Select Page

শাবানা একজনই

শাবানা একজনই

‘হা ভাই, শুরু হচ্ছে বিউটি কুইন শাবানা-র ছবির বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’/ ‘আসিতেছে, জনগণ নন্দিত নায়িকা শাবানা-র ছবি..’

রেডিওতে বিজ্ঞাপন কণ্ঠরাজ নাজমুল হুসাইন এবং বিনোদন বন্ধু মাজহারুল ইসলাম এভাবেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সম্রাজ্ঞী শাবানা-কে বিশেষায়িত করতেন। অনবদ্য অভিনয়, চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয়ের সাহসী নেশা, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি ঢালিউডের ওয়ান অ্যান্ড অনলি ফিল্মস্টার।

মূল নাম – আফরোজা সুলতানা রত্না। জন্ম – ১৫ জুন, ১৯৫২ সাল। বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান থানার ডাবুয়া গ্রামে। বাবা ফয়েজ চৌধুরী একজন টাইপিস্ট, পরে চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেন  এবং মা ফজিলাতুন্নেসা পেশায় গৃহিণী। ডাকনাম রত্না, চলচ্চিত্রে আসার পর নাম হয় শাবানা। তবে শাবানা নাম হবার আগেও তাঁর রত্না নামে কিছু ছবি মুক্তি পায়।

৯ বছর বয়সে প্রথম অভিনয় করেন ‘নতুন সুর’ ছবিতে। তাঁর বাবা ফয়েজ চৌধুরী ছবিটিতে শাবানার বাবার ভূমিকাতেই ছিলেন। স্বামী ওয়াহিদ সাদিক চলচ্চিত্র প্রযোজক। তিন ছেলেমেয়ের জননী। তিনি বর্তমানে প্রবাসী।

পাকিস্তানি নায়ক নাদিমের বিপরীতে শাবানাকে কাস্ট করা হয় ‘চকোরী’ ছবিতে ১৯৬৭ সালে। সেটাই তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি।

উল্লেখযোগ্য ছবি : আনাড়ি, পায়েল, আন্ধি, বশিরা, চকোরী, সমাপ্তি, ছদ্মবেশী, মায়ার বাঁধন, রাজরাণী, জীবনসাথী, অমর প্রেম, অবুঝ মন, লুকোচুরি, সাহেব বিবি গোলাম, অনুভব, দোস্ত দুশমন, দাতা হাতেম তায়ী, মনের মানুষ, রাজদুলারী, অঙ্গার, সোহাগ, আসামী, বধূ বিদায়, মধুমিতা, তুফান, ফকির মজনু শাহ, অনুরাগ, মাটির ঘর, ছুটির ঘণ্টা, জবাব, ঘরে-বাইরে, বারুদ, বাদশা, ঘর সংসার, সোনার চেয়ে দামি, মাটির মানুষ, বিজয়িনী সোনাভান, শশীপুন্নু, অভিমান, সোনার হরিণ, ওমর শরীফ, সংঘর্ষ, বাঁধনহারা, অংশীদার, দুই পয়সার আলতা, পুত্রবধূ, অগ্নিকন্যা, ভাঙাগড়া, আশার আলো, কেউ কারো নয়, সবুজ সাথী, নালিশ, মধু মিলন, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, সোনার হরিণ, বধূ বিদায়, স্মৃতি তুমি বেদনা, লুটেরা, অংশীদার, কেউ কারো নয়, রজনীগন্ধা, লালুভুলু, ঝুমুর, নাজমা, অচেনা, মেহমান, ঘরের বউ, বানজারান, সময় কথা বলে, পরিবর্তন, নতুন পৃথিবী, হাসান তারেক, হিম্মতওয়ালী, সালতানাত, গৃহলক্ষ্মী, সকাল সন্ধ্যা, স্বামী-স্ত্রী, সমর, সখিনার যুদ্ধ, ভাত দে, মরণের পরে, অবদান, মা ও ছেলে, ন্যায় বিচার, কাবিন, ভাইজান, গরিবের সংসার, বাংলার মা, বাংলার বধূ, বাংলার নায়ক, ভালোবাসার ঘর, শাসন, সত্যের মৃত্যু নেই, স্নেহ, ঘর দুয়ার, সুখের স্বর্গ, বিদ্রোহী বধু, বিশ বছর পর, রাগ-অনুরাগ, স্ত্রী হত্যা, মায়ের দোয়া, নিষ্ঠুর, কালিয়া, আক্রোশ, উসিলা, চাঁপা ডাঙার বউ, রাঙ্গা ভাবী, বিরোধ, সারেন্ডার, চোখের পানি, দুঃসাহস, লালু মাস্তান, দেশ-বিদেশ, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, বিশ্বনেত্রী, স্বামী কেন আসামী, মা যখন বিচারক, শেষ উত্তর, ঘরে ঘরে যুদ্ধ, অপেক্ষা, আখেরি মোকাবেলা, মর্যাদার লড়াই, মেয়েরাও মানুষ, অবদান, কাজের বেটি রহিমা, চাকরানী, চিরশত্রু, মিথ্যার মৃত্যু, অন্ধ বিশ্বাস, সুখের স্বর্গ, জিদ্দি, কালিয়া, চোখের পানি, টপ রংবাজ, দুঃসাহস, ঘরের সুখ, স্বাক্ষর, সন্ধি, স্নেহের বাঁধন, ঘাত-প্রতিঘাত, তপস্যা, জজ ব্যারিস্টার, অমর, স্ত্রীর স্বপ্ন, দুর্জয়, কন্যাদান, ননদ ভাবী, সংসারের সুখ দুঃখ, একটি সংসারের গল্প, স্বামীর আদেশ, গরিবের বউ, অজান্তে, ব্যথার দান, ঘাতক, ঘর দুয়ার, পরাধীন, নীল সাগরের তীরে, গরিবের ওস্তাদ।
শেষ ছবি – ঘরে ঘরে যুদ্ধ।


রত্না নামে অভিনীত চলচ্চিত্র – তালাশ, ডাকবাবু, ভাইয়া, সাগর, প্যায়সে, আবার বনবাসে রূপবান।
প্রযোজিত ছবি – মুক্তি, মাটির ঘর, সবুজ সাথী, মান সম্মান, নাজমা। এগুলো তাঁর নিজের প্রযোজিত ছবি। এর বাইরে ‘এস এস প্রোডাকশনের ব্যানারে (শাবানা অ্যান্ড সাদিক) কিছু ছবি নির্মিত হয়েছিল। যেমন – স্বামী কেন আসামী, মেয়েরাও মানুষ, ঘাত-প্রতিঘাত, অশান্তি, জালিম, ঝড় তুফান, রাজ নন্দিনী, অবুঝ সন্তান, অন্ধ বিশ্বাস, দুঃসাহস, স্বপ্নের পুরুষ।

শাবানা ৯ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে ‘জননী’ ছবির পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন মূল চরিত্রে না দেয়াতে। অন্যান্য পুরস্কার :
সখি তুমি কার (১৯৮০)
দুই পয়সার আলতা (১৯৮২)
নাজমা (১৯৮৩)
ভাত দে (১৯৮৪)
অপেক্ষা (১৯৮৭)
রাঙ্গা ভাবী (১৯৮৯)
মরণের পরে (১৯৯০)
অচেনা (১৯৯১)
তাঁর একটি রেকর্ড আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। পরপর দুইবার হ্যাটট্রিক পুরস্কার জিতেছিলেন জাতীয় পুরস্কারে।

শাবানা-র অতুলনীয়, প্রখর অভিনয়ক্ষমতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর অনেক ছবিতে। তিনি রোমান্টিক, রোমান্টিক ড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, পলেটিক্যাল ড্রামা, সাহিত্যভিত্তিক ছবি, বিদেশী ছবি, পোশাকি ছবি, ফোক-ফ্যান্টাসি ছবি সব ধরনের চলচ্চিত্রে বিচরণ করে নিজের মাল্টিডাইমেনশনাল প্রতিভার পরিচয় দেন। একটা সময় ছিল যখন টেলিভিশনের সামনে বসে শাবানা-র অভিনয় দেখে মা-বোনেরা কেঁদে বুক ভাসাত। কান্নার অভিনয়ে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, এ প্রসঙ্গে পরিচালক আমজাদ হোসেন বলেছেন-‘শাবানার চোখের পানির দাম কোটি টাকা।’

শাবানার প্রখর অভিনয়শক্তির কিছু ছবি – মরণের পরে, ভাত দে, ছুটির ঘণ্টা, রাঙ্গা ভাবী, দুই পয়সার আলতা, অবদান, নাজমা, অপেক্ষা, সান্ত্বনা, সখি তুমি কার, মাটির ঘর, অশান্তি, কাজের বেটি রহিমা, ঘরে ঘরে যুদ্ধ, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, সখিনার যুদ্ধ, বাংলার বধূ, বাংলার মা, মা ও ছেলে। ‘মরণের পরে’ ছবিতে সন্তানদের দত্তক দিয়ে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা শাবানা এবং পানি না খেতে পেয়ে মারা যাওয়ার করুণ দৃশ্যের অভিনয় ভুলবে সাধ্য কার! ‘ভাত দে’ ছবি তো দেশের চলচ্চিত্রে ওয়ান পিস। ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার, ভাতের জন্য সামাজিক অপমান সহ্য করে টিকে থাকার সংগ্রাম করা, অন্যের বাড়ি থেকে ভাতের হাঁড়ি চুরি করা, দোকান থেকে কলার কাঁদি চুরি করে পালানো, ভাতের হোটেলে কাস্টমারের সামনে মলিন বদনে দাঁড়ানো এসব জীবন্ত অভিনয় শুধুমাত্র শাবানাকে দিয়েই সম্ভব।

‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ ছবির বড়বউয়ের চরিত্রে বাপ্পারাজের মায়ের মতো বউদির উপস্থাপন শাবানাকে দিয়েই প্রাণ পেয়েছে। ‘দুই পয়সার আলতা, সখিনার যুদ্ধ’ এসব ছবির অভিনয়ই বা কে ভুলতে পারে! ‘অবদান’ ছবির অসাধারণ সে বোন যে তার ভাইবোনদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছিল। ‘কাজের বেটি রহিমা’ ছবির রহিমার চরিত্র যে আজও হাজার হাজার নির্যাতিতা কাজের মেয়ের প্রতীক তার গুরুত্ব তো অনেক। ‘স্বামীর আদেশ’ ছবির সাধারণ গল্পটি অসাধারণ হয়ে উঠেছিল শাবানার অভিনয়ে। একজন মায়ের শেষ বয়সের মনের ইচ্ছা, সন্তানদের জন্য ত্যাগ স্বীকারের অসাধারণ অভিনয় করেছেন ‘ঘর দুয়ার’ ছবিতে। ‘বিরোধ’ ছবিতে বলিউডি অভিনেতা রাজেশ খান্নার সাথে অভিনয় করেছেন যে ছবিতে নিজের অভিনয়শক্তিতেই নিজেকে চিনিয়েছেন। ‘অশান্তি, মান-সম্মান’ ছবির অ্যাকশন ভূমিকায় ও স্টাইলিশ গেটআপে শাবানা ছিলেন ব্যতিক্রমী। শাবানার ক্যারেক্টারাইজেশন এভাবেই অমর।

শাবানা-র জুটি সব অনন্য। বাণিজ্যিক ছবির সব মহীরুহ তারকাদের সাথে তাঁর জুটি গড়ে উঠেছিল। আলমগীরের সাথে শাবানার জুটি দেশের চলচ্চিত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এ জুটির জাদুকরী রসায়নে একটা লম্বা সময় ধরে রাজত্ব চলেছে। এই জুটির শতাধিক ছবি আছে। রাজ্জাক, জসিম, সোহেল রানা-দের সাথে তাঁর জুটিও সফল ছিল। ক্যারিয়ারের শেষভাগের প্রায় সব ছবিই ছিল জসিমের বিপরীতে। দেশ পেরিয়ে বিদেশেও শাবানা তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ছড়িয়েছেন। পাকিস্তানি নায়ক নাদিমের বিপরীতে তাঁর জুটিও ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। তাঁদের ‘চকোরী, ঝড় তুফান, বশিরা, আনাড়ি’ ছবিগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

শাবানার ছবির গানই সবচেয়ে বহুল সংখ্যক জনপ্রিয়তা পেয়েছে ঢালিউডে। অনেক নায়কের বিপরীতে তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান তো আছেই তাছাড়া নিজের একক লিপের গানও বহুল জনপ্রিয়।

শাবানা শেষ পর্যন্ত একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রী যার সুবিশাল চলচ্চিত্রকর্ম দেখে একজন চলচ্চিত্র শিল্পী অনায়াসে অনুপ্রেরণা পেতে পারে, তাঁর অভিনয় দেখে অভিনয় শিল্পের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে পারে। শাবানা নামটি আমাদের প্রতিনিয়ত গর্বিত করে।

বি : দ্র : লেখাটি তৈরি করতে ড. অনুপম হায়াৎ প্রদত্ত তথ্য, ইন্টারনেটের সহায়তা ও ব্যক্তিগত স্মৃতি-বিশ্লেষণ যোগ করা হয়েছে।


মন্তব্য করুন