লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন: এক যুগ পর ফারুকীকে আবিষ্কারে আগ্রহ
১ যুগ, হ্যাঁ ১২ বছর পূর্বে নিউমার্কেটস্থ বলাকা হল থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাকি জীবনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত কোনো ভিজুয়াল কনটেন্ট (বিজ্ঞাপন-প্রকল্প বাদে) দেখায় সময় বিনিয়োগ করবো না। কেন নিয়েছিলাম এমন কঠোর সিদ্ধান্ত সে গল্প পরে, ১২ বছরের ব্যবধানে ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ ওয়েব সিরিজ দেখাসূত্রে কেন ও কীভাবে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা;
গল্প হওয়া উচিত এটাই।
৩ দিন যাবৎ জ্বর, গলাব্যথা। চিরায়ত বাংলাদেশে উপসর্গগুলো জ্বলজ্যান্ত কী-ওয়ার্ড হয়ে উঠেছে শেষ দেড় বছরে। মাত্র ৩ মাস আগে ৪২ দিন ভুগলাম, আবারো কি কী-ওয়ার্ডবাজির বলি হলাম, শংকায় ছিলাম। কার্যত শেষ ৩ দিন অলস, অচল, অপাঙক্তেয় মানুষের চরিত্র বরাদ্দ পেয়েছি যেখানে ফুসফুসের ব্যায়াম, লবণ পানি দিয়ে গার্গল করা আর বিরতি দিয়ে ওষুধ সেবনের বাইরে কন্ট্রিবিউটিং কাজ নেই। যে কোনো শারীরিক অসুস্থতা আমাকে বিক্ষুব্ধ করে, ভর করে রাজ্যের বৈকল্য। মানুষ সচলভাবে কর্ম তৎপর থাকবে, না পোষালে ফুড়ুৎ উড়াল দেবে— অসুস্থ কেন হবে; এটা অভিশাপ!
কিন্তু এও তো অনিবার্য শরীর মানেই রোগ-শোক-কাম-ক্রোধ-মোহ এর আধার।
এরকম বৈকল্যপূর্ণ দশায় গতকাল (৯ জুলাই) বিকেলের দিকে ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ সিরিজের সম্বন্ধে জানি। সময়ব্যাংক যেখানে নির্বিচারে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, ঘটছে সময়জনিত পুকুরচুরি, সেখানে একটা ওয়েব সিরিজ যদি ৩-৪ ঘন্টা নিয়েও যায় সেটাকে অনুদান বা চ্যারিটি ভেবেও স্বস্তি পাওয়া যাবে খানিকটা, হলোই বা তার ডিরেক্টর ফারুকী!
***
বই, ফিল্ম বা যে কোনো কনটেন্ট নিয়ে লেখাকালীন সচেতনভাবেই আমার টার্গেট অডিয়েন্স সাধারণ দর্শক বা অন্য কেউ নয়, কনটেন্ট ক্রিয়েটর স্বয়ং, আমি চাই সম্পূর্ণ ভিন্ন বা বিপরীত স্কুল অব থটের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় কনটেন্ট ক্রিয়েটর নৈকট্য-দূরত্ব দুটোই উপভোগ করুক। গণমুখী নয়, চিরকালই সিলেক্টিভ ছিলাম, তাই চানাচুর নয় সাবমেরিন বেচার নীতিতে বাঁচতে চেয়েছি।
কর্মক্ষেত্র, চিন্তাক্ষেত্র, সামাজিকতা, এমনকি বই লেখালিখি সর্বত্র সিলেক্টিভিটি ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকি প্রাণপণ।
টার্গেট শ্রেণি নীতিতে সাংঘর্ষিক বলেই ক্রিস্টোফার নোলান বা অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমা নিয়ে লিখি না, বা লিখতে ইচ্ছা করে না ওরহান পামুক বা অরুন্ধতী রায়ের বই নিয়ে। লেখাটা কি কোনোদিন তার দৃষ্টিগোচর হবে, বা হলেও বাংলা বুঝবে? ইংরেজিতে লিখলে সম্ভাবনা থাকে কিছুটা, কিন্তু কোন মিডিয়ামে সে/তারা সক্রিয় জানা না থাকায় লেখার এনার্জি পাই না। আমার একাউন্টের মূল্যবান সময় তার পেছনে কেন উড়াবো?
কিন্তু বাংলা কনটেন্টের ক্ষেত্রে সেই সংশয় কম। অনলাইনে সক্রিয় হওয়াতে যেকোনো ভাবেই হোক কনটেন্ট ক্রিয়েটর জেনে যায় তার কনটেন্টের পেছনে কে বা কারা সময় নামের অর্থ লগ্নি করেছে। ব্যবসায়িক কারণে কারো কারো লেখা তারা প্রমোট করে, একই পয়েন্টেই কেউ দাঁড়ায় উপেক্ষার সারিতে! এটাই হওয়া উচিত। আমার টার্গেট থাকে কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে পার্সেল পাঠানো, সেটা সে ঘরে সাজিয়ে রাখলো নাকি ছুঁড়ে দিল ডাস্টবিনে ধর্তব্য নহে!
