শিকল ভাঙার গান ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’
দিগন্ত জোড়া মাঠ, সবুজ ধান খেতের মিষ্টি বাতাসে মুখরিত চারিদিক, পাশে বয়ে চলা শান্ত নদী, সঙ্গে পুকুর ভরা মাছ আর নারিকেল তাল গাছের সারি। যেন শিল্পীর আঁকা কোন ছবি। খেজুর গাছের রসের হাঁড়ির চুঁইয়ে পড়া রস আর আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ, গেরস্ত বাড়ির উঠোনে বউ-ঝিদের ধান মাড়ানো, বাড়ির মুরব্বিদের হুক্কার টান, জোয়ানদের কাঁধে জাল জড়িয়ে মাছ ধরতে যাওয়া…
আহারে আমার আবহমান গ্রাম বাংলার রূপের মেলা। যেন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে মায়ের পবিত্র মুখ, দেশ আর মা— যেন পৃথিবীর সব থেকে ভালোবাসার পবিত্র স্থান। এই দেশপ্রেম ও ভালোবাসা থেকে এসেছে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। তেমনই একটি সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ থেকে নেওয়া চাষী নজরুল ইসলামের একই নামের চলচ্চিত্রটি।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক ত্যাগী মায়ের সত্য ঘটনা অবলম্বনে সেলিনা হোসেন উপন্যাসটি রচনা করেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশের পর মনে এতটাই দাগ কাটে যে ভারতীয় নির্মাতা সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট সেলিনা হোসেনকে এক চিঠিতে তিনি এ উপন্যাসের প্রশংসা করেন এবং চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার আশা পোষণ করেন, অবশ্য তা আর হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে গুণী পরিচালক মরহুম আলমগীর কবির সাহেব ‘হাঙর নদী’ নামে রঙিন ১৬ মিমি ফরম্যাটের ফিল্ম তৈরি শুরু করেন। যেখানে অভিনয় করেন সালমান শাহ ও তার মা। তবে সেই ছবি অসমাপ্ত রয়ে যায়।
এর ১০ বছর পর আরেক গুণী পরিচালক মরহুম চাষী নজরুল ইসলাম সাহেব সরকারি অনুদান নিয়ে ১৯৯৫ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নির্মাণ শুরু করেন, মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর। অসাধারণ নির্মাণের গুনে চাষী শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন, শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হন ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন।
আবহমান বাংলার ছোট্ট হলদে গ্রাম, সেই গ্রামের এক দুরন্ত কিশোরী বুড়ি (সুচরিতা), যার অল্প বয়সেই বিয়ে হয় অনেক বেশি বয়সের গফুর (সোহেল রানা)-র সঙ্গে। গফুরের আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল, সে ঘরে আছে সলিম (দোদুল) ও কলিম (আশিক) নামের দুটি সন্তান আছে। স্ত্রী মারা গেলে অল্প বয়সের অবুঝ বুড়িকে বিয়ে করে গফুর। সলিম ও কলিম ছিল তার খেলার সাথি, বুড়ি এতটাই অবুঝ— বিয়ের পর সে যে তাদের মা হয়ে গেল এটা কিছুতেই বুঝতে চাইতো না। এক সময় সন্তানের জন্য আকুল হয়ে উঠল, অবশ্য কলিম আর সলিমকে সে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবেসেছে, তারপরও তার নিজের সন্তান চাই। এক সময় বুড়ির কোল জুড়ে আসে সন্তান রইস (বিজয় চৌধুরী)। কিন্তু রইস কথা বলে না, শোনে না শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বুড়ির অনেক সাধনার সন্তান রইস বড় হয় বাক-প্রতিবন্ধী হিসেবে।
বুড়ির আফসোস— কলিজার টুকরা রইস কিছুই করতে পারে না, হাত দিয়ে খেতে পারে না, মাছ ধরতে পারে না, সাঁতার কাটতে পারে না, কী কাজে আসবে রইস। বুড়ি এই সব দুঃখ রাখার জায়গা পায় না। এর মধ্যে একদিন অসুস্থ হয়ে গফুর মারা যায়। তারপর কেটে যায় অনেক দিন। ছেলেরা বড় হয়, সলিমের বিয়ে দেয় বুড়ি, ঘরে আসে নতুন বউ রমিজা (অন্তরা)। এদিকে সারা দেশে শুরু হয় গন্ডগোল, নীরবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে গ্রামের যুবকেরা। তারই প্রেক্ষিতে সলিম চলে যায় যুদ্ধে। ছোট ভাই কলিমকে রেখে যায় মা, রইস আর বাড়ি দেখে রাখার জন্য। কিন্তু রাজাকার নাসির খানের কারণে পাকিস্তানিদের দোসররা এই খবর পেয়ে পাকিস্তানি মেজর কলিমকে ধরে ফেলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য কলিমকে তার মা বুড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করে। নির্বাক বুড়ি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে।
যুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। রমিজার বাবা নিরাপত্তার জন্য মেয়েকে নিয়ে যায়। এত বড় বাড়িতে ছোটবেলার সই বৈষ্ণবী অরুণা বিশ্বাস ও রইসকে নিয়ে পড়ে থাকে বুড়ি। এক রাতে অপারেশন চালিয়ে পাক বাহিনীর তাড়া খেয়ে দুই মুক্তিযোদ্ধা বুড়ির বাড়িতে আশ্রয় চাইলে বুড়ি তাদের নিজ ঘরে লুকিয়ে রাখে। ধাওয়া করা পাকিস্তানি বাহিনীরাও পৌঁছে যায়। দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় সামনে দাঁড়ায় একজন মা, কঠিন হয়ে পড়ে সে। বুকে পাথর সমান কষ্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের সন্তান রইসকে তুলে দেয় ন্দুকের নলের মুখে। বাক-প্রতিবন্ধী রইস কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বন্দুকের দিকে। এক সময় বন্দুকের গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে যায় রইসের বুক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রইস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কী নির্মম করুণ আত্মত্যাগ একজন মায়ের, যে কিনা নিজের কলিজার টুকরা ছেলের জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়ে দেন দুজন মুক্তিযোদ্ধাদের। আর রইস, যে কিনা কোন কাজই করতে পারতো না সেই রইস মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়ে নিজের তাজা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে বাংলার স্বাধীনতা। নিথর রইসের দেহ হয়তো মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু বাংলার আকাশে উড়তে থাকে লাল-সবুজের স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা!
লাখো সালাম সেই সব রইস আর ত্যাগী মা-বোনদের যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারো জন’-এর সফল প্রযোজক ছিলেন মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) আর পরিচালক ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। একে ধরা হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের দলিল হিসেবে। তবে সে ছবিটিতে সোহেল রানা নিজে অভিনয় না করলেও ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এ চাষী সাহেবের পরিচালনায় অভিনয় করলেন গফুর নামে গ্রামের খেটে খাওয়া এক কৃষক চরিত্রে। কী ন্যাচারাল সেই অভিনয়, যতবার দেখি ততই মুগ্ধ হতে হয়। একজন কৃষক চরিত্রে সোহেল রানার হাল চাষ করা, চার দিয়ে মাছ ধরা, নৌকা বাওয়া, বৃদ্ধ বয়সে হুক্কা খাওয়া, আসলেই তার এই অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতে হয়!
প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা সুচরিতার অভিনয় কী দিয়ে মাপা যায়? তিনি যে কত বড় মাপের অভিনেত্রী তা ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ না দেখলে অনেকে বিশ্বাসই করতে চাইবেন না! যদিও সুচরিতার অভিনয়ের তুলনা হয় না, তবে এই বুড়ি চরিত্রে অভিনয় যেন তার আগের করা সব চরিত্রকে ছাপিয়ে গেছে। এক চঞ্চল তরুণীর সারা গ্রাম চষে বেড়ানো থেকে অল্প বয়সে বউ হওয়া, মুক্তিযুদ্ধকে মনের মধ্যে লালন করা, আর মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য নিজের কলিজার টুকরা বাক-প্রতিবন্ধী সন্তানকে বন্দুকের সামনে তুলে দেওয়ার যে ত্যাগী চরিত্রে অভিনয় তা ছিল শুধু নিশ্চুপ হয়ে দেখার মতো অবস্থায়! কী চমৎকারভাবেই না তিনি তুলে ধরলেন ত্যাগী মায়ের চরিত্র। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বুড়ি চরিত্রে অভিনয় দেখে চোখের কোণে পানি আসেনি এমনজন হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুচরিতা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে গেঁথে থাকবেন এই চরিত্রে অসামান্য অভিনয় দিয়ে। তার অভিনয় জীবনে শ্রেষ্ঠ কাজের একটি দলিল হয়ে থাকবে ছবিটি, তাইতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল বাক-প্রতিবন্ধী রইস। এ চরিত্রে বিজয়ের অসাধারণ অভিনয়ও মনে রাখার মতো। অন্যান্য চরিত্রে দোদুল, অন্তরা, ইমরান, রাজিব, নাসির খান, মিজু আহমেদসহ প্রত্যেকেই চমৎকার অভিনয় করেছেন। সবার অসাধারণ অভিনয় ছবিটিকে করেছিল দারুণভাবে সমৃদ্ধ!
এক নজরে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’; পরিচালক: জনাব চাষী নজরুল ইসলাম; চিত্রনাট্যকার: চাষী নজরুল ইসলাম; কাহিনি: সেলিনা হোসেন; সুরকার: শেখ সাদী খান; চিত্রগ্রাহক: এ এইচ পিন্টু; সম্পাদক: সৈয়দ মুরাদ; পরিবেশক: চাষী চলচ্চিত্র; মুক্তির তারিখ: ২১ নভেম্বর ১৯৯৭; দৈর্ঘ্য: ১১৩ মিনিট; ভাষা: বাংলা; অভিনয়: সোহেল রানা (গফুর), সুচরিতা (বুড়ি), বিজয় চৌধুরী (রইস), অরুনা বিশ্বাস (বৈষ্ণবী), দোদুল (সলিম), অন্তরা (রমিজা), রাজিব (রমজান আলী), শওকত আকবর (বুড়ির বাবা), শর্মিলী আহমেদ (বুড়ির মা), মিজু আহমেদ (পাকিস্থানি মেজর), নাসির খান, ইমরান, আশিক, চাষী নজরুল ইসলাম (রমিজার বাবা), উল্লেখ্যযোগ্য গান: শিকল ভাঙার গান গেয়ে যা প্রাণেরই একতারা।