Select Page

লিডার আমিই বাংলাদেশ : গতানুগতিক আবহে অন্য এক গল্প

লিডার আমিই বাংলাদেশ : গতানুগতিক আবহে অন্য এক গল্প

২০২৩ সালের ঈদ-উল-ফিতরে বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়ার প্রযোজনায় ও তপু খানের নির্দেশনায় নির্মিত পলিটিক্যাল-অ্যাকশন জনরার সিনেমা ‘লিডার – আমিই বাংলাদেশ’।

ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শোতে আমাদের হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ‘মনিহার’ সিনেমা হলে এক বন্ধুকে নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’।

বিস্তারিত রিভিউ লিখেছি তাই অনেক বড়সড় লেখা হয়ে যাবে রচনার মতো। সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

হালকা স্পয়লার

সিনেমা নিয়ে কথা বলা যাক, আমরা বরাবর শাকিব খানকে যেরকম গল্পে দেখে থাকি এই সিনেমার গল্প সেসব সিনেমার গল্প থেকে অনেকটা আলাদা। যদিও সিনেমার গল্প বলার ধরন গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমার মতোই কিন্তু তার পরেও এই সিনেমাটা শাকিব খানের ক্যারিয়ারের জন্য বর্তমান সময়ে একটা টার্নিং পয়েন্ট। অনেক লম্বা সময় পর এরকম একটা সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মধ্যে ব্যাক করাটা ভালো সিদ্ধান্ত।

সিনেমার গল্প একজন তরুণকে নিয়ে, যে চরিত্রে অভিনয় করেছে শাকিব খান। সে একটা ছোটখাটো ক্যাফের মালিক। শাকিব খান তার তার আশপাশে যেকোনো সমস্যা কিংবা অসঙ্গতি দেখলে সেই সমস্যা সমাধান করার জন্য এগিয়ে আসে এবং অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। তো সে কীভাবে তার আশপাশের মানুষদের মন জয় করে একসময় পুরো দেশের মানুষদের একজন হয়ে যায় এবং কীভাবে সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়ে সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সেই গল্প নিয়েই মূলত সিনেমা এগোতে থাকে।

প্রথমেই সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কথা বলা দরকার। সিনেমায় অভিনয় করেছে শাকিব খান, বুবলি, মিশা সওদাগর, শহীদুজ্জামান সেলিম, সুব্রত, মাসুম বাশার, মিলি বাশার সহ আরও অনেকে।

প্রথমেই যদি শাকিব খানকে নিয়ে কথা বলি তাহলে আমি বলবো প্রথম হাফে তার অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করতে পারেননি; উল্টো প্রথম হাফে দর্শক অনেকটা বিরক্ত হয়েছে কিছু কিছু জায়গায়। তবে হ্যাঁ, সেকেন্ড হাফে গিয়ে শাকিব খান সারপ্রাইজড করেছে। অভিনয় বেশ সাবলীল লেগেছে। ডায়লগ ডেলিভারিও যথেষ্ট ভালো ছিলো কিন্তু প্রথম হাফে তার ডায়লগ ডেলিভারি বিরক্তিকর ছিলো। তবে ওভারঅল ভালোই লেগেছে। সেকেন্ড হাফে গিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে শাকিব খান।

বুবলির অভিনয় সত্যি বলতে খুবই বাজে ছিলো এখানে। প্রত্যেকটা দৃশ্যে বাজে লেগেছে। সব থেকে বেশী বিরক্তিকর ছিলো তার ড্রেসআপ। বুবলির ড্রেস ডিজাইন যে করেছে সে বোধহয় আন্দাজের উপরে কোনো ড্রেস সেন্স না নিয়েই করে ফেলেছে। বুবলির অভিনয় আমাকে পুরোপুরি হতাশ করেছে।

মিশা সওদাগর নেগেটিভ চরিত্রে বরাবরের মতোই ভালো করেছে। এন্ট্রি প্রথম দিকে হলেও তার সাথে শাকিবের মূল কনফ্লিক্ট শুরু হয় সেকেন্ড হাফে। মিশা সওদাগর সেকেন্ড হাফে যখন থেকে দৃশ্যে আসা শুরু করে তখন থেকেই সিনেমা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়।

