রূপগাওয়াল: রাখালের হাতে রাজদন্ড
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে দেখে এলাম নবাগত পরিচালক হাবিবুর রহমান হাবিব এর প্রথম সিনেমা ‘রূপগাওয়াল’। তার প্রথম প্রয়াস অনুযায়ী ভাল করেছেন। ভাল মন্দ মিলিয়ে আমার আমার মতামতগুলি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে জানালাম। যাদের ধৈর্য্য কম তাদের জন্য প্রথম অংশ এবং ধৈর্য্যশীলদের জন্য পুরো লেখাটি পেশ করা হলোঃ
প্রথম অংশ
সিনেমার বিন্যাস (Film Line up):
কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ হাবিবুর রহমান হাবিব।
চরিত্র রূপায়নেঃ চম্পা, মাসুম আজিজ, সিমলা, নিলয়, আনোয়ার শাহী, সুমনা সুমি, অঞ্জলী, মহসিনা স্বাগতা, রবিন ও অন্যান্য।
গানের কথাঃ হাবিবুর রহমান হাবিব ও সংগ্রহ।
সুরঃ মৃনাল দত্ত, নূর পলাশ, আলী আকবর রূপু , ধীমান ঘোষ, রথীন মিত্র ও সংগ্রহ।
সংঙ্গীতায়জনঃ নূর পলাশ ও আলী আকবর রূপু ।
কন্ঠঃ সাবিনা ইয়াসমিন, মমতাজ, রিংকু, পারভেজ ও রাজ্জাক।
চিত্রগ্রহনঃ মজিবুল হক ভুঁইয়া।
সম্পাদনাঃ সহিদুল হক।
প্রযোজনাঃ শিকড় গল্পচিত্র।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
মুকাই নামক এক যুবকের মনে শৈশবে রাজহংসী গ্রীবাদেশের রাজকণ্যার গল্প ও ছবি প্রচন্ডভাবে ছাপ ফেলে। যখন সে বড় হয় তখন সে ঐরকম দেখতে কোন নারীকে খুঁজে বেড়ায় জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য। যেরকম স্বপ্ন প্রায় প্রতিটি যুবক দেখেন এবং তার বুকের মাঝে লালন করেন। মেয়েদের কাছাকাছি পৌছানোর জন্য মুকাই বেছে নেয় রূপচর্চার উপকরনের গাওয়ালীকে (ফেরী করা)। এভাবে মুকাই হয়ে উঠে রূপগাওয়াল। মাঠ, ঘাট প্রান্তর চষে বেড়ায় সে তার স্বপ্নের রাজকন্যাকে পাওয়ার আশায়। অবশেষে কোন এক ভাটি অঞ্চলে দেখা মেলে তার আকাঙ্খিত রাজহংসী গ্রীবাদেশের কণ্যার। তাকে কাছে পেতে যেয়ে মুকাই মুখোমুখি হয় জাবেদা নামক এক ক্ষেপাটে মেয়ের। সেই রাজহংসী গ্রীবাদেশী কণ্যা ‘রোজী’র রয়েছে পাঁচ ভাই, যাদের দুর্ধর্ষ (তাদের কার্যকলাপে আমার কাছে ভাঁড় মনে হয়ে হয়েছে) কার্যকলাপে ঐ অঞ্চলের সবাই ভয় পায়। রূপগাওয়ালকে নিয়ে রোজী ও জাবেদার প্রেমিক নিয়ে সংঘর্ষটা জমে উঠতে উঠতে জমেনি। ঠিক তেমনি মুকাই ও রোজীর ভালবাসার রসায়ন জমে উঠার আগেই রোজী মুকাইকে পরামর্শ দেয় তাকে পেতে হলে পাঁচ ভাইকে বশ করতে হবে। ফলে বিভিন্নজনের কাছে শুনে মুকাই বশের মন্ত্র শিখতে ছোটে কামরূপ কামাক্ষা (ভাবতে অবাক লাগে যাকে ঠিকমতো জানাই হলো না তাকে পাওয়ার জন্য কি অজানার পথে পা বাড়ানো কি সম্ভব ?)