শিকারি : নায়কপ্রধান শিকারের অ্যাডভেঞ্চার
যৌথ সিনেমার নিয়ম নিয়ে তখন অনেক কথা হচ্ছিল।কথা না হলে সমাধান আসে না তাই কথা চলতেই থাকল। অান্দোলন হলো।পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হলো। ন্যায্য দাবি হিশেবে দর্শকের একটাই দাবি তখন, সঠিক নিয়মে যৌথ প্রযোজনা হতে হবে।শেষে শাকিব খান ঢালিউডি শীর্ষ নায়ক হিশেবে যৌথ প্রযোজনার সিনেমাতে চুক্তিবদ্ধ হওয়াতে শোরগোল পড়ল। শাকিব খানের অান্দোলন নিয়ে মিশ্র সমালোচনা অাবারও শুরু হলো তবে ভুল মানদণ্ডে বেশিরভাগ সমালোচনা হয়েছে। সত্যটা ছিল শাকিব খান অান্দোলন করেছে সঠিক যৌথ প্রযোজনার জন্য, বিপক্ষে বলেনি সেটাই অনেকের বুদ্ধিতে কুলায়নি।
সে যাই হোক সিনেমার স্যুটিং এর সময় থেকেই খবর অাসছিল মিডিয়ার বরাতে যে শাকিব খান ডেডিকেটেড শিল্পী।সে গা পুড়ে যাওয়া গনগনে রোদে ডেডিকেটেড শিল্পীর মতোই শুয়ে পড়তে পারে কয়লার খনিতে।পরিচালক মহাশয় দারুণ খুশি।ইউনিট তাকে বাহবা দিচ্ছে।এভাবে ‘শিকারী’ সিনেমার ঘটনায় নায়কপ্রধান একটা ইমেজ থেকে যায়।সিনেমা দেখার পর এই বিষয়টি আরো শক্ত হয়ে ওঠে।
নায়কপ্রধান সিনেমা বিশ্বের সব ইন্ডাস্ট্রিতেই অাছে।সেসূত্রে অামাদের ইন্ডাস্ট্রিতেও অাছে।রাজ্জাক, জসিম, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রিয়াজ সবারই নায়কপ্রধান সিনেমা অাছে।তবে তফাতটা হলো যৌথ প্রযোজনায় নায়কপ্রধান কম।এক্ষেত্রে গল্পপ্রধান হওয়ার সুযোগটা থেকেছে বেশি। ‘শিকারী’-তে শাকিব খানের ক্ষেত্রে তা ঘটল না।
‘শিকারী’ সম্পূর্ণভাবে একজন নায়ক তার surrounding -এর মধ্যে ঘরে-বাইরে মানসিক যুদ্ধে টিকে থাকা একটি সিনেমা।সে গল্পে নায়কের ভূগোলকে পূর্ণতা দিতে তার চারপাশের চরিত্রগুলোর একটা অবদান অাছে।সব চরিত্রের মাধ্যমেই নায়ক শিকারী হয়ে ওঠে, একা একটি চরিত্রের জন্য নয়।শাকিব খান নিজের জগতে তাই অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে ওঠে।তার ঘরে-বাইরে সমান যুদ্ধ করতে হয় টিকে থাকার জন্য।মানসিকভাবে টিকে থাকার মুহূর্তগুলোতে তাকে time and space অনুযায়ী নানা রূপে তারই চারপাশের জগতে মিশতে হয়েছে।সেগুলো ছিল এমন –
* কখনো সন্তান
* কখনো খুনী
* কখনো বোকা
* কখনো চালাক
* কখনো কৌশলী
* কখনো রোমান্টিক
* কখনো আবেগী
* কখনো স্ববিরোধী
* কখনো পারিবারিক
* কখনো প্রতিশোধপরায়ণ
এতগুলো অস্তিত্বের সাথে তাকে একা যুদ্ধ করতে হয়েছে মনে মনে। তার সবকিছু মেনে নিয়ে তবেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। শিশুদের গুম করে তাদের কঙ্কাল উদ্ধারের পর জাজ সব্যসাচীর হাতে বিচারের কাজ এলে তাকে চ্যালেণ্জ নিতে হয়। জাজ তখন শত্রুপক্ষ রাহুল দেব রায়ের টার্গেট হয়ে পড়ে। তখনই তাকে মারার জন্য কিলার নিয়োগ করা হয়। শাকিবের পালক পিতা সুপ্রিয় দত্ত সব ঠিক করে দেয়। শাকিব তার শিকারে গিয়ে সব্যসাচীকে মারতে পারে না নিজের জন্যই। কারণ তার সাথে তার সম্পর্কটা গভীর। ইচ্ছে করেই টার্গেট মিসের পর শাকিব পুলিশের চোখকে ধুলো দিয়ে পালায়। পালানোর মধ্য দিয়েই তার অ্যাডভেঞ্চার যথারীতি শুরু হয়ে যায়।