শহীদুজ্জামান সেলিম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর চরিত্রে ভালো করেছে। ঠান্ডা মাথার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরিত্রে তাকে বেশ মানিয়েছে। অন্যদিকে শাকিবের মা-বাবার চরিত্রে মাসুম বাশার এবং মিলি বাশার বেস্ট চয়েজ ছিলো আমার মতে।

সিনেমায় অন্যান্য যারা আছে তাদের মধ্যে কয়েকজন ভালো করেছে আবার কয়েকজন খুবই বাজে করেছে। আলাদা আলাদা করে আর বললাম না কারণ তাহলে রিভিউ আরও বড় হয়ে যাবে।

এবার আসি সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ নিয়ে, সিনেমার গল্পে যে নতুনত্ব আছে তা কিন্তু না। এমন গল্পে আমাদের পাশের দেশ ভারতের নানান ইন্ডাস্ট্রিতে সিনেমা তৈরি হয়েছে৷ তবে আমাদের দেশে এই ধরনের গল্প নিয়ে তেমন একটা কাজ হয় না, তাই এই গল্পকে আমি পজিটিভ হিসেবেই নিবো। লুতুপুতু প্রেম আর অহেতুক অ্যাকশন দৃশ্য থেকে বের হয়ে যে নতুন গল্প দিয়ে কিছু ট্রাই করেছে সেই প্রচেষ্টাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো।

দেলোয়ার হোসেন দিল এই সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লিখেছেন। চিত্রনাট্যে তার সঙ্গে তপু খানও জড়িত ছিলো। প্রথম হাফের চিত্রনাট্য খুবই এভারেজ ছিলো কিন্তু দ্বিতীয় হাফে উল্টো। প্রথম হাফে দুয়েকটা দৃশ্য ছাড়া তেমন ভালো কিছু ছিলো না, এমনকি এ অংশে সংলাপও বেশ ক্রিঞ্জি ছিলো। বিশেষ করে শাকিব খান যখন মানুষদের জ্ঞান দেয় সেই ডায়ালগগুলো। তবে দ্বিতীয় হাফে গিয়ে চিত্রনাট্য এবং ডায়লগ ; এই দুই জায়গাশ ভালো হতে শুরু করে। প্রথম হাফের শেষে যখন ফুল বিক্রি করা মেয়েটা মারা যায় তারপর বিরতি ; মূলত বিরতির পর থেকেই সিনেমাটা দর্শকদের টানতে শুরু করে।

এবার আসা যাক সিনেমার টেকনিক্যাল দিকে, সিনেমাটোগ্রাফার ফরহাদ হোসেন ভালোই কাজ করেছে। কিছু কিছু শট আসলেই ভালো ছিলো। এই ধরণের বাণিজ্যিক সিনেমায় যেমন সিনেমাটোগ্রাফি হওয়া দরকার ঠিক তেমনটাই করা হয়েছে।

সিনেমার সবচেয়ে বড় পজিটিভ দিক ছিলো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। সত্যি বলতে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বাপ্পা মজুমদার এই সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছে। আমি তার কাজে মুগ্ধ একইসঙ্গে অবাক হয়েছি৷ আবহ সঙ্গীতের জন্য বাপ্পা মজুমদার প্রশংসার দাবীদার।

গানগুলোও ভালো ছিলো, নাভেদ পারভেজ, বাপ্পা মজুমদার এবং শুভ্র রাহার মিউজিকে গানগুলো শুনতে ভালোই লেগেছে। বিশেষ করে তাবিব মাহমুদের গাওয়া ‘কথা আছে’ গানটা আসলেই ভালো ছিলো। অন্যদিকে সুরমা সুরমা গানটা আমার ইউটিউবে শুনে ভালো না লাগলেও সিনেমাহলে শুনে ভালো লেগেছে। আর হ্যাঁ, এন্ডিং এ যে গানটা দেয় সেটাও ভালো ছিলো। আবহ সংগীত এবং গানের জন্য ফুল মার্কস পাবে।

