শর্টফিল্ম ২০২১: বছরের সেরা দশ
টিভি ও ওটিটি মিলিয়ে এই বছরের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে শর্টফিল্মকেই এগিয়ে রাখবো। সিরিজ আকারে দারুণ দারুণ সব কাজ হয়েছে। প্রথমেই বলি,‘ঊনলৌকিক’ সিরিজটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই উঁচুমানের কাজ। সীমিত বাজেটে নবীন নির্মাতারা সাহস দেখিয়ে সফল করেছেন ‘সাত দু গুণে চৌদ্দ’ সিরিজ। ‘শর্টকাট’ ছিল ঈদের সেরা আকর্ষণ,এ ছাড়া ‘জাগো বাহে’, ‘গল্প গল্প খেলা’, ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ সিরিজ তো ছিল।
তবে এত ভালো ভালো কাজ হওয়া সত্ত্বেও প্রচারমাধ্যমের কারণে খুব বেশি দর্শকদের কাছে পৌঁছেনি, সেই তুলনায় সহজলভ্য হওয়ায় দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে ‘ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প’। জনপ্রিয় নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ান বানিয়েছিল একাধিক শর্টফিল্ম, সেইগুলোও মোটামুটি আলোচনায় এসেছিল। এত এত ভালো শর্টফিল্ম থেকে সেরা দশ বেছে নেয়া সত্যিই কঠিন ব্যাপার, তবুও—
১.মিসেস প্রহেলিকা: ‘আমি স্বপ্ন দেখি না, কারণ আমি ঘুমাই না’, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এম আলীর কাছে এসেছে এক তরুণী। তার সমস্যা সে স্বপ্ন দেখে না, কারণ সে ঘুমাতে পারে না। আবার জানা যায়, সে আসলে ঘুমিয়েই আছে, পুরোটাই স্বপ্ন। এমনকি এম আলীর কাছে আসাটাও! শিবব্রত বর্মনের গল্প অবলম্বনে চরকির ঊনলৌকিক সিরিজের তৃতীয় পর্ব ‘মিসেস প্রহেলিকা’। প্রহেলিকা মানে ধাঁধা, তেমনি পুরো গল্পটাই শেষ পর্যন্ত যেন ধাঁধা হয়ে রইলো। মিস্ট্রি ঘরানার এই শর্টফিল্মের ব্যাখ্যা নানাভাবেই দেয়া যায়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী বেশ ভালো, তবে মিসেস প্রহেলিকা চরিত্রে তিশা দিলেন যেন সাম্প্রতিককালের অন্যতম সেরা অভিনয়। মাত্র দুজন চরিত্র পুরো গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন, তার জন্য বাহবা পাবেন চিত্রনাট্যকাররা। নির্মাতা রবিউল আলম রেখেছেন মুনশিয়ানার ছাপ। শিল্প নির্দেশক নিখুঁত কাজ করেছেন, রহস্য হয়ে থাকে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাগুলো আর আমি বৃষ্টিতে ভিজব না সংলাপ!
২.কাউয়া: ১৯৪৩ সাল, দুর্ভিক্ষের বছর। শহরের তুলনায় গ্রামে এর প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। সব হারিয়ে গ্রামে আসে এক আগন্তুক। যার ওপর ভর করে মহামারি, জেগে উঠে প্রতিশোধের স্পৃহা। যার সঙ্গে মিলে যায় এই সময়ের অবস্থা। গোলাম মুনতাকিম ফাহিম প্রথম নির্মাণেই মেধার পরিচয় দিয়েছেন। সাদাকালো ফরম্যাটের এ ছবিকে সোহেল রানার অসাধারণ অভিনয় প্রাণ দিয়েছে। আরও আছেন মনোজ প্রামাণিক।
৩.জুজু: নিজের কাজের প্রতি একাগ্র ভালোবাসা থাকে, তাহলে বাজেট কোনো ইস্যু না তা প্রমাণ করলেন সিজু শাহরিয়ার। তার নির্মিত শর্টফিল্ম ‘জুজু’। ড্রাইভার ও তার সহকারী লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামে, রাতে পথের মাঝে ঘটে যায় সব অতিপ্রাকৃত ঘটনা। সেই ঘটনা সামলে ফিরতি পথে আরেক চমক! অতিপ্রাকৃত বা হরর গল্প আমাদের দেশে তেমন হয় না, হলেও দুর্বলই হয়। তবে সিজু শাহরিয়ার পুরো ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন। আবহ সংগীত গল্পটা আরও জমিয়ে দিয়েছে,যে কেউই ভয় পেতে বাধ্য। অভিনয়ে অশোক বেপারিকে বেশ ভালো লেগেছে আর শেষ ছক্কা হাঁকিয়েছেন অ্যালেন শুভ্র।
