‘সাঁতাও’ সিনেমায় গ্রামীণ গল্পের পুনর্জন্ম
প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংকটের প্রতিচ্ছবির সিনেমা সাঁতাও; যেখানে মা হারানো এক বাছুর আর সন্তান হারানো এক মানবী, যারা পরস্পর পরস্পরকে সন্তান ও মায়ের অভাব পূরণে খুঁজে নিয়ে তৈরি করেন নতুন এক আত্মিক সম্পর্কের। মানুষের সঙ্গে প্রাণী-প্রাণ-প্রকৃতির এই সম্পর্কই সাঁতাওকে করে তুলেছে অনন্য।
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ প্যানোরমা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতা চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিচারকদের ভাষ্য এমনটাই।
তারকাবিহীন এই সিনেমা নির্মাণে কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে পাশে না পেলেও থেমে থাকেননি নির্মাতা খন্দকার সুমন। নিজের টাকায় কুলিয়ে না ওঠায় শরণ হন সাধারণের। শেষমেশ গণঅর্থায়নে ৯৭ মিনিটের এই সিনেমা বানিয়ে ছাড়েন তিনি। ছবি মুক্তিতেও আসে সংগ্রাম, সিনেমাটি নিয়ে নির্মাতা ঘুরেছেন হলে হলে, লাভ হয়নি। এই তো সেদিন সিনেমার প্রিমিয়ারে মেলে দারুণ দর্শক সাড়া। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে পাওয়া যায় হল। মাত্র পাঁচটি হলে মুক্তি পায়।
যে গল্পে দাঁড়িয়ে ‘সাঁতাও’
সদ্য বিয়ে করেছেন জোয়ান কৃষক ফজলু। দিনের বেশিরভাগ সময় যাকে কাটাতে হয় ধানের জমিতে, মাছ ধরার বিলে কিংবা নৌকা বাইচের দলে। স্ত্রীর পুতুলের নিঃসঙ্গতা দূর করতে একটি গরু কেনে। তাছাড়া পুতুল সন্তান সম্ভবা। নতুন অতিথি এলে তার খাদ্যের বাড়তি জোগানের ব্যবস্থা আগাম করে রাখতে হবে।
সন্তানসম্ভবা নারী ও সন্তানসম্ভবা গরু; একে অপরের দুঃখ, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা ভাগাভাগির মিথস্ক্রিয়া জমতে জমতেই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় গরুর। এদিকে জন্মদান প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হলে মৃত্যু হয় সদ্য জন্ম নেওয়া ফজলু-পুতুলের সন্তানের।
মা হারানো বাছুর আর সন্তান হারানো পুতুল; পরস্পর পরস্পরকে খুঁজে নেয় সন্তান ও মায়ের অভাব পূরণে। জন্ম নেয় নতুন এক সম্পর্কের। এ সম্পর্কে রক্তের বন্ধন নেই সত্যি; তবে আত্মিক যে বন্ধন সৃষ্টি হয়, তা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
কৃষকের সংগ্রামী জীবন, মাতৃত্বের সর্বজনীন রূপ ও মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় আবর্তিত হয়েছে সাঁতাওয়ের গল্প।
কী আছে কী নেই
‘সাঁতাওয়ের’ গল্পে চুলছেঁড়া টুইস্ট নেই, নেই চোখ ধাঁধানো সেট। তো আছে কী? সাঁতাওয়ে ছিল প্রতিটি শিল্পীর গল্পের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সফলতা। পুতুল চরিত্রে আইনুন নাহার ও ফজলু চরিত্রে ফজলুল হক চরিত্রে এতটাই বিলীন হয়েছেন যে, যতটা মিশে গেলে অভিনয় শিল্পীর আলাদা করে প্রশংসা করার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সাঁতাওয়ের বড় সফলতা এখানেই। কোনো অভিনেতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুব বেশি খোঁজাখুঁজিতে মিলবে একজন গ্রামীণ বধু এবং একজন কৃষক। আর পাওয়া যাবে তাদের ঘিরে আশপাশের মানুষগুলোকে।
