Select Page

সম্রাট শাহজাহান, আপনি মুড়ি খান!

সম্রাট শাহজাহান, আপনি মুড়ি খান!

নাম : পবিত্র ভালোবাসা
ধরন :  রোমান্টিক ড্রামা
পরিচালক : এ.কে সোহেল
কাস্ট : রোকন উদ্দিন (রাহুল/রাজা), মাহিয়া মাহি (রোজী), মৌসুমী (মায়া দেবী/রানী), ফেরদৌস (দীদার পাশা), রেবেকা রউফ (দীদার পাশা’র ফুফু), আফজাল শরীফ (মায়া দেবীর মামা), ইলিয়াস কোবরা (দীদার পাশা’র দেহরক্ষী) প্রমুখ
প্রযোজনা : চাঁটগা ফিল্মস প্রডাকশন লি.
মুক্তি : ৫ অক্টোবর, ২০১৮

নামকরণ :

এই সুন্দর পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা মানবজাতি কে কোনো জাত-পাত ভেদাভেদ করে পাঠায়নি। কাউকে কালো বানিয়েছেন, কিংবা কাউকে ফর্সা। কাউকে বুদ্ধিমান বানিয়েছেন তো কাউকে বোকা; কিন্তু সবার দেহে বইছে একই রঙের রক্ত, লাল। জাত-পাত-ধর্ম এগুলো সবকিছুই মনুষ্যসৃষ্ট, ভালোবাসার পবিত্রতা কোনভাবেই ধর্মের ভেদাভেদ দিয়ে নষ্ট করা যায় না। এ ছবির নামকরণ হিসেবে “পবিত্র ভালোবাসা” যথার্থ।

কা.চি.স (কাহিনী+ চিত্রনাট্য+ সংলাপ) :

একটি গ্রামের সমস্ত বিচারকার্য পরিচালনা করে দুই ভিনধর্মী পঞ্চায়েত প্রধান। মায়া দেবী, যিনি হিন্দু পঞ্চায়েত কমিটির প্রধান, এবং দীদার পাশা, যিনি মুসলিম পঞ্চায়েত প্রধান। এই দুজন ছোটবেলা থেকেই একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। কিন্তু যেহেতু তারা দুজন ভিন্নধর্মের, উভয়েই স্বনামধন্য পরিবারের সন্তান এবং এরা সবাই বংশপরম্পরায় গ্রামের বিচারকার্য পরিচালনা করে আসছে… তাই শুধুমাত্র সমাজের কথা ভেবে তারা কখনো তাদের ভালোবাসাকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি।

রাহুল হলেন মায়া দেবীর ভাই। বিলেত ফেরত ছেলেটি গ্রামে এসেই ‘রোজী’ নামক এক সুন্দরী মুসলিম মেয়ের ওপর crush খায়। এবং মেয়েটি হলো দীদার পাশার বোন। এরপর বিভিন্ন পন্থায় রাহুল রোজীকে পটানোর চেষ্টা করে; একপর্যায়ে রোজী রাহুলের আঁতলামীর সুযোগ পেয়ে তার নিকট তাজমহল চেয়ে বসে, যেমনটা সম্রাট শাহজাহান তার ভালোবাসার তাগিদে তৈরী করেছিলেন। এরপর রাহুল সেই অসম্ভব কাজটি সম্ভবও করে ফেলে(!) কীভাবে করেন, সেটা আমি বলবো না। তবে এছবিতে তাজমহল বানানো “Ten minutes school” টাইপ কার্যপদ্ধতি দেখে আমার পিলে চমকে গেছে! সম্রাট শাহজাহান যদি এই পদ্ধতি জানতেন, তাহলে আর সব শ্রমিকদের আঙ্গুল কেটে নিতেন না। আর পুরো দুনিয়াতে তিনি হাজার হাজার তাজমহল বানাতেন।

এরপর রাহুলের অসাধ্য সাধন দেখে রোজী পটে যায়। কিন্তু বিধি বাম, এরপরই শুরু হয় সমাজের অশান্তি। মায়া দেবী এবং দীদার পাশা কোনভাবেই এ বিয়ে তে রাজি হয় না। শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। এরপর দুইটি টুইস্ট আসে গল্পে। যার একটি তে বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটলেও রাহুল আর রোজী কে বাঁচানো যায় না। তারা একসাথে মারা যায়।

নাহ… এখানে আমি বিন্দুমাত্র স্পয়লার দেইনি। চাইলে মিলিয়ে দেখতে পারেন, এসব কিছুই সত্ত্বেও “পবিত্র ভালোবাসা” টিম তার আড়াই মিনিটের টিজার এবং সাড়ে তিন মিনিটের ট্রেইলারে দেখিয়ে দিয়েছে। যা দেখিয়েছে এর বাইরে ১৩৬ মিনিটের (২ ঘন্টা ১৬ মিনিট) ছবিতে আর তেমন কিছু নেই, দুইটি টুইস্ট ছাড়া।