। নানা পথ পাড়ি দিয়ে একসময় সে পৌছে এক পাহাড়ী লোকালয়ে এবং সেটাকে মুকাই কামাক্ষা হিসেবে ধরে নেয়। ঐ পাহাড়ে কপেন নামক এক বৃদ্ধকে সে ধরে বশীকরন মন্ত্র শেখানোর জন্য। বৃন্ধ দোটানায় পড়ে। আবার তার মনে বাসনা জাগে এই আগুন্তুকের কাছে নিজ কন্যা নিরুতাকে বিয়ে দেওয়ার। সে ফন্দি করে রূপগাওয়ালকে জানায় বশের মন্ত্র শিখতে হলে রক্তের সম্পর্ক হওয়া লাগবে। ওদিকে আরেক পাহাড়ী মনেক তিনটি পাহাড়ের লোভে নিরুতাকে তার পুত্রবধু করতে চায়। কপেনের কাছের মানুষ দুলারীর সহয়োগীতা আশা করে মনেক ব্যর্থ হয়। আর নিরুপায় মুকাই বাধ্য হয়ে বিয়ে করে পাহাড়ী সুন্দরী নিরুতাকে। ভেতরে ভেতরে সে তাড়া অনুভব করে বশীকরন মন্ত্র শেখার। সে যখন কপেনকে তাড়া দেয় তখন কপেন বিপদে পড়ে যায়। এসময় উদ্ধারকারী হিসেবে আবির্ভুত হয় দুলারী। সে বুদ্ধি দেয় সন্তান নিলেই রক্তের সম্পর্ক হবে আর মুকাই যাদু শিখতে পারবে। প্রেমে অন্ধ মুকাই তাতেই রাজী হয়। একসময় সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়ে বড় হতে থাকে। আর সেময় দেখা দেয় নতুন সমস্যা। মুকাই’র সন্তান বোবা ও কালা। মুকাই বুঝতে পাবে তার বশীকরন মন্ত্র শেখা হবেনা। যখনই সে বাড়ী ফিরতে চায় তখনি কপেন নতুন কোন ফন্দি করে মুকাইকে মোহগ্রস্থ করে। একসময় মুকাই অন্ধমন বিদ্রোহ করে বসে তাই সে নিজের রক্তের চিহ্ন সন্তানকে খুন করে পালাতে চায় কিন্তু শিশুটির কান্না তার পশুপ্রবৃত্তিকে থামিয়ে দেয়। তাই সে যাদুমন্ত্রের বাটি নিয়ে ছোটে ভাটির দেশে। সেখানে যেয়ে সে আবিষ্কার করে তার স্বপ্নকন্যার বিয়ে হয়েছে আর তার কোল আলোকিত হয়ে আছে ফুটফুটে সন্তান। এই দৃশ্য মুকাই’র মনে ঝড় তোলে। সে তার নিজের সন্তানের প্রতি অন্যায় করেছে বলে অনুশোচনা হয় এবং সে ফিরে যায় পাহাড়ী। সেখানে মুকাই তার সন্তানের লাশের আন্তেষ্টিক্রিয়া দেখে সইতে না পেরে নিজেও আত্মাহুতি দেয়। আর এভাবেই নানা চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে গল্পের ইতি টানা হয়েছে।
শক্তিমত্তাঃ মৌলিক কাহিনী ও গান।
দুর্বলতাঃ দুর্বল চিত্রগ্রহন, অভিনয়, শিল্প নির্দেশনা, আলোক সম্পাত ও নির্মান।
………………………………………………………………………………..
দ্বিতীয় অংশ
সংলাপঃ
এখানে বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ভাষা ও অসমিয়া ভাষা ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। নন্দনতত্তের বিচারে এটা ঠিক থাকলেও সাধারন দর্শক অপভ্রংশের অসমিয়া ভাষাকে গ্রহন করতে পারেননি। ফলে পাহাড়ী অংশের অনেক সুন্দর সংলাপও সাধারন দর্শককে নাড়া দিতে পারেনি। ভাটি অঞ্চলের সংলাপগুলি দর্শককে আনন্দ দিয়েছে।
চিত্রনাট্যঃ
ভাটি অঞ্চলের অংশে একটি দৃশ্যের সাথে অপর দৃশ্যের লিংক মিস ছিল যা পাহাড়ী অংশে তুলনামূলকভাবে কম ছিল। পাহাড়ী অংশে নানা-নাতির গান আরোপিত মনে হয়েছে। কাহিনীর বিবেকরূপী ভিক্ষুকের গানটি (আমার সরল মনের শক্ত ধাঁধাঁ …) গাইতে গাইতে ভিক্ষুকদ্বয়ের পাহাড় ও সমতলে আসা যাওয়া দৃষ্টিকটু লেগেছে। তথাপি অসংখ্য বিষয়ের অবতারনা করে তা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে যে গতির প্রয়োজন ছিল তা মোটামুটি ভাবে ছিল।
অভিনয়ঃ
নতুন হিসেবে নিলয় ও অঞ্জলী যথেষ্ট ভাল করেছেন। তবে মুকাই এর মতো এত গভীর এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভার নিলয় পুরোপুরি বইতে পারেননি। চম্পা গতানুগতিক অভিনয় করেছেন। তবে তার কাছ থেকে আরো বেশী কিছু আশা করেছিলাম। অনেক জায়গায় তিনি চরিত্রের ভেতরে ঢোকতে ব্যর্থ হয়েছেন। মাসুম আজিজ ভাল করার চেষ্টা করেছেন, তবে তার ডায়ালগ ডেলিভারীতে প্রচন্ড সমস্যা ছিল। অধিকাংশ যায়গায় তার সংলাপ দুর্বোধ্য লেগেছে। আনোয়ার শাহী মোটামোটি সাবলীল ছিলেন। অন্যরা হিসেবের বাইরে রইলেন।
গানঃ
এক কথায় অসাধারন। দীর্ঘদিন পর কোন সিনেমার গান শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। তবে “আমার বুড়ো বয়সে ধরলো বুঝি ..” এবং “মইলাম..মইলাম দাসী…রে..” গান দুটি পূর্ণাঙ্গ দেখতে পেলে ভাল লাগত। প্রায় প্রতিটি গানই হৃদয় ছোঁয়ে গেছে। তবে গানের চিত্রায়নে হতাশ হয়েছি।
শিল্প নির্দেশনাঃ
পয়সা বাঁচাতে গিয়ে আমাদের পরিচালক ও প্রযোজকেরা যে কতবড় ভুল করছেন তা এই সিনেমা দেখে আবারও উপলব্ধি হলো। কিশোর মুকাই রাজহংসী গ্রীবাদেশের রাজকণ্যার যে ছবি আগলে রাখছিল, তা বড় হয়ে হাঁতে আঁকা ছবি হয়ে গেল ! আবার দেখা গেল মুকাই ও নিরুতার বিয়ে হচ্ছে কোন পুরোহিত ছাড়াই। আমি আজ পর্যন্ত কোন পাহাড়ীকে প্লাস্টিকের বাটের ছুরি ব্যবহার করতে দেখিনি অথচ এখানে দেখলাম পাহাড়ে কাহিনীর একপর্যায়ে নায়ক তার সন্তানকে প্লাস্টিকের বাটের ছুরি নিয়ে খুন করতে উদ্যত হচ্ছে। কাহিনীর কোথাও দেখানো হয়নি যে মুকাই কোন ঝোলা নিয়ে পাহাড়ে ঢোকে, তাহলে শিল্প নির্দেশক হয়তো সাফাই গাইতে পারতেন নায়ক তার ঝোলায় করে সমতল থেকে প্লাস্টিকের বাটের ছুরি নিয়ে এসেছেন। অন্যান্য ত্রুটিগুলির কথা নাই বা লিখলাম।
পোষাক, অঙ্গসজ্জা ও মেকাপঃ
পোষাক, অঙ্গসজ্জা ও মেকাপ এর দৈন্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে। গাঁয়ের অর্ধশিক্ষিত যুবক মুকাই এর দামী প্যান্ট ও শার্ট পরিধান দৃষ্টিকটু লেগেছে। পাহাড়ী দুলারী (চম্পা) যে কড়কড়ে আয়রন করা কাপড় পড়েছেন বা অন্যরা যে সেলাই করা কাপড় পড়েছেন তা রীতিমতো ধাক্কা দিয়েছে। সম্মানিত পরিচালক বা শিল্পনির্দেশক পাহাড়ীদের অঙ্গসজ্জায় যেসকল প্রপস (প্রপার্টিজ) ব্যবহার করেছেন তা সমতলে ঠিক থাকলেও পাহাড়ীদের ক্ষেত্রে তা কতটুক যৌক্তিক ?
চিত্রগ্রহনঃ
একটি অসাধারন গল্পের খুবই দুর্বল চিত্রায়ন দেখতে পেলাম। পুরো সিনেমাটি অসংখ্য ভুল ও অপ্রয়োজনীয় শটের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। বেশ কয়েক জায়গায় সিনেমাটোগ্রাফী/ফোটোগ্রাফীর মৌলিক নিয়ম (Basic Rules) ভঙ্গ হয়েছে, যেমন – ৩০◦ রুলস (30 Degree Rules ), ১৮০◦ রুলস (180 Degree Rules ), রোল অব থার্ড (Rule of Third) যা নতুন পরিচালকের দৃষ্টি এড়ালেও চিত্রগ্রাহকের সংশোধন করা উচিৎ। চিত্রগ্রাহক মজিবুল হক ভুইয়াঁ এখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। কোন কালে কে দেখেছেন ভেলা না বাইলেও তা উজানের দিকে ধাবিত হয় ? আবার কিছু কিছু জায়গায় পুরো শট বা সিকোয়েন্স ঝলসে গেছে! এর দায় আমি দেব চিত্রগ্রাহককে কারন তিনি হোয়াইট ব্যালান্স (White Balance) করেননি এবং লাইট মিটার বা কালার মিটার ব্যবহার করেননি। নতুন পরিচালকদের প্রতি অনুরোধ দয়া করে অযোগ্য চিত্রগ্রাহকদের পরিহার করুন।
আলোকসম্পাতঃ
পরিচালক চেষ্টা করেছেন সুন্দর আলোকসম্পাত দেখাতে। কিন্তু লাইটম্যান বা শিল্পনির্দেশক বা চিত্রগ্রাহকের অজ্ঞানতা বা অবহেলায় সেটা ব্যর্থ হয়েছে। যে বাড়িতে কুপি জ্বলে, সেখানে চাঁদের আলোর চেয়ে ঘরের বা বারান্দার আলো কি করে বেশী হয়? কিংবা জাবেদার রাতের আধারে স্কুলে আসার দৃশ্যে টর্চ লাইটের আলো কৃত্রিম লাইটে কারনে ক্ষীন হয়ে আসাটা কি ভাল দেখিয়েছে ? সোর্স লাইট (Source Light) ব্যপারটি কি কারোর মাথাতেই আসেনি ? ।
সম্পদনাঃ
চিত্রায়নের অনেক ভুল সম্পাদনা টেবিলে সংশোধন করে নেয়া যায়। কিছু সম্পাদক মহাশয় দায়সারা ভাবে সম্পাদনা করেছেন ফলে আমরা এখন পরিচালকের দিকে আঙ্গুল তোলতে পারছি। টাইটেল এবং ক্রেডিটসটাও অবহেলায় তৈরী হয়েছে।
পোষ্ট প্রডাকশনঃ
আফটার ইফেক্টস ও কালার কারেকশন ঠিক ছিলনা। ফলে বহু জায়গায় ছবি জ্বলে গেছে বা ঝাপসা ও বহু বর্ণের ছড়াছড়ি দেখা গেছে।
পরিচালনাঃ
পরিচালক আমাদের অনেক সুন্দর সুন্দর লোকেশন দেখিয়েছেন। কিন্তু যেহেতু তিনি হচ্চেন মাথা তাই স্বাভাবিক ভাবেই অন্যের ভুলের দায়ও তাঁকে নিতে হবে। অবাক লেগেছে সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রায় ২০ জনের নাম দেখে! আশা করি পরিচালক মহোদয় এতদিনে বুঝেছেন যে, যুদ্ধের ময়দানে ২০টি খরগোশের চেয়ে ১টি ক্ষিপ্র ঘোড়া বেশী জরুরী। যাহোক, পুরো সিনেমাতে তার সুন্দর কিছু করার চেষ্টা দেখা গেলেও আনাড়ী হাতের ছোঁয়া বড় প্রকট লেগেছে।
পরিশিষ্টঃ
সর্বোপরী বলা যায় “রূপগাওয়াল” ছিল এই অস্থির সময়ে একটি সুন্দর প্রয়াস যা অদক্ষতার কারনে ভেস্তে গেছে। হল থেকে বের হয়ে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছে – ‘রাখালের হাতে রাজদন্ড তোলে দিলেই সে যেমন রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে ভড়কে যায় ঠিক তেমনি রূপগাওয়াল ক্রু’রা অসাধারন এই গল্পের ভার বইতে পারেননি।’
দেওয়ান মাহবুবুল আলম
১৯ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ইং।