নির্মাতা সুমন কেবল অভিনয় শিল্পীদের কাছ থেকেই নয় অভিনয় নিংরে এনেছেন বন্য শালিক, গরু, বাছুর, তিস্তার ধু-ধু প্রান্তর কিংবা হাঁসের বাচ্চাদের থেকেও। যাকে যেভাবে ফ্রেমে চেয়েছেন সেভাবেই পেয়েছেন কিংবা আনতে পেরেছেন এই নির্মাতা। বন্যপ্রাণীদের সিনেমায় মানানসই করে গড়ে তোলার কৌশলও এর নির্মাতাকে নিয়ে গেছে অন্য স্তরে।
বিশেষ করে লাল রঙা গরুর বাছুর ‘লালু’র কথা না বললেই নয়। ফজলু-পুতুলের পর বড় চরিত্র লালুর এবং এই প্রাণিটি ঘিরে গল্প এগিয়েছে।
সিনেমার অন্যতম শক্তির দিক হলো সাউন্ড। বাংলা সিনেমায় সারফেস সাউন্ডের এত নিখুঁত ব্যবহার খুব কমই চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে বিয়ের গীত, রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াইয়া সংগীত; সিনেমা ও গান, উভয়কেই করেছে জীবন্ত।
গ্রামীণ আবহ ফুটিয়ে তুলতে নির্মাতা যেমন কৃত্রিম আলোর স্বল্প ব্যবহার করেছেন, তেমনি নিয়েছেন বড় ক্যানভাসে একের পর এক মাস্টার শট। নৌকা বাইচ, গ্রামের বাজার, দুর্গাপূজার মেলা, ঈদের দিনগুলোর শুটিংয়ের জন্য আলাদা সেট ফেলে ক্যামেরা ধরার পরিবর্তে অপেক্ষা করেছেন।
ঈদ, পূজা, বাজার কিংবা মেলার দিনেই প্রকৃত ঘটনার ভেতর চরিত্র ঢুকিয়ে দিয়ে দৃশ্যধারণ করেছেন। এতে যেমন কোথাও নির্মাণের অসততা চোখে পড়েনি, দর্শকের কাছে গল্পগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে নির্মাতা দীর্ঘ ক্যানভাস ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছেন কোনো ঝামেলা ছাড়াই।
শীতের সকাল থেকে বর্ষার দুপুর, একেকটা শটের জন্য নির্মাতা ঠিক কতগুলো দিন যে ক্যামেরা তাক করে বসে থাকতে হয়েছে; চরিত্রগুলোকে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে, তা অনুমান করা খুবই সহজ।
বাংলা চলচ্চিত্রে গ্রামীণ পটভূমি চিত্রায়নের ইতিহাস নতুন নয়। চলচ্চিত্র জগতের শুরু থেকেই গ্রামীণ ও রূপকথার আলোকে নির্মিত সিনেমা এক সময় ছিল বাংলাদেশর চলচ্চিত্রের ‘কোরামিন’।
‘রূপবান’, ‘আপন দুলাল’, ‘মহুয়া’, ‘শিরি ফরহাদ’, ‘চাঁদ সওদাগর’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘মনপুরা’ জাতীয় চলচ্চিত্রগুলো যেমন ব্যবসা সফল, তেমনি কোন কোনটি শিল্পমানেও উন্নীত। বাংলার চিরচেনা গ্রাম ও গ্রামীণ চরিত্রকে পর্দায় দেখতে দর্শকেরা বরাবরই সাবলীল।
একটা সময়ে এসে প্রযুক্তির উন্নতি কিংবা বিশ্বচলচ্চিত্রের সহজলভ্যতার দরুন বাংলা চলচ্চিত্র এতটাই শহরমুখী হয়েছিল যে ‘মনপুরা’র পর সেভাবে ব্যবসাসফল কিংবা শিল্পনির্ভর গ্রামীণ সিনেমার নাম মুখে আনতে কয়েকবার ভাবতে হয়।
এছাড়া ওটিটির দাপটও ক্যামেরার লেন্সকে গ্রামমুখো আর হতে আর সায় দেবে কি না, এমন প্রশ্ন যখন এসে দাঁড়িয়েছে, তখন সুমন উপহার দিলেন ‘সাঁতাও’।
সাঁতাও’র নির্মাতা থেকে শুরু করে এর শিল্পী, কলাকুশলী এমনকি সাধারণ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের এক নিরন্তন প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফসল। যাতে খুঁজে পাওয়া যায় আবহমান গ্রাম-বাংলার হারিয়া যাওয়া বা হারাতে বসা নানা ঐতিহ্য-উপসঙ্গ।
প্রথাবিরোধী নির্মাতা খন্দকার সুমন সিনেমা নির্মাণে বাধ্য হয়ে ‘একলা চল’ নীতি বেছে নিলেও এর প্রচারে দেখা পান ভিন্ন দুনিয়ার। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের রথি-মহারথীরা সাঁতাওয়ের প্রচার চালিয়েছেন নিজেদের ফেইসবুকে। প্রিমিয়ারে উপচে পড়া দর্শক সিনেমা দেখতে না পেয়ে যেভাবে ফিরে গেছেন, মুক্তির আগেই এক দর্শক দুই টিকেট কিনে নিয়েছেন; তাতে বলা যায় সিনেমাটা এখন যত না ‘সাঁতাও’ টিমের, তারচেয়ে বেশি গণ-মানুষের।
এছাড়া সাঁতাওকেও হল পেতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। নাচ, গান, মারপিটসহ ব্যবসায়িক উপকরণ না থাকায় শুরুতে আগ্রহ দেখাননি হল মালিকরা। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকের ঢল না নামলে হয়তো কোনো হলেই মুক্তি পেত না সিনেমাটা।
তবে নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের শ্রম এক বিন্দুও বিফলে যায়নি। সাঁতাও হয়ে উঠেছে সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু। প্রত্যাহিক গ্রামীণ জীবনের আগামীর রেফারেন্স সাঁতাও।
৫০-৬০ কিংবা ৭০ দশকের কোনো নির্মাতা যদি ঢাকার জনজীবন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাগুলোকে এমন লার্জ স্কেলে দৃশ্যধারণ করে রাখতেন, তা যেমন বর্তমন সময়ে সিনেমার চেয়ে তখনকার জীবন-যাপন অন্বেষণকারীদের রেফারেন্স হিসেবে বেশি দেখা হতো; দ্রুত পরিবর্তনশীল গ্রামীণ জীবন খুঁজতে গেলে সাঁতাওয়ে চোখ রাখা ছাড়া উপায় থাকবে না আগামী প্রজন্মের।
সাঁতাওয়ের এই জয়রথ আমাদের সিনেমার জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে। উঠে আসতে পারেন সুমনের মতো আরও কয়েকজন মেধাবী ও সাহসী নির্মাতা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গল্প জাতীয় পর্যায় তুলে ধরার ক্ষিধে অনুভব করতে পারেন আরও অনেক নির্মাতা। হতে পারে গ্রামীণ গল্পের পুনর্জন্মের।
সেই হিসেবে সাঁতাওয়ের প্রথম নায়ক নির্মাতা, দ্বিতীয় নায়ক যদি ফজলুল হক হন; তৃতীয় নায়ক নিঃসন্দেহে দর্শক। দর্শক সাঁতাওকে হলে এনেছেন; এখন দর্শকের কাজ হলে গিয়ে সাঁতাও দেখা। না হলে যে হেরে যাবে একজন স্বপ্নবাজ, স্বাধীন নির্মাতার সংগ্রাম। হেরে যাবে এক ঝাঁক চলচ্চিত্র পাগলের ঘাম।