এমনকি ১২ বছর পূর্বে ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ নামের যে ফিল্ম দেখা শেষে ঘোষণা দিয়ে ফারুকীর প্রজেক্টে বিনিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম— মধ্যবর্তী সময়ে তার অন্য প্রজেক্টগুলো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যত মতামতই প্রকাশিত হোক, ১ সেকেন্ডের জন্যও সেখানে অংশ নিইনি— সেই ফিল্মটা নিয়েও সামহোয়ারইন ব্লগে দীর্ঘ আলোচনা লিখেছিলাম ভালো লাগা-অভালো লাগা কিংবা অন্যান্য বিষয়ে। সম্ভবত তৎকালীন অনলাইনে প্রকাশিত আলোচনাগুলোর মধ্যে সেটা ছিল সর্বাধিক শেয়ারকৃত।
(***)
গতকাল যুগপৎ দুটো চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটেছে- ১. কভিড টেস্টে নেগেটিভ এসেছে ২. এক যুগ বিরতি দিয়ে ফারুকীর মনোজগতের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ দেখার পর প্রথম কৌতূহল তৈরি হয়, এটার স্ক্রিপ্ট রাইটার কে? কৌতূহল মেটাতে ঝাঁপ দিই গুগলে।
প্রথম লিংকটাই আসে, ফারুকী তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে নাকি স্ট্যাটাস দিয়ে দর্শকদের অনুরোধ করেছেন ফ্রিতে না দেখে ৬০টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করে বিজ্ঞাপনবিহীন অবস্থায় সিরিজটি উপভোগ করতে।
ফ্রি কালচার মানুষের রুচিবোধ নষ্ট করে দেয়, ভ্যালু সম্বন্ধে ধারণার ভারসাম্যহানি ঘটায়। বরং এমনিতে দাম ৭০০০, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতার কারণে ১০০% ডিসকাউন্ট দিচ্ছি সম্পর্কে বিনিয়োগস্বরূপ— এ ধরনের এপ্রোচ উভয়পক্ষকেই নিজেদের অবস্থান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ব্যাপারে চিন্তাশীল বানায়।
যেহেতু স্ট্যাটাসটি দেখা হয়নি পূর্বে এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কায়দা-কানুন সম্বন্ধে ধারণা অতি সামান্য, ভুলবশত ফ্রি তে দেখে ফেলেছি।
কিন্তু
ভুল মানে ভুলই, নো এক্সকিউজ।
তাই ভুলমোচন প্রকল্প হিসেবে অনুর্ধ্ব ২৯ বয়সী ১১ জন বাংলাদেশির প্রত্যেককে ৬১টাকা বিকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যারা ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ দেখতে আগ্রহী।
তবে একটা জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট- দেখা শেষে ৭টি বাক্যযোগে হলেও প্রতিক্রিয়া আমাকে whatsapp এ পাঠাবেন (কমিটমেন্ট ভঙ্গে মামলা-মোকাদ্দমা করা হবে না)।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাটসম্যান লিটন দাস প্রতিবার ৫৩+ রানের ইনিংস খেললে চেনা-অচেনা লোকজন যে পরিমাণ উপহার পায় কিংবা শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তির ব্যতিক্রমী নাম রাখার কারণে যত টাকার বই উপহার দেয়া হয়েছে অদ্যাবধি সে তুলনায় একটা ৮ পর্বের ওয়েব সিরিজের জন্য ৬৭১ টাকা (১১*৬১) নিতান্তই উপেক্ষণীয়।
কোয়ালিটি এবং ব্যতিক্রমীতাকে প্রমোট করাটা যে কোনো মননশীল মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত।
অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় পাওয়া গেল ফারুকীর একটি সাক্ষাৎকার। ৩টি পয়েন্ট তাৎপর্যপূর্ণ:
১. তিনি ডায়েরি লিখেন না সিনেমাই তার ডায়েরি
২. ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’কে তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজ বানাতে চান, সে ভাবনা থেকেই নামটি রাখা। একই নাম, ভিন্ন স্টোরিলাইনে একাধিক সিরিজ বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
৩. তিনি নর-নারীর সম্পর্কের গল্প বলতে চান, যে সম্পর্কে কেবল রোমান্টিকতা নয়; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বহু আঙ্গিক থাকে।
শেষ পয়েন্টটি বিশেষ্যতার দাবি রাখে। পৃথিবীর প্রতিটি গল্পই কোনো না কোনোভাবে নর-নারীরই গল্প; প্রকৃতি, নির্জীব, শিশু বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি গল্পও শেষতক নর বা নারী বৈশিষ্ট্যে সমপাতিত হয়।
অনুসন্ধানপ্রক্রিয়ায় আরো পাই গোটাকতেক ফিচার এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া। পত্রিকার ফিচার মূলত প্রমোশনাল টুলস হিসেবেই ব্যবহৃত হয় বিশ্বব্যাপী, এগুলো আমলে নেয়ার অযোগ্য। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার শব্দসংখ্যা ৫০০ অতিক্রম করে গেলে, আমি মনে করি সেটা নিছক পাঠক বা দর্শক প্রতিক্রিয়া থাকে না, যিনি লিখেন তিনি নিজেও একজন লেখক বা সমালোচক মননের অধিকারী হয়ে উঠেন।
২-৩টা রিভিউ যা পেলাম অনলাইনে, মেরিটমান হতাশাজনক। পুরুষতন্ত্রকে ফারুকী বিরাট ঝাঁকি দিয়েছেন, ফারুকী খুব দুঃসাহসী কাজ করেছেন, অদম্য নারীকে দেখিয়েছেন— চিরাচরিত মুখস্থ টেম্পলেট, যেখানে কয়েকটা শব্দ পরিমার্জনাপূর্বক যে কোনো কনটেন্টেই ফিটযোগ্য করা যায়। গুগলে ফ্রি-ওয়েবসাইট তৈরির মতো, ফ্রেমওয়ার্ক বানানোই থাকে; কেবল ডোমেইন আর হোস্টিং কিনতে হবে।
প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম যেহেতু স্বতন্ত্র, প্রতিক্রিয়াগুলোও স্বতন্ত্র হওয়া উচিত, রেডিমেড ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে দায় সারাটা অনৈতিক ঠেকে। তবে অনৈতিক সঠিক শব্দচয়ন কিনা নিশ্চিত নই, বরং এটা ‘lack of capability/capacity due to insufficient observant and inquisitive instinct’ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক বাস্তবসম্মত।
অগরবগরে খরচ হলো বহু শব্দ, এবার চলুন মূল প্রসঙ্গে ঢুকি। তার পূর্বে বন্ধনীতে বিজ্ঞাপন বিরতি:
[লেখাটা ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’-এর মূল্যায়ন যতখানি তার চাইতে বেশি মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর সঙ্গে লেখকের অদৃশ্য মানসিক জার্নি, বিচ্যুতি, পুনঃসংযোগ এর পশ্চাৎপট। কিন্তু লেখাটা যেহেতু ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হচ্ছে একটা পাদটীকা যুক্ত হলোই না হয়]
***
একটা কমার্শিয়াল কনটেন্ট তৈরির পূর্বে ক্রিয়েটর টিমের দলপতি কাদের প্রাধান্য দেন বা দিতে বাধ্য হন; যারা তার কনটেন্টের অভ্যন্তরীণ লেয়ারগুলোর এন্টারপ্রেটেশন তৈরি করবে, নাকি যারা তার কনটেন্টটি বিনাপ্রশ্নে কনজিউম করবে, এবং সমগোত্রীয়দের উদ্বুদ্ধ করবে অনুসরণে?
এটা একটা জটিল মোরাল ডিলেমা।
ক্রিয়েটিভ সত্তা বলে প্রথম শ্রেণি, কমার্স বলে দ্বিতীয় শ্রেণি। অনেকটা ‘বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক না, ভিতর বলে দূরে থাকুক বাহির বলে আসুক না’ গানের মতো অবস্থা।
ফারুকীর সুবিধা হলো বিজ্ঞাপন নির্মাণে দীর্ঘদিন ধরে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে আসছেন। ১৫-২০-৩০ বা ৫০ সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে কানেক্ট করা, হিউমার রাখা, এবং প্রোডাক্ট/ব্রান্ড পজিশনিং/প্লেসমেন্ট— প্রতিটি শব্দ যেখানে ভগ্নাংশ সেকেন্ডের হিসেবে তৈরি। বিজ্ঞাপনের স্কুলিংটা আগেই ছিল তার। মাঝখানে নাটক-সিনেমা নির্মাণকালীন অসংখ্য ফিডব্যাক, সময়ের পরিক্রমায় পরিমিতি এবং পরিণতি বোধের পক্বতা সম্ভবত তার স্টোরিটেলিং, ক্যারেক্টারাইজেশন, প্লট প্রভৃতি দর্শনে প্রভূত পরিবর্তন এনেছে। এটাও এক ধরনের স্কুলিংই!
প্রশ্ন তখন শিফট হয় অন্য দিকে।
ওয়েব সিরিজ ধারাবাহিক নাটক, নাকি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা যা খণ্ডাকারে প্রদর্শিত, নাকি এটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বিশেষায়িত কিছু?
ক্যামেরাগ্রাফি, স্টোরিটেলিং, ভাষা, এমনকি অভিনয়রীতিতেও বিস্তর পার্থক্য নাটক আর সিনেমায়। ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’কে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আপলোড করলে এগুলো কি নাটক থেকে ওয়েব সিরিজের মর্যাদা পাবে, কিংবা ফারুকীরই ‘ব্যাচেলর’ সিনেমাকে পর্বাকারে সাজিয়ে দিলে সিনেমা থেকে পরিচয় পালটে হবে ওয়েব সিরিজ? যেহেতু ফিল্ম লাইনের লোক নই, তাই ভীষণ সিলি প্রশ্নগুলোকেও সিরিয়াস মনে হচ্ছে।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ দেখা শেষে তাৎক্ষণিক উৎসারিত অনুসন্ধান ছিল ২টি:
১. ফারুকী কি গল্পচয়নের ক্ষেত্রে আনিসুল হক বা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বলয় তথা খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছেন? নাকি এতরকম লেয়ারসমৃদ্ধ চরিত্র নির্মাণের ক্ষমতা তারা অর্জন করেছেন, যদিও সম্ভাবনা অতীব ক্ষীণ।
২. ফারুকী কি তার ক্রিয়েটিভ টিম বদলে ফেলেছেন, সেখানে যুক্ত হয়েছে ফ্রেশ ব্ল্যাড? ১২ বছর অনেক দীর্ঘ সময়, কতটা দীর্ঘ বোঝার জন্য নিজের ভাগনিকে পাই সামনে; সেদিনের নবজাতক এ বছরের এপ্রিলে উচ্চতায় ছাড়িয়ে গেছে আমাকে। কিংবা ২৩ বছরের উড়নচণ্ডী তরুণ ৩৫-এ মাঝবয়েসী নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে সংঘাত আর সমঝোতার সুপ্তবিদ্যার অনুশীলনে নিজেও কি বড়ো হয়ে গেল মানসিকভাবে?
