‘ডেথ-ডেথ’ খেলা থেকে নিবৃত্ত করতে পারল না। প্রিয়া আর জীবনের প্রিয় সহচরী প্রেম প্রবঞ্চিত সাথী বেঁচে থাকার ন্যূনতম মর্যাদার অভাবে আত্মঘাতী হতে গেল। ‘রূপ নারানের কূলে জেগে ওঠা মানুষ’ জীবন তাকে দিল বেঁচে থাকার বিশ্বাস। স্ত্রীর সার্টিফিকেট। শারিরীক ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলেও জীবনের মধ্যে যে মহৎ মানবিক ভালোবাসার সন্ধান পেল সাথী— তা তার একলা চলার পথে আলো হয়ে সইল।
কিন্তু এক বুক অভিমান নিয়ে প্রিয়া এত দূরে সরে রইল যে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে প্রিয়ার সান্নিধ্য কামনা করে জীবন পেল শুধুই প্রত্যাখ্যান আর ঘৃণা।
এই গল্প নিরংকুশভাবে ধনবাদী সমাজের খণ্ডিত চিত্র। ভাবনাতেও পুরুষতন্ত্রের মহিমা জাহির হয়েছে। এই কারণেই আধুনিক চেতনাসম্পন্ন নারী ইমেজ ভেঙে ফেলা হয় শরৎভাবাদর্শ নির্মিত এলিয়ে পড়তে পারি পায়ে জাতীয় সাথীর চরিত্র সৃষ্টি করে। স্বতন্ত্রবোধসম্পন্ন প্রিয়া, লিলিকে লম্পট স্বামীত্যাগের উপদেশ দিল দুঃসময়ে দুঃস্থ নারীর পাশে এসে দাঁড়াল সেই মেয়েকে বাঙালী নারীর অসতর্ক উপমায় ডিয়টারী বানিয়ে ফেলা হয় শুধুমাত্র সমাজের কায়েমী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অজুহাতেই।
তবে এই খুঁতটুকু পুষিয়ে যায় যখন দেখি এই ছবিতে ‘ঘুঘু দেখেছ তুমি ফাঁদ দেখনি’ গানের সঙ্গে অ্যাকশন ভঙ্গীর নৃত্য যুক্ত করে ভায়োলেন্সের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কমিয়ে আনা হয়। দর্শক মন খুশি করা কাণ্ড দেখে হাসল। পরবর্তী দৃশ্যেই দেখান হলো ভিলেনের চোখের নিচে কালশিটের দাগ। নাকে রক্ত। অর্থাৎ এক চোট ধোলাই খেয়েছে। এইভাবেই রাগে ফেটে পড়ে জীবন আর প্রিয়া, শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক পাওয়া শাফায়েতের গাড়ি ভেঙে যখন চুরমার করে দেয়— একটুকুও অতিরঞ্জিত লাগে না।
বহুদিন পর আলম খানের সুরে প্রাণ ছুঁয়ে গেল। তবে সম্পাদনায় ত্রুটিগুলো নজর এড়ায়নি। যেমন, জীবনের ক্যান্সার হওয়ার সংবাদ শুনে সাথী চিৎকার করে ফোন ছেড়ে দেয়। তার আগের শটে সাথী ছিল বিছানায় বসে। সবুজের সংলাপের সঙ্গে সাথীর বসা থেকে ওঠে দাঁড়ানোর একটা আধা সেকেন্ডের শট থাকলেই জার্ক লাগতো না। প্রিয়াকে নিয়ে তার বাবার চেম্বারে প্রবেশের দৃশ্যেও কয়েকটি ফ্রেম ফেলে দেয়ার প্রয়োজন বোধ হয়েছে। বস্তি দৃশ্যটিও অবাঞ্ছিত ছিল।
গল্পটি যেহেতু নায়ক কেন্দ্রিক; সেই হেতু ইলিয়াস কাঞ্চন প্রচুর সুযোগ পেয়েছেন। নেচে, গেয়ে, কৌতুক করে দর্শকের মন ভরিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন—ঢাকাই ছবির তিনিই একমাত্র সক্ষম নায়ক। দেহ সৌষ্ঠবে চম্পা ও নিপা মোনালিসা উভয়েই লাবণ্যে ভরপুর। তবে ভালো অভিনয়ের জন্য উভয়কেই আরো অনুশীলন করতে হবে। দারুণ ভালো অভিনয় করেছেন সিরাজুল ইসলাম। যথোপযুক্ত সংলাপ মুখে পেলে তিনি যে কতখানি সক্ষম হয়ে উঠতে পরেন তার উজ্জল দৃষ্টান্ত— মঞ্জুর রাহীর সঙ্গে অফিস কক্ষের দৃশ্যটি। ছোট্ট জয়া অভিনয়ে ক্ষমতাময়ী তবে কাহিনীকারের অমনোযোগিতায় কখনো কখনো তাকে ভেপো মনে হয়েছে। বয়স্ক ভৃত্যের গায়ে হাত তোলাটাও বিরক্তজনক। পরিস্ফুটনের ত্রুটির জন্যই কিনা সন্দেহ একখানি ছবিতে আলোর সঠিক টোন বোঝা গেল না। শব্দ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করা হয়নি। বিদেশী হোটেলে লাউঞ্জে বসেও এমন চিৎকার করে কথা বলতে হয়? এফডিসির কারিগরি মান নিম্নমুখী কেন? কর্তৃপক্ষের এখনই সজাগ হওয়া দরকার।