স্ক্রিনপ্লে ছিল অনেক অগোছালো, অসংগতিপূর্ণ। জানি না এছবি বিনা কর্তনে সেন্সর ছাড়পত্র পেয়েছে কিনা, তবে দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে সেন্সর বোর্ড অনেক জায়গায় কাঁচি চালিয়েছে। যার দরুণ এ অবস্থা।সংলাপ ছিল মাত্রাতিরিক্ত ড্রামাটিক! আফসোস হয় ২০১৮ সালে এসেও আমরা ৮০ এর দশকের মতো সংলাপ শুনতে পাই। হ্যাঁ, যদি পিরিয়ড ড্রামা হতো, তবে it’s ok। কিন্তু এছবির গল্প বর্তমান সময়ের।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ১০।

অভিনয় :

এই সেক্টরটায় আমি চরমভাবে হতাশ। একেকজন অন্যান্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে অভারএ্যাকটিং করেছেন। মনে হচ্ছিল প্রত্যেকে অভারএ্যাকটিং এর দোকান খুলে বসেছে! আর যাই হোক অন্তত আমি মাহিয়া মাহি, মৌসুমী এবং ফেরদৌসের কাছে স্বাভাবিক অভিনয় আশা করেছিলাম। কিন্তু মাহির অতিরিক্ত ন্যাকামি, আর মৌসুমী এবং ফেরদৌসের উচ্চস্বরে ডায়লগ ডেলিভারি, কথায় কথায় চিতকার-চেঁচামেচি; সবমিলিয়ে একপ্রকার বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সাথে নতুন নায়ক রোকন তো ছিলেনই। তিনি একদমই নবাগত, তাই তার সম্পর্কে আমার অভিযোগ তুলনামূলক কম। তবে তার অভিনয়ে অনেক-অনেক কিছু শেখার বাকি আছে।

আমার মতে, মিডিয়ায় যারা এভাবে কমার্শিয়াল ছবির নতুন হিরো তুলে নিয়ে আসছেন তাদের এইমূহূর্তে চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনা উচিত। চেহারা নয়, অভিনয় দক্ষতা দিয়ে যাচাই করে নেওয়া উচিত। শুধু good looking হলেই যে সে একদিন সিনেমা হল কাঁপাতে পারবে, এই ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলা উচিত। এমনটাই যদি হতো, তাহলে বর্তমানে সাউথ ইন্ডিয়ায় এক মহেশ বাবু ছাড়া আর কোনো সুপারস্টার থাকতো না।

আফজাল শরীফ, রেবেকা রউফ এবং ইলিয়াস কোবরা তাদের স্বভাবসুলভ পারফরমেন্স দিয়েছেন। বাকি যারা ছিলেন তাদের অভিনয় সম্পর্কে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। আমার just ঐ সময় হালের ট্রেন্ড খ্যাত “মেরিন সিটি” বিজ্ঞাপন টার কথা মনে পড়ছিল।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৫।

কারিগরি :

এর আগে আমি পরিচালক এ.কে সোহেলের দুইটি কাজ দেখেছি। প্রথমটি, খায়রুন সুন্দরী (২০০৫) এবং দ্বিতৗয়, বাংলার বউ (২০০৭)। দুইটি ছবিতেই গ্রামৗণ সংস্কৃতির আলাদা একটা টান ছিল। গ্রামৗণ পরিবারের নানারকম খুটিনাটি বিষয়াদি দেখানোর চেষ্টা ছিল। আপসোস ডিজিটাল প্লার্টফর্মে এসে অন্য ৫/১০ জন পরিচালকের মতো উনিও তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।

এই অংশের প্লাস পয়েন্ট বলতে গেলে চট্টগ্রামের কিছু পাহাড়ী এলাকা এবং উপত্যকার লোকেশন। এছাড়া বাকি সব দিক থেকেই আনাড়িপনার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান থাকেন ডুপ্লেক্স বাড়িতে(!) তাজমহল বানানো হলো কার্ডবোর্ড দিয়ে। তাও সেটা প্রথম দিকে বোঝা যাচ্ছিল না। এরপর সিনেমাটোগ্রাফার একটু ক্রিয়েটিভিটি দেখাতে চাইলেন। এমনভাবে ক্যামেরা এঙ্গেল করলেন, আর কিছু বোঝা বাকি রইলো না। বেশ কিছু সিনে আমি সেই পুরোনো ৩৫ মি.মি এর feel পাচ্ছিলাম। অর্থাৎ ক্যামেরা কোয়ালিটি পুরো ছবিতে একরকম ছিল না। এডিটিং এর কথা কি বলবো… অন্তত এ ছবিটি দেখলে FDC লোকেদের বুঝে আসতো, কেন আমাদের দেশের ছবির পোস্ট প্রডাকশনের কাজ দেশে না করে বাইরের বাইরে গিয়ে করানো হয়। BGM এ অভিজ্ঞ ইমন সাহা নতুন কিছুই করেননি। তার তৈরী করা পুরোনো সুর গুলোই তিনি এছবিতে জুড়ে দিয়েছেন। “সুলতানা বিবিয়ানা”, “অনেক দামে কেনা” সহ আরো বেশ কিছু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তিনি এখানে ব্যবহার করেছেন।