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’-এর এন্টারপ্রেটেশন তৈরির ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক জিজ্ঞাসাকে প্রাধান্য দিতে হয়েছে।
জিজ্ঞাসা১- কনসেন্ট শব্দটা কি যৌনতার জন্যই নিবেদিত এবং নির্ণায়ক হয়ে গেল? আপনি একজন মানুষের অধিকার হরণ করলে হয় জুলুম, কাউকে কম বেতন দিলে হয় শোষণ, অফিস সূচির বাইরে ওভারটাইম করালে অপেশাদারিত্ব; প্রতিটি জায়গাতেই অপরপ্রান্তের কনসেন্ট জড়িত, এবং দেদার ভঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও কনসেন্টের ব্যবহার চোখে পড়ে কদাচিৎ; যৌনতা/যৌনাচার সংক্রান্ত ১০০টা কনটেন্টেই কনসেন্ট উপস্থিত। এবং কনসেন্ট থাকলেই কি যৌনতা বৈধ; সেখানে শ্রেণিগত-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-গোষ্ঠীগত কমিটমেন্টের চাইতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদই মূখ্য হয়ে উঠবে? যৌনতাই কি তবে সভ্যতার প্রধান ক্রাইসিস?
জিজ্ঞাসা২- সম্মানই কি ব্যক্তির সবচাইতে ভালনারেবল তথা ভঙ্গুর সম্পদ, যা প্রতিমুহূর্তে আগলে রাখতে হয় সতর্ক প্রহরায়? বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর, বয়স ৬০ হওয়া মানে জীবনের অন্তিম পর্বে প্রবেশ করেছেন। এই বয়সাবধি যে সম্মান আর খ্যাতি অর্জন করেছেন জীবনের অবশিষ্টাংশেও তা অক্ষুন্ন রাখতে পারবেন নিশ্চয়তা কী? মতিভ্রম বা স্খলন ঘটতে একটিমাত্র মুহূর্তই যথেষ্ট। কিংবা আপনি পাবলিক ফিগার, অগণিত ভক্ত-অনুরাগী আপনার সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে চায়, আপনার উদ্ধৃতি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে, আপনার প্রতি অপরিসীম মুগ্ধতা সে/তারা স্বীকার করে প্রকাশ্যে, কিংবা সোজা বাংলায় বললে জীবনানন্দের প্রেমিকা দাবি করলেই জীবনানন্দ যদি ধরে নেয় মেয়েটি তার সঙ্গে শুতে চায়, দায়টা মেয়েটির নয় জীবনানন্দের। কারণ সৃজনশীলতাকেন্দ্রিক সোশ্যাল হায়ারারকিতে সে নিজের লেভেল বুঝতে পারেনি, লেভেল বিসর্জন দিয়ে নেমেছে পাদদেশে। শরীরের যত্ন মানে কেবল হাঁটা-চলা, খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ নয়, জননাঙ্গকে বশে রাখাও যত্ন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জিজ্ঞাসা৩- একজন যৌন নিপীড়কের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কী হওয়া উচিত? বহু মতামতই দেখা হয়েছে অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে। প্রস্তাবনায় ভিন্নতা থাকলেও মূল সুর অভিন্ন- জিরো টলারেন্স অ্যান্ড নো মার্সি। ধরা যাক, নিপীড়ককে খুন করলো নিপীড়িতের নিকটজন বা যে কেউ; এই খুনকে সমর্থন করবেন, নাকি খুনীর দণ্ড চাইবেন একই সরবতায়? নিপীড়ক কিন্তু ঘৃণ্য জন্তু থেকে রূপান্তরিত হচ্ছে ভিকটিমে; মৃত্যুর মাধ্যমে ইউটার্ন নেয়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে— এটা কি সে ডিজার্ভ করে? হ্যাঁ অথবা না এ এই জটিল সমীকরণের মীমাংসা হয় না আসলে।
এরকম ঘোরপ্যাঁচময় দার্শনিক এবং সামাজিক জিজ্ঞাসায় কনজিউমার বাড়ে না, তাদের চিত্তে বিরক্তি জন্মে। তাই গল্পের লেয়ারে প্রসাধনী আর সুগন্ধি আনতে বিজ্ঞাপনগুরু ফারুকী ছেড়ে দেন কয়েক সেকেন্ডের ন্যানো বিজ্ঞাপন। যেমন; ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোশাক দায়ি, কাউকে নাস্তিক বানিয়ে দাও, যে মেয়ে সিগারেট খেয়ে ভাইরাল হয় তার নৈতিকতা কেমন হতে পারে অনুমেয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত লোকজন নাফরমানি করে