হাবিব রহমানের নৃত্য পরিচালনা ভালো ছিলো। ‘কথা আছে’ গানের সোয়াগ এবং ‘সুরমা সুরমা’ গানের রোমান্টিসিজম দেখতে ভালো লেগেছে।

মোহাম্মদ আরমানের অ্যাকশন খুব একটা ভালো ছিলো না৷ অ্যাকশনের এক দুটো জাশগা দেখতে কিছুটা ভালো লাগলেও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ২০২৩ সালে এসে এখন আর কেউ এমন পুরনো স্টাইলের অ্যাকশনে মজা পাবে না।

এবার সিনেমার নির্মাণ নিয়ে কথা বলা দরকার। তপু খান টেলিভিশনের একজন নিয়মিত নির্মাতা। আমি তার কয়েকটা কাজ দেখেছি, সেই কাজগুলো আমার কাছে ভালোই লেগেছিলো। তপু খানের টেলিভিশনের কাজগুলো দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তার মেকিং সেন্স ভালো। আমার মতে টেলিভিশনে কাজ করে সে যতটা জ্ঞান অর্জন করেছে, সিনেমায় সেই জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ করতে পেরেছেন। যদিও সিনেমার দু’তিনটা জায়গায় শট কন্টিনিউটিতে বেশ বড়সড় ভুল ছিলো, যেগুলো চোখে লেগেছে। এমনকি কয়েকটা দৃশ্যে ভালোভাবে এক্সিকিউট করতে পারেননি যেটা অনেকটা দূর্বল লেগেছে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে বললে তপু খান এই সিনেমা নির্মাণে পাশ মার্ক পেয়েছেন । যেহেতু প্রথম সিনেমা তাই ভুলত্রুটি কিছু ছিলো তবে সামনে আশা করি এই ভুলত্রুটিগুলো উতরে উঠবেন।

সম্পাদনা নিয়েও দুয়েকটা কথা বলতে হয়, সিনেমার এডিটিং ভালো তবে শার্প বলাটা ঠিক হবে না। কিছু কিছু দৃশ্য চোখে লেগেছে যেটা অবশ্যই সম্পাদনার একটা দূর্বল দিক।

পরিশেষে বলতে চাই ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ এই সময়ের ভালো এক প্রচেষ্টা। যদিও অনেক দূর্বল দিক রয়েছে তবে একটা বিষয় ভেবে ভালো লেগেছে যে আমরা লুতুপুতু প্রেমটেম কিংবা থ্রিলারের নামে সস্তা সাসপেন্সের বাইরে গিয়ে ভালো গল্প নির্মাণের চেষ্টা করছি। শাকিব খানকেও সাধুবাদ দিবো এমন স্ক্রিপ্টে কাজ করার জন্য।

যায়হোক, রিভিউ আর বড় করতে চাচ্ছি না। রিভিউর শেষে একটা কথায় বলতে চাই, অনেক দিন পর সিনেমাহলে পরিপূর্ণ দর্শক দেখলাম। তার সাথে প্রত্যেকটা পাঞ্চলাইনে দর্শকদের হুল্লোড় অ্যাকশনে লাফালাফি ইমোশনাল দৃশ্যে স্তব্ধতা সত্যিই অনেক দিন পরে দেখলাম। আসলে সিনেমা হলের সৌন্দর্য এসবেই কিন্তু ঈদ ছাড়া এখন আর এই ফিলটা নেওয়া সম্ভব হয় না। আশা করি শুধু ঈদ না, অন্যান্য সময়েও রিলিজ হওয়া সিনেমা নিয়ে সিনেমাহলে এমনই হুল্লোড়, আনন্দ উপভোগ করা হবে। দর্শক আবার ফিরে আসুক সিনেমাহলে।

ঈদের সবগুলো সিনেমা দেখারই ইচ্ছে আছে। আশা করি ধীরে ধীরে সবগুলো দেখার সৌভাগ্য হবে এবং আপনাদের সেগুলো নিয়ে রিভিউ জানাতে পারবো। সবাই ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ, আপনারা কোন সিনেমাটি এই ঈদে দেখেছেন বা দেখবেন তা কিন্তু কমেন্টে জানিয়ে দিবেন।


Leave a reply