এরপর শাকিব ধীরে ধীরে তার সেই শিকারের surrounding-এ ঢুকে পড়ে। অনেক প্রশ্ন জমা হয় এখানে, প্রশ্ন করাও হচ্ছে।বলা হচ্ছে জাজের সাথে শাকিবের সম্পর্কটা গভীর তারপরেও শাকিব কেন জাজকে খুন করতে তার বাড়িতে গেল। এখানে উত্তরটা সোজা –
* জাজকে রক্ষা করার জন্য
* জাজকে খুনের অভিনয় করে শত্রুপক্ষকে তার কাজ বুঝিয়ে দেয়া
এ দুটি অংশেই শাকিবের নায়ককেন্দ্রিক ইমেজ পরিষ্কার।তাকে তার শেকড়ের কাছে যেতে শত্রুকে বশ মানাতে হয়েছে।
রাহুল দেব রায় যখন ক্রুদ্ধ হয়ে সুপ্রিয় দত্তের কাছে অাসে অার শাকিবকে দোষারোপ করে শাকিব হঠাৎ রেগে যায়।এটা ছিল তার টেকনিক।নিজের ডেডিকেশন বোঝানোর জন্য এটা সে করে।নেগেটিভের মাধ্যমে পজিটিভের attitude বোঝানো যাকে বলে।তারপর সোজা জাজের বাড়ি।
সমালোচনা অাসতেই পারে বড় বাজেটের সিনেমা হয়েও একটা বাড়িতে অর্ধেক দৃশ্যে কাজ সারা হলো কেন? উত্তরটা হলো বাড়িতে যা ঘটেছে বা দেখানো হয়েছে সেট ইনডোর স্যুটের ধারাবাহিকতায় হয়েছে। সেটা ছাড়া সিনেমাটা অসম্পূর্ণ হতো।জাজের বাড়িতে গল্পের জট খুলতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শাকিব অাগে থেকেই তার সবকিছু জানে তারপরেও সে এসেছে। যাকে খুন করতে এসেছে তার মাধ্যমে নিজেকে খুঁজতে এসেছে।বাড়িতে ঢুকতেই শ্রাবন্তীর গান ভেসে এল ‘মম চিত্তে। ‘চুটকির ছায়ায় শ্রাবন্তী তার ছোটবেলার সাথী। রোমান্টিক অাবহ গল্পে নতুনত্ব অানল। বাড়িতে ঢুকে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠা, বড়মা লিলি চক্রবর্তীর জন্য দোকতা পাতা অানা, রান্নার জন্য কথাবার্তা, সব্যসাচীর প্রতি তার দায়িত্ববোধ সবকিছুর মধ্যে প্রবেশ করে শাকিব তার শিকারের জগতে অাস্তে অাস্তে এগিয়ে যায়। তারপর রাতভর, দিনভর বোম তৈরি ও জাজকে মারার পরিকল্পনা করে শত্রুপক্ষকে বোঝানো অার টেকনিক্যালি নিজের চেষ্টায় সেই জাজকেই বাঁচানোর কৌশলে শাকিব অদ্ভুত এক সাইকোলজিতে অাটকা পড়ে।
খরাজ মুখার্জীর সাথে শাকিবের দেখা হয় বেশ অায়োজনের মাধ্যমে। খরাজ তার নিজের স্বাভাবিক অভিনয়দক্ষতায় দর্শক হাসানোর কাজটা করে। কমেডি অংশটি গল্পে দর্শককে freshness দেবার জন্যই রাখা হয়। খরাজের সাথে শাকিবের কম্বিনেশন অনবদ্য ছিল। তারা দুজনে একটা জার্নির ভেতর দিয়ে যায় যেখানে একজন পরিবার ধ্বংস করতে চায় অার একজন চায় বাঁচাতে। অথচ নায়ক নিজেও চায় বাঁচাতে কিন্তু নিজের সাথে যুদ্ধ করে।
শ্রাবন্তী কিছুটা অাঁচ করতে পেরেছিল গীটারে বোম রাখার ঘটনায়। সেখানেও শাকিব তার বুদ্ধি ও অাবেগ দুটোই খাটায়। বুদ্ধি হলো তাকে মারার কথা বলে ছাদে নিয়ে যায় এবং চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে যায়। তারপর ছোটবেলায় তোলা ছবি দেখিয়ে রাঘবরূপী তার ফিরে অাসার কথা বলে অাবেগ দিয়ে।শ্রাবন্তীর হাত থেকে পুলিশকে দিতে চাওয়া মোবাইলটা নিয়ে নেয়। আবার বাইরে এসে কাঁদতে থাকা খরাজকে বলে ওটা ছিল অভিনয়। শিকারের গল্প ঘোলাটে লাগলেও সেটাই তখন অাকর্ষণীয়।
শ্রাবন্তীর সাথে রোমান্টিক সময়টা তখনই দানা বাঁধে। ছোটবেলার এলাটিং বেলাটিং খেলার কথা বলাতে শাকিব ছড়া কাটে –
‘এলাটিং বেলাটিং সইলো
কিসের খবর অাইলো
রাজামশাই
একটি বালিকা চাই।’
‘অার কোনো কথা না বলে’ অসাধারণ গানটি সে সিকোয়েন্সের সাথে তখন পারফেক্ট ছিল।শ্রাবন্তী শাকিবের পাশে থাকে এরপর থেকেই ভালোবেসে।তার সাথে যোগ হয় বড়মা লিলি চক্রবর্তী।শেষে সব্যসাচীকে ধরতে অমিত হাসানই চালটা চালে যার আরেক সাগরেদ শিবা সানু।সব্যসাচীকে বাঁচাতে নাটক করতে হয় শাকিবকে।শাকিব ইনজুরড হলেও শেষে নায়কের জয় হয় শিকারী-র গল্পের পূর্ণতার জন্যই।
এই psychological family action drama-তে শাকিব খান প্রফেশনাল অভিনয়দক্ষতা দেখিয়েছে। তাকে প্রতি মুহূর্তে সুইচ অন অফ করে বোকা, চালাক, কমেডি, অ্যাকশনে থাকতে হয়েছে। তার এন্ট্রি সিনে স্পিডবোডে রাজসিক ভঙ্গিতে বাংলাদেশী সুলতানের ট্যাটুপরা শাহরুখীয় ‘ডন-২’-এর অনুপ্রাণিত স্টাইলে অসাধারণ লেগেছে। সব্যসাচীর দিকে চটি এগিয়ে দিয়ে পাসপোর্ট দেখানোর পরে মুহূর্তেই বিনীত শাকিবের এক্সপ্রেশন হয়ে যায় ক্রুদ্ধ। আবার শ্রাবন্তী শাকিবের মোবাইল ঘাঁটার সময় পেছনে অাসা শাকিব বলে ‘এখানে কি করছেন মেমসাহেব?’তারপর শ্রাবন্তীু মুখ ঘোরাতেই শাকিবের অ্যাটিচিউড যায় পাল্টে। মেপে মেপে অভিনয় করেছে সে। গানগুলোতেও ছিল নায়কোচিত। সম্পূর্ণ নতুন লুকে শাকিবকে নতুন করে মিলেছে। সব্যসাচী চক্রবর্তী তাঁর প্রফেশনাল অভিনয় করেছে। দরাজ কণ্ঠের সংলাপে তাঁর অভিনয় অনবদ্য। রাহুল দেব রায় দক্ষিণী ও বলিউড-টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা বড় শিল্পী তাই অভিনয় প্রফেশনাল। এ ধরনের শিল্পীরা কাজপাগল। শ্রাবন্তীর স্পেস প্রয়োজনমতোই ছিল এবং সে ডেডিকেটেড। সুপ্রিয় দত্ত, অমিত হাসান, লিলি চক্রবর্তী, সুব্রত এবং বাকি চরিত্রগুলোও যার যার জায়গায় দারুণ ছিল।
সিনেমায় চরিত্রের সমাবেশ অনেক এবং সবগুলোই ছিল শাকিবের শিকারকেন্দ্রিক। নায়কের গল্পের পূর্ণতা দিতেই বাকিসব অায়োজন। যৌথ প্রযোজনার এ সিনেমায় নায়ককেন্দ্রিক বিরাট কলেবরে ঘরে-বাইরে শাকিব খানের একটা অ্যাডভেঞ্চার ঘটে যায়। আর এর মধ্য দিয়ে ঢালিউড-পেয়ে যায় নতুন শাকিব খানকে।