সংক্রান্ত ফতোয়া, নারীদের নিয়ে বেশি কথা হয় অথচ পুরুষদের প্রতি বৈষম্য কারো চোখে পড়ে না প্রভৃতি অতি পপুলিস্ট সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল আর কী-ওয়ার্ডগুলোর সর্বমোট ব্যাপ্তি দেড় মিনিটেরও কম, কিন্তু দর্শক ঘুরে-ফিরে ওর মধ্যেই গিয়ে আটকে পড়বে। কিংবা নারীবাদ ফ্লেভার যুক্ত করলে সকল ধরনের মিডিয়াতেই টকিং তৈরি হয়; যে কারণে গল্পের প্রোটাগনিস্টকে বেগম রোকেয়ার শরণাপন্ন হতে হয় ‘সুলতানা’স ড্রিম’ নামের খণ্ডকালীন ব্যবসা চালাতে। জিকা গাছের আঠা কঞ্চির ডগায় মাখিয়ে গ্রামের দিকে যারা ফড়িং ধরেছে কখনো, তারা দর্শক-রিভিউয়ার ধরে রাখার এই ফাঁদের কার্যকারিতা নিবিড়ভাবে অনুধাবন করবে।
গল্পের লেয়ার খুঁজতে আরো কিছু প্রসঙ্গে নজর রাখা যেতে পারে।
প্রসঙ্গ১- সম্পর্কের ধরন যেমনই হোক, ঘনিষ্ঠ অথবা অঘনিষ্ঠ, নিপীড়নের ঘটনাগুলো একটি সময়ব্যবধিতে ঘটে থাকে সাধারণত; ধরা যাক সেটা ৬ বছর। কিন্তু দীর্ঘদিনের আলাপ, পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠতা, ইতোপূর্বে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা না করা বা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চেষ্টা না করাসহ বিবিধ বিন্যাস-সমাবেশ করে কি চূড়ান্ত রায় দেয়া সম্ভব এদের মধ্যে যৌনাচারের ঝুঁকি ফুরিয়ে গেছে; সামাজিকতা আর ভাবমূর্তির ভ্যাকসিন পুশ করা হয়েছে? প্রতিটি শর্ত পূরণ করেও গল্পের প্রোটাগনিস্টসূত্রে দেখা যাচ্ছে যৌনবিচ্যুতির ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হতে এখনো অনেক দূর। ২০১৮ তে ৭০ বয়সী এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, আমি একজন স্বশিক্ষিত হিউম্যানলজিস্ট শোনার পর বলেছিলেন, ‘শোনেন একটা মানুষকে বুঝতে তার সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার সম্বন্ধে কথা বললে বাকি সব বিষয় যদি বাদও দেন আপনার অ্যাসেসমেন্ট ৮০% নিখুঁত হবে। ৬০ এর কাছাকাছি বয়স হয়ে গেলে পুরুষদের যৌন ফ্যান্টাসি টিনেজারদের মতো হয়ে যায়। পার্থক্য হলো, টিনেজারের যৌনাভিজ্ঞতা থাকে না সাধারণত, আর ৬০ এ পৌঁছুতে পৌঁছুতে একজন পুরুষের যৌনতাকেন্দ্রিক গড়ে ৩০-৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। যে কারণে দুইজনের ফ্যান্টাসির বহিঃপ্রকাশ আলাদা।’
প্রসঙ্গ২- নিপীড়কের মনস্তত্ত্ব আসলে কীভাবে কাজ করে? বহুগামী মানুষমাত্রই কি নিপীড়ক, কিংবা নিপীড়নকারী মোরালিটির অন্যান্য সূচকে কি ঋণাত্মক নম্বর পায়? মানুষ কি আদতেই এতটা একমাত্রিক প্রাণী! আফজাল হোসেনের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্ক সুখকর নয়, প্রায়ই সে হোটেলে রাত কাটায়— এইটুকু ইঙ্গিতকেই পরিবর্ধিত করে নানা দিকে নেয়া যায়। কন্যার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুবৎ, এবং সবচাইতে ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট হলো উকিল যখন বুদ্ধি দিচ্ছে ভিকটিমকে নাস্তিক এবং ভ্রষ্টা চরিত্র হিসেবে উপস্থাপনের তখন তার জবাব ছিল ‘আমার পক্ষে অতটা নিচে নামা সম্ভব নয়’। এই কথাটাকেও আক্ষরিকভাবে নেয়া উচিত, নাকি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কৃত্রিম ভাবমূর্তি ধরে রাখার সিগনাল সেটা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। কারণ তার ব্যক্তিগত সহকারী হাসান মাসুদ যেভাবে তাকে মদ পরিবেশন করে এবং তার উপস্থিতিতে মদ খেতে অস্বস্তিবোধ করে, পুরো দৃশ্যায়নটাই দুর্দান্ত শক্তিশালী স্যাটারিকাল ছিল।
প্রসঙ্গ৩- দ্বন্দ্বটা ক্ষমতা বনাম ক্ষমতাহীনের? এখানেই প্লটের মূল ইউনিকনেস। একজন খ্যাতিমান সৃজনশীল ব্যক্তির প্রশাসনিক এবং পেশীশক্তি আসলে কতটুকু? উদাহরণস্বরূপ সলিমুল্লাহ খানকে নিলাম; এটাকে পুরোপুরি কাকতালীয় বলা যায় না। বুয়েটে পড়াকালে ২০০৭-০৮ এ ক্যাটস আইয়ের গলিতে অবস্থিত এশিয়ান শিল্প ও সংস্কৃতি সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ওয়ার্কশপ করেছিলাম। পর্যায়ক্রমে শামীম আজাদের ওয়ার্কশপ, এবং সবশেষে সু্ইডিশ ভাষায় শিখি কিছুদিন, ক্লাস নিতেন সলিমুল্লাহ খান। ধরা যাক, ১৪ বছর পরে সেই এশিয়ান শিল্প ও সংস্কৃতি সভা বিরাট সংগঠন হয়ে উঠেছে, সলিমুল্লাহ খান তার চেয়ারম্যান; ক্ষমতা আর ভাগবাটোয়ারার রাজনীতিতে তিনি কি বসুন্ধরা বা যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান পর্যায়ের প্রভাব রাখেন? গল্পের আফজাল হোসেন চরিত্রটি আদতে কালনিরপেক্ষতা খ্যাতিমান কোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তির প্রতিরূপ যিনি ক্ষমতার আনুকূল্যভোগী, নিয়ন্তা নন; দুষ্কর্মে জড়ালে ডিলিংসটা কীভাবে করতে চাইবেন তিনি? অর্থনৈতিক প্রলোভন; পুলিশ-আদালতের সামনে এক্সপোজড হওয়ার প্রশ্নই আসে না, গুণ্ডা লেলিয়ে হুমকি-ধামকি দেবেন সাহসে কুলোবে না। বরং কনফ্লিক্ট অ্যাঙ্গেলটাকে এভাবে দেখা যায়- মহীরূহ মিথ বনাম আত্মসম্মান।
প্রসঙ্গ৪- সম্পর্কের তড়িৎ প্রবাহ কি বর্তনীর সিরিজ, নাকি প্যারালেল সংযোগ নীতি মেনে চলে? ধরা যাক শুক্লা আর অভীক কলিগ। কালক্রমে অভীকের স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথক সম্পর্ক গড়ে উঠলো শুক্লার। একসময় অভীক শুক্লার সঙ্গে অসভ্যতা করলো; তার প্রভাবে সবগুলো সম্পর্ক কি নাই হয়ে যাবে বা যাওয়া উচিত; সম্পর্ক আসলে কতটা স্বাধীন বা আনবায়াসড? গল্পের প্রোটাগনিস্ট আর নিপীড়নকারী একই গাড়িতে যাচ্ছে, যেখানে গাড়ির চালক নিপীড়নকারীর কন্যা, প্রোটাগনিস্টের সমবয়সী। এবং গাড়িতে বসা অবস্থাতেই কন্যাটি তার ব্যবসায় বিনিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করছে, বড়ো ওয়ার্ক অর্ডার দিচ্ছে। এটা ফাঁদ, নাকি ফ্যাক্ট? সে অসম্মানের বিচার চাইবে, নাকি প্রতিদিনকার দারিদ্রজর্জরিত ভাগ্য বদলের বিনিময়ে ভুলে যাওয়াটাই সমাধান মানবে— এই গভীরতর সংকটে তাকে পুলিশ, প্রশাসন বা ক্ষমতা ফেলেনি, সংকটটা সম্ভাবনা বনাম সম্মান এর দ্বৈরথের। প্রোটাগনিস্ট মানেই অতুলনীয় মহামানব, সেই স্টেরিওটাইপও এখানে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। গল্পের প্রোটাগনিস্ট মানুষের কাছে অবিরাম টাকা ধার নেয়, পরিশোধে ব্যর্থ হয়, পুনরায় ধার করতে চায়, চাকরি পার্মানেন্টের আশায় লবিং করে। ধরা যাক, আফজাল হোসেন তাকে নিপীড়ন করেনি; সেক্ষেত্রে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের আড়ালে হায়ার অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে তার যোগসাজশে প্রেজেন্টেশন তৈরির যে ক্রিয়া— এটা কি নৈতিক থাকে? এবং নিপীড়ন না ঘটলে ন্যারেটিভই বদলে যেত; ঠিক এ কারণেই প্রোটাগনিস্ট-এন্টাগনিস্ট কনসেপ্টগুলো অনেকটাই সিচুয়েশনাল, স্থায়ী ইমপ্রেসন নয় কোনোক্রমেই।