৪.আকাশ ভরা তারা: রাতের বাসে মাত্র তিনজন যাত্রী। দুজন ছেলে ও একজন নারী। এক ছেলের কথাবার্তা সন্দেহজনক, নারী যাত্রীর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়, অপরজনের মনে ভয় জাগে। ছেলেটি আক্রমণ করে বসে নারীকে। তারপর! শাফায়েত মনসুর রানা শর্টকাট সিরিজের শেষ ছবি ‘আকাশ ভরা তারা’তেও ছক্কা হাঁকালেন। গল্প শুরু থেকেই একটা বিষয়বস্তুর দিকে আগালেও পরে সেটা রূপ নেয় অন্যদিকে, যা এই সিরিজের বৈশিষ্ট্য। নাজিম উদ দৌলার গল্প, রানার চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, রাজু রাজের ক্যামেরা সঙ্গে মোস্তফা নূর ইসলামের অনবদ্য অভিনয় সঙ্গে ইয়াশ রোহানও বেশ। শেষের টুইস্ট ছিল বরাবরের মতো সারপ্রাইজ।
৫.দ্বিখন্ডিত: ‘ঊনলৌকিক’ সিরিজের শেষ কিস্তি। এই গল্প মোস্তাক আহমেদকে ঘিরে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এ কেরানি পুলিশ স্টেশনে এসেছে বিশেষ কাজে। থানায় এসে গল্প জুড়ে দিলেন এসআই’র সঙ্গে। এভারেস্টের হিলারি স্টেপস থাকা না থাকা নিয়ে বৈপরীত্য, দেশভাগের সময় একটি ফটোগ্রাফ নিয়ে মতানৈক্য কিংবা একজন মন্ত্রীর একই সময়ে দুজন থাকা নিয়ে কথাবার্তা। তবে যাওয়ার আগে এমন কথা বলে যায়, যার জন্য এসআই পুরো চমকে যান! মোস্তাক আহমেদের চরিত্র বেশ চ্যালেঞ্জিং আর সেটা করে দেখালেন ইন্তেখাব দিনার। জহুরি যেমন জহর ঠিকই চিনে ফেলে, তেমনি নির্মাতা রবি অভিনয়ের পারদর্শিতায় চিনে ফেলেছিলেন ইন্তেখাব দিনারকে। শুধু প্রাণবন্ত সংলাপ প্রক্ষেপণ আর বর্ণনার জন্য পুরো সময়টা দেখা যায়, এই জন্য গল্পকারের পাশাপাশি ধন্যবাদ দিতে হয় চিত্রনাট্যকারদের। সিরিজের আরও দুটি শর্টফিল্ম ‘মরিবার হলো তার স্বাদ’ ও ‘ডোন্ট রাইট মি’ও পছন্দের তালিকায় আছে,ভালো লাগেনি ‘হ্যালো লেডিজ’।
৬.আনোয়ারা মনোয়ারা: রেল লাইনে থাকা মা ও মেয়ের গল্প। মা সারাদিন কাজ করে,অন্ধ মেয়ের সারাদিন কাটে পুরোনো ট্রেন আর রেল লাইনে। একদিন সকালে ঘটে অবাক করা ঘটনা, মেয়ের পায়ে নূপুর, আরেকদিন হাতে চুড়ি। সে এইসব কোত্থেকে পায়, মায়ের সন্দেহ হয়! তারপর মা নিজেও উপহার পায়, কিন্তু কীভাবে! ইকবাল হাসান খানের নির্মাণে মেহেদী উল্লাহর গল্পের মূল ভাবনা এত ভালো লাগলো, আরও বেশি ভালো লেগেছে নির্মাণ। শেষের দিকে দারুণ আবহ তৈরি করলো, আর অভিনয়ে শাহনাজ খুশি ও তাসনুভা তিশা নতুন করে নিজেদের প্রতিভা দেখালেন।
৭.টিক টক: অফিসের সামান্য কর্মচারী বসের ঘড়ি লোভে পড়ে চুরি করে ফেলে, ঘড়িটা নিয়ে বেশ খুশি সে। তার স্ত্রীকেও দেখায় সে। কিন্তু দাম জানার পর সে অস্থিরতায় ভুগে, বসের কাছে ঘড়িটা ফেরত দিতে যায়! শাফায়েত মনসুর রানার শর্টকাট সিরিজের এই ছবির চিত্রনাট্যে আগ্রহ ধরে রেখেছেন। অভিনয়ে সোহেল মণ্ডল এককথায় অনবদ্য, ঈদ আজহায় সেরাদের একজন। তার স্ত্রীর ভূমিকায় ফারজানা অ্যানিও দারুণ। ক্যামেরার কাজ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভালো লেগেছে। যদিও শেষটা মর্মান্তিক, একেবারেই আশা করিনি, তাই ধাক্কা লেগেছে। তবে এই শর্টফিল্ম দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
৮.বিড়াল তপস্যা: মাসুম বাশার ও শিল্পী সরকার অপুর সংসার, পড়াশোনার জন্য থাকে অপুর বোনের মেয়ে তাসনিয়া ফারিণ আর একটি বিড়াল। ছিমছাম সুখের সংসার, কিন্তু এখানেও নেমে আসে মুখ ও মুখোশের জীবন। শেষ পর্যন্ত এই গল্পের মূলভাব দাঁড়ায় এই সমাজের একটা ব্যাধিতে, বিড়াল হয়ে উঠে প্রতীক! ইশতিয়াক জিহাদের এই শর্টফিল্মও বেশ ভালো লাগলো, সরলরেখায় না টেনে দর্শকদেরও ভাবতে দিয়েছেন। তাসনিয়া ফারিণ, শিল্পী সরকার অপু ও মাসুম বাশার সবাই যথাযথ অভিনয় করেছেন। সাত দু গুণে চৌদ্দ সিরিজের বাকি শর্টফিল্মগুলোর মধ্যে সহজ সুন্দর, দেজাভ্যু, ভুগোল+ বেশ ভালো লেগেছে।