এ ছবির জন্যে হয়তো কেউ লিপস্টিক ফ্যাক্টরি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, শিশু হোক, বুড়ো হোক… যে যত পারে, তত ঠোঁটে মেখেছে। এ্যাকশন সিক্যুয়েন্স ও ভালো হয়নি। অবশ্য এই জায়গায় আমরা বরাবরই যথেষ্ট দূর্বল।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ১০।

বিনোদন :

ছবিতে গান রয়েছে মোট ৪ টি। গান তেমন কোনোটাই শ্রুতিমধুর লাগেনি; জঘন্য লেগেছে রন্টি দাশের গাওয়া “ইশ ইশ রূপসী” গানের কোরিওগ্রাফি। এছাড়া হলে বসেই “টাঙ্কি মারি মারি” গানটি র সুর কেমন যেনো পরিচিত মনে হচ্ছিল। বাসায় এসে একটু ঘাটাঘাটি করেই পেয়ে গেলাম! ভারতের কুমুদ চন্দ্র বড়ুয়ার গাওয়া আসামী গান “প্যাডেল মারি মারি” এর সুর হুবহু কপি করা হয়েছে।

কমেডি সিক্যুয়েন্স তেমন একটা ছিল না, সে তুলনায় ভাঁড়ামো ই বেশি হয়েছে। একবার ভাবুন, কারো প্রেমের প্রস্তাবে সায় দেওয়ার পর যদি কেউ আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার crush এর বান্ধবীকে একের পর এক kiss করতে থাকে; কিংবা এক ঘরে পঞ্চায়েত প্রধান, তার বোন, তার ফুফু এবং তার দেহরক্ষী কোনো কারণ ছাড়াই একসাথে লাফালাফি করতে থাকে.. এমন সিন দেখতে আপনার কেমন লাগবে? যদি মনে করেন ভালো লাগবে, তাহলে আমি বলবো আপনার জীবনে বিনোদনের বড়ই অভাব, আপনি মানসিক বিষন্নতায় ভুগছেন!

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮।

ব্যক্তিগত :

এছবি নিয়ে বিন্দুমাত্র এক্সপেক্টেশন ছিল না আমার। ভালো কাস্টিং ছিল, তাই দেখার সাহস করেছিলাম…. শেষমেষ মাইনাস প্রাপ্তি নিয়ে হল থেকে বের হয়েছি।

এখন অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগবে, এটা কেমন মানের ছবি তা ট্রেইলার দেখেই বোঝা যায়.. শুধু শুধু নেগেটিভ রিভিউ লেখার কি দরকার?

নাহ, সবাই এতো খোঁজ-খবর নিয়ে হলে আসে না, অনেকেই আছেন যারা টুকটাক ফেসবুকে এ্যাকটিভ থাকলেও ইউটিউবে ঢুঁ মারার সময় তাদের নেই। আর আমাদের দেশের হলের যা অবস্থা, কেউ তার পরিবার নিয়ে সিনেমাহলে এসেছে, এমন সিন খুব কম দেখা যায়। এইতো, আজ আমার পাশেই এক লোক বসেছিলো তার পরিবার নিয়ে, ছবি দেখতে। সাথে ওনাদের দুইটি ৪-৬ বছরের সন্তান ছিল। এখন তো আর কেউ পরিবার সহ সিনেমা হলে তেমন যায় না, যারা যায় তারা মূলত একসাথে কিছু আনন্দঘন মূহূর্ত কাটানোর জন্য যায়। তারা আড়াই ঘন্টা হাসবে, কাঁদবে, কিছু শিখবে.. এই জন্যেই মূলত যায়। এই জন্যে শুধু টিকেটের পেছনেই তাদের ২৫০-৩০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। এখন যেহেতু তারা পরিবারসহ একসাথে বাইরে বেড়াচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া ও তো করবে.. তারা তো আর খালি পেটে বাসায় চলে আসবে না। সো সবমিলিয়ে আন্দাজ করলে একটি নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির প্রায় ৪০০-৬০০ টাকা খরচ হয়ে যায় একটি সিনেমা দেখার জন্যে। এখন তারা এই খরচ টা কেন একটি অখাদ্যের পিছনে করবে? মানুষ কি এগুলো দেখার জন্যে হলমুখী হবে? ছবি চলাকালীন আমি প্রায়ই খেয়াল করছিলাম, তারা অনেকখানি ইতঃস্তত বোধ করছিল; লোকটি তার পরিবার নিয়ে একপ্রকার অস্বস্তিতে ছিল।

তাই দর্শক হিসেবে না হোক, মানুষ হিসেবেও আমার একটি দায়িত্ব হলো তাদের ভালো কিছু সাজেস্ট করা। রিভিউ আমরা এই জন্যেই লিখি।

রেটিং : ১/১০

ছবিটি কেন দেখবেন :

মাহিয়া মাহির অন্ধভক্ত কিংবা মৌসুমী ও ফেরদৌসের অন্ধভক্ত হলে ছবিটি একবার দেখতে পারেন।


মন্তব্য করুন