প্রসঙ্গ৫: গল্পের ক্যারেক্টারাইজেশন অতি নান্দনিক। প্রোটাগনিস্টের স্বামী চরিত্রটি দেখামাত্র অস্বস্তি জাগতে বাধ্য, এরকম মেয়ের স্বামী এই ছেলে কীভাবে হয়, তাও নিজেদের পছন্দে বিয়ে। অর্থাৎ চালচলন, অবয়ব, বিচরণের মধ্যে খটকাটা ঘুরঘুর করতেই থাকে। এটা দিয়েই প্রোটাগনিস্টের ব্যাকস্টোরি অনেকটা পূরণ করা যায়। কোন বয়সে সে মাকে হারিয়েছে, বয়ঃসন্ধিকাল আর ভার্সিটিজীবনে কীভাবে কাটিয়েছে, পারফরর্মিং আর্ট, কবিতা প্রভৃতির প্রতি অনুরাগ-আসক্তি বা সংযুক্তি তৈরি হলো— এ সংক্রান্ত হাইপোথিসিস তৈরির সুযোগ করে দেয় তার স্বামীর ক্যালিবার, যাকে চাকরিটা পর্যন্ত যোগাড় করতে হয়েছে স্ত্রীর প্রভাবে। এক্ষেত্রে হীনমন্যতা বোধ তাকে নিঃশেষিত করে দেয়ার কথা প্রচলিত মনোভঙ্গির মানুষ হলে, ঘটেছেও তাই। ৫০ বয়সী ৫ সন্তানের জনক বিপত্মীক ব্যক্তিও নাকি পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে ভার্জিন পাত্রী প্রাধান্য দিয়ে থাকে, এরকম মন্তব্য শুনেছি বহু মানুষের থেকে। ধর্ষিত বা নিপীড়িত হওয়ার কারণে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বা সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার যেসব গল্প পাই, বিপরীতে এটাকে দুর্ঘটনা ধরে ভিকটিমের পাশে থাকার গল্পের অনুপাত কীরকম? সে তুলনায় না গিয়ে প্রথম কেইসটার সলুক সন্ধান চালাই। কী ঘটে আদতে? যখনই তার সঙ্গে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হতে যাচ্ছে পুরুষ সঙ্গী, তার মনে হচ্ছে এই শরীরে অন্য আরেকজনের স্পর্শ লেগেছে। আদতে নিপীড়ক আর সঙ্গী দুজনেই যে নারীটিকে শরীরের বাইরে সত্তা ভাবতে পারছে না সেই সীমাবদ্ধতার উৎস কোথায় প্রোথিত? দ্বিতীয় চরিত্র মারিয়া নুর। ক্রিকেট হোস্টিংয়ে তাকে যতটা বিশ্রীরকম বেখাপ্পা লাগে, খ্যাতিমান বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং চ্যালেঞ্জিং মানসিকতার স্বাধীনচেতা কন্যারূপে ঠিক ততটাই পরিপূর্ণ, রিকি পন্টিংয়ের পুলের সঙ্গে উপমিত করা যেতে পারে। তৃতীয় চরিত্র হাসান মাসুদ। যে কোনো পাবলিক ফিগার বা ক্ষমতাশালীর যাবতীয় অপকর্মের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে তার ব্যক্তিগত সহকারী অথবা ড্রাইভার অথবা লিগ্যাল অ্যাডভাইজার। তাদের ভাবগতিক আর হম্বিতম্বিই অন্যরকম। হাসান মাসুদ চরিত্রটার কমিকাল রিপ্রেজেন্টেশন যতটা কমার্শিয়াল চাহিদা পূরণ, লিগ্যাল অ্যাডভাইজার- ড্রাইভার প্রমুখের একই ফ্রিকুয়েন্সির কমিকাল হারমনির মধ্য দিয়ে অন্তত প্রশাসনিক ব্যাপারটাকে মকারি বা ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করা গেছে। এই কৌশলগুলো এত সূক্ষ্মভাবে প্রয়োগ করা হয় গভীর মনোযোগ ব্যতীত কোরিলেশন আবিষ্কার করাটা দুরূহ হয়ে উঠে।
প্রসঙ্গ৬- মেটাফরিকাল কম্পোজিশনগুলো ভাবনা জাগায়। স্বামী-স্ত্রী একই এন্ট্রি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক ফুট দূরত্ব, কিন্তু দুজনের মুখ বিপরীত দিকে ঘুরানো। ক্ষোভ নাকি ঘৃণা নাকি আত্মদহন কে কার প্রতিনিধি? প্রোটাগনিস্টের বাবা প্রথম দৃশ্যেই সুরা ভুলে যায়, যতবারই তাকে স্ক্রিনে দেখায় সে কিছু না কিছু ভুলে যায়। এবং প্রোটাগনিস্ট জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে সে ব্যাপারে তার বিকার নেই, সে চিন্তিত বহু বছর আগের এসএসসির রেজাল্ট নিয়ে। যদিও প্রোটাগনিস্টের মুখ দিয়ে ফারুকী বলাচ্ছেন ভুলে যাওয়াটা রোগ নয়, প্রাকৃতিক সমাধান। কিন্তু কাউন্টারে এটাও ভাবায় প্রোটাগনিস্টের বাবার মতো পরনির্ভর আর সমর্পিত নিয়তিই কি ভুলে যাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? এবং অতি অবশ্যই অন্তিম সিক্যুয়েন্সটা। সম্ভবত ১ মিনিট ব্যাপ্তি ছিল সিকুয়েন্সটার। নিপীড়কের কন্যা বনাম প্রোটাগনিস্ট, মুখের ভাষা বিশ্রামে, চাহনি নৈর্ব্যক্তিক, অথচ যে যার কাজ করে যাচ্ছে। নীরবতার বাকপ্রাচুর্য কি একেই বলে?
প্রসঙ্গ৭- ফারুকী এই অভিযানে মর্মান্তিক ভুলটি করেছেন, আমার মতে, জনরা ঘোষণায়। তিনি কোন আঙ্গিকে এটাকে ‘ক্রাইম’ জনরাভুক্ত করেছেন, বোধগম্য নয়। ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডি জাতীয় প্রোগ্রামের বিপুল জনপ্রিয়তা, নাকি ডিটেক্টিভ থ্রিলার এর বাজার কাটতি ভালো, সেই বিবেচনায় নিশ্চিত করে বলা যায় না। সমগ্র স্ক্রিপ্ট যেখানে সাইকিক অ্যানালাইসিসে ভরপুর, সেটা সাইকোলজিকাল ড্রামা শ্রেণিভুক্ত কেন হবে না? অবশ্য সাইকোলজি শব্দটার প্রতিই এই জনপদে বিকর্ষণতা রয়েছে দীর্ঘকাল যাবৎই। থ্রিলার হলে, পার্থ বড়ুয়ার চরিত্রে আরো স্পেস থাকতো, খুনি হিসেবে আমরা পেতাম আফজাল হোসেনের স্ত্রী অথবা প্রোটাগনিস্টের সেই নারী সহকর্মীকে যিনি বিভিন্ন দৃশ্যেই ফ্রেমে ছিলেন, কিন্তু মিডিয়ার সামনে আফজাল হোসেনের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সনদ দেয়া ব্যতীত কোনো সংলাপ বরাদ্দ পাননি। থ্রিলার দৃষ্টিকোণ থেকে খুনের মোটিভ শক্তিশালী হতো এই দুই নারী চরিত্রের, কিন্তু এখানে তো ১ এপিসোড আগেই ইনটিউশনবশত পার্থ বড়ুয়া ধরে ফেলেছে প্রকৃত খুনীকে। তদন্ত প্রক্রিয়াতেও নাটকীয়তা রাখা হয়নি, পার্টিসিপেন্টকে বিভ্রান্ত করো এবং মেথড অব এলিমিনেশন প্রয়োগ করে দোষীকে শনাক্ত কর— রেগুলার প্রটোকল। বরং একে স্টোরিটেলিংয়ের কৌশল হিসেবে ধরে নেয়া যায়; মানুষ যখন প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ভিকটিম জিতবে, অন্যায়কারীর সাজা হবে— অর্ধেক অংশেই মূল এন্টাগনিস্ট খুন হয়ে যাওয়ায় গল্পের কনটেক্সটই বদলে গেছে, প্লটের মধ্যে সাবপ্লট, বা গল্পের মধ্যে আরেক গল্প। ভুল ট্যাগিংয়ের কারণে থ্রিলারভোক্তাদের কাছে কেমন ট্রিটমেন্ট পায় সেও এক আকর্ষণীয় পর্যবেক্ষণ হতে পারে। এমনকি চঞ্চল চৌধুরীর ৫ সেকেন্ডের গিমিক গল্পে ভ্যালু বাড়াতে, নাকি নিছকই কমার্শিয়াল চাহিদা পূরণ সেও এক অণ্বেষণ বটে।
***
কেন নিয়েছিলাম কঠিন সিদ্ধান্ত? গল্পটা এখন বলাই যায়।
২০০০ সালের আশপাশে একুশে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি ট্রাভেল শো বেশ পছন্দ করতাম, বেশ কিছুদিন পরে জানি প্রোগ্রামটির কনসেপ্ট ছিল ফারুকীর। ততদিনে ‘ব্যাচেলর’ সিনেমাটি মুক্তির অপেক্ষায়। আজিজ সুপার মার্কেট একটি টি-শার্ট বাজারজাত করে যার ট্যাগলাইন ‘Not All men are fools, some are Bachelor’; নটরডেমে পড়ি তখন, ব্রহ্মাচার্যের ব্রত নিয়েছি আরো ৬ বছর পূর্বে। ট্যাগলাইনটা পছন্দ হওয়ায় টি-শার্টটি সংগ্রহ করি। ‘ব্যাচেলর’ দেখি, তার সম্পর্কে আরো খোঁজ নিই। জানতে পারি তিনি কথ্য ভাষায় নাটক নির্মাণ করেন, স্ক্রিপ্ট কনসেপ্টে আস্থা পান। ব্যতিক্রমিতার প্রতি আশৈশব আকর্ষণে তার প্রতিটি নাটক-সিনেমা দেখতে থাকি। ততদিনে কলেজ পেরিয়ে বুয়েটজীবনও তিন চতুর্থাংশ সমাপ্ত। আমি বড়ো হচ্ছি, ফারুকী আর বড়ো হয় না। চিন্তা-ভাবনায় ম্যাচিউরিটি নেই, ক্যারেক্টারাইজেশন, স্টোরিটেলিং, প্লট সবকিছুই আনাড়ি লাগতে শুরু করে। অনুভব করি তিনি কী চান, কেন চান প্রশ্নগুলো নিজেই জানেন না, বা জানার অভিরুচি নেই, তার চিন্তার স্পেস খুবই সংকীর্ণ; ৬ বছর সময় দিয়েছি, কোনো গ্রোথ নেই, আমি তার অ্যাটিচুডে আকৃষ্ট হয়েছিলাম, কিন্তু কনটেন্টবিহীন অ্যাটিচুড তো নায়ক জসিমও দেখায়। আদতে তিনি একজন মার্কেটিং পারসন— এই অনুসিদ্ধান্ত থেকেই বিচ্যুতি বা প্রস্থান।
তবে ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ সূত্রে ১ যুগ বাদে যে পুনর্মিলনী ঘটলো, ব্যাপারটা চিন্তার খোরাক জোগাবে। আইসোলেশন বা অ্যালিয়েনেশন কেন বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রোথের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ সেই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে একটি নিরীক্ষামূলক কেইস স্টাডি।