৯.লাইট ক্যামেরা অবজেকশন: একটি সংসারকে রূপক অর্থে দেশের সঙ্গে তুলনা করে বানানো ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তির পরেই সাড়া ফেলে দেয়। তবে পাকিস্তানের সামরিক সরকার এই ছবিকে ভালোভাবে নেয়নি। সেন্সর দিতে গড়িমসি করলেও দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মুক্তির পরেও দেখা দিল জটিলতা। সরকার ছবিটিকে নিষিদ্ধ করে। ছবির নির্মাতা জহির রায়হানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ডাকা হয় সভা। বলা হয় ছবির কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেটে দিতে, কিন্তু তিনি অনড়! এই নিয়েই চরকির জাগো বাহে সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব ‘লাইট ক্যামেরা অবজেকশন’। সালেহ সোবহান অনীমের নির্মাণে সোহান রিজওয়ানের চিত্রনাট্য ও বিশেষ করে সংলাপ উল্লেখযোগ্য, যা আজও প্রাসঙ্গিক। ক্যামেরা কাজ, শিল্প নির্দেশনা সবকিছুই যথাযথ। জহির রায়হান চরিত্রে চমক দেখিয়েছেন মুস্তফা মনোয়ার। অভিনয় তিনি সব সময়ই ভালো করেন, এখানে তিনি চলনে বলেনেও হয়ে উঠেছেন জহির রায়হান। মধু দা-খ্যাত ‘জীবন থেকে নেয়া’র সংলাপ রচয়িতা জহির সাহেবের একান্ত সহকারী আমজাদ হোসেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মীর জিসান। ইন্তেখাব দিনারের আগমনের পর জমে উঠে শর্টফিল্ম। আরও ছিলেন গাজী রাকায়েত,’অপর্ণা ঘোষ,’অপূর্ব মজুমদারসহ অনেকে। এই সিরিজের ‘শব্দের খোয়াব’ও বেশ ভালো লেগেছিল, সেই তুলনায় ‘বাংকার বয়’ প্রত্যাশা মিটিয়েছে কম।
১০.চা খাবেন?: শাফায়েত মনসুর রানার ‘চা খাবেন?’ এর ট্রেলার দুর্দান্ত হওয়ায় প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। সেই তুলনায় শেষটা অত দুর্দান্ত না হলেও ভালো কাজের তালিকায় নির্দ্বিধায় রাখা যায়। রানা সাহেব চিত্রনাট্যটা বেশ টান টান রেখেছেন। অভিনয়ে অপর্ণা বরাবরের মতো ভালো, তবে নাজিবা বাশার যেন সব আলো কেড়ে নিয়েছে। পরিচয় দিতে গেলে স্পয়লার হয়ে যাবে, শেষের ঐ অচেনা লোকটার সংলাপ শুনে বেশ হাসি পেয়েছে। এই সিরিজের বাকি শর্টফিল্ম এমন যদি হতো, এক ভাই চম্পা, মাথা নষ্ট, শুটআউটও বেশ উপভোগ্য।
বিশেষ: ‘কাছে আসার গল্প’ বরাবরের মতো ভালোবাসা দিবসেও তিনটি গল্প নিয়ে হাজির ছিল। গল্পের জোর কম হলেও প্রকৃতি ও প্রেমকে উপজীব্য করে নির্মাণ ও চিত্রনাট্যের মুনশিয়ানা, দারুণ সিনেমাটোগ্রাফি ও অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। রায়হান রাফির ‘অথবা প্রেমের গল্প’তে অভিনয় করেছিল শাওন ও নাজিফা তুষি। অনম বিশ্বাসের ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’তে অভিনয়ে ছিল খায়রুল বাসার ও টয়া, সর্বশেষ শঙ্খ দাশগুপ্তের ‘শূন্য থেকে শুরু’তে ছিলেন তাহসান ও সুনেরাহ। সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে রাজু রাজ, শেখ রাজিবুল ইসলাম ও তাহসিন রহমান। ভালোবাসা দিবসেই বানানো মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘রেশ’ উপভোগ্য। ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ সিরিজের গৌতম কৈরির ‘বাঘের বাচ্চা’, সুমন আনোয়ারের ‘জোয়ার ভাটা’ ভালো লাগছে।
শর্টফিল্মের এই ধারা বজায় থাকুক!