‘সাদা সাদা কালা কালা’ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে!
গত কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করলাম যে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অফলাইনে সব জায়গায় ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি বেশ আলোড়ন তুলেছে। যদি ভুল না হয়, তাহলে বলতে পারি গত ১২-১৩ বছরের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ সিনেমার গানের পর এই প্রথম আরেকটি গান চলচ্চিত্র মুক্তির আগেই সবচেয়ে বেশি হাইপ তুলেছে।
আমার দৃষ্টিতে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ যে হাইপ তুলেছে সে পরিমাণ তোলার মতো গানটির কথা ও সুরে তেমন আহামরি কিছু নেই; সেই হিসেবে ওভাররেটেডও বটে। অথচ এই বাংলাদেশে একটা সময় এক সাথে একাধিক চলচ্চিত্রের গান তুমুল আলোড়ন তুলতো আবার সেগুলোর আলোড়ন চলাকালীন নতুন আরও গান এসে জায়গা করে নিতো। প্রতি মাসে, প্রতি বছরে এভাবে অসংখ্য অসংখ্য কালজয়ী গান এসে আমাদের মনে নাড়া দিয়ে যেতো যা আজও আমরা নিজের অজান্তে গুনগুন করে গাই।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে গান একটি অপরিহার্য উপাদান; যা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সবাক চলচ্চিত্র আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ থেকে আজ অবধি নির্মিত সবগুলো চলচ্চিত্রে গান ছিল। পূর্ব পাকিস্তান আমল বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আমি যদি শুধু ১৯৮০-১৯৮৯ সালের চলচ্চিত্রের গানগুলোর কথা বলি তাহলেও কালজয়ী সবগুলো গানের তালিকা এক লেখাতে উল্লেখ করে শেষ করতে পারবো না।
ভালোবেসে গেলাম শুধু (কেউ কারও নয়), আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো (রজনীগন্ধা), ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে (প্রাণ সজনী), তুমি যেখানে আমি সেখানে (নাগপূর্ণিমা), বুকে আছে মন মনে আছে আশা (লড়াকু), আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যেখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন (নয়নের আলো), আজ রাত সারারাত জেগে থাকবো (নীতিবান), তোমাকে চাই আমি আরও কাছে (নসীব), পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয় (ঢাকা ৮৬), জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো (জন্ম থেকে জ্বলছি), সবাই তো ভালোবাসা চায় (সারেন্ডার), জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প (ভেজা চোখ), প্রিয়া আমার প্রিয়া (ভেজা চোখ), ভেঙেছে পিঞ্জর (ভাইবন্ধু), আমি একদিন তোমায় না দেখিলে (দুই জীবন), কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো (উসিলা), আমি তোমারি প্রেমভিখারি (চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা), হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে (মহানায়ক) … এর মতো আরও অসংখ্য কালজয়ী গান পেয়েছিল ওই দশকে।
১৯৯০-১৯৯৯ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার মধ্যে থেকে কোথায় স্বর্গ আর কোথায় নরক (অচেনা), তুমি আমার কত চেনা (দোলনা), জীবন যেন শুরু হলো আবার (সান্ত্বনা), আমার মনের আকাশে আজ (প্রেমের প্রতিদান), বেলি ফুলের মালা পড়ে (বেপরোয়া), কতদিন পরে দেখা হলো (চাঁদনী), এখানে দুজনে নির্জনে (অন্তরে অন্তরে), মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে ( প্রথম প্রেম), জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি (তুমি আমার), ও সাথী রে যেও না কখনও দূরে (স্বপ্নের ঠিকানা), তুমি আমার হৃদয়ে যদি থাকো (হৃদয় আমার), ভালোবাসা যত বড় (চরম আঘাত), তুমি এমন কোন কথা বলো না (প্রিয় তুমি), সাগরিকা বেঁচে আছি (সাগরিকা), আম্মাজান আম্মাজান (আম্মাজান)-সহ আরও অসংখ্য গানগুলো যুক্ত করি তাহলে দুই দশক কমপক্ষে সহস্রাধিক আলোড়ন তোলা, কালজয়ী গানের তালিকা হয়ে যাবে। অথচ গত ১২ বছরে ২০টি গানও খুঁজে পাওয়া যাবে না যা আপনি আপন মনে গুনগুন করে উঠতে পারেন যার ফলে ‘সাদা সাদা কালা কালা’র মতো গানও হয়ে উঠে বিরাট কিছু।
এই যে ২২/২৩ বছর আগের সাথে আজকের এতো এতো পার্থক্য, আজকের এতো শূন্যতা হয়েছে তার কারণ কি কেউ কখনও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে? ২৫/৩০ বছর আগেও যেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গান থাকতো মানুষের মুখে মুখে সেখানে আজ তা নেই কেন? কারণ হলো মেধা শূন্যতা। আগে চলচ্চিত্রের গান লিখতেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মুকুল চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, মনিরুজ্জামান মনির, আমজাদ হোসেন, খান আতাউর রহমান, মাসুদ করিম, নজরুল ইসলাম বাবু, লোকমান হোসেন ফকির এর মতো মেধাবী গীতিকাররা। যার শুধু গান লিখেই বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতিতে অমরত্ব লাভ করেছিলেন তাঁদের সময়েই। তাঁদের সেসব গানে সুর ও সংগীত পরিচালনা করতেন সত্য সাহা, সুবল দাস,আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো দেশসেরা সংগীত পরিচালকরা যারা গান সুর করেই তাঁদের সময়ে শিল্প সংস্কৃতিতে অমরত্ব লাভ করেছিলেন।
এমনও অসংখ্য উদাহরণ আছে যে একটি সিনেমার ৫টি গানের সবগুলো গানই শ্রোতাদের মন জয় করেছিল। আর সে সব মেধাবী গীতিকার-সুরকারদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতেন তৎকালীন প্রযোজক পরিচালকেরা। সবার মেধা, নিষ্ঠা, শ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এতো এতো কালজয়ী গান। সেই সময়কার মানুষগুলো কী পরিমাণ মেধবী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন যারা একটি সুযোগ পেয়েই নিজেকে তুলে ধরতেন তার একটা উদাহরণ দেই।
মমতাজ আলীর ‘নসীব’ সিনেমার প্রধান গীতিকার ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সিনেমার কাজ চলাকালীন একদিন ব্যক্তিগত কাজে গাজী মাজহারুল আনোয়ার কুমিল্লায় গিয়েছিলেন, ফিরবেন ৪-৫ দিন পর। তখনকার যুগে মোবাইল, হোয়াটস অ্যাপ ছিল না তাই কেউ দূরে থেকেও কিছু লিখে তাৎক্ষণিক ভাবে পাঠাতে পারতেন না। সেই সময়ে ‘নসীব’ সিনেমার জন্য একটা গান দরকার হলো। ছবির পরিচালক মমতাজ আলী ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী এফডিসির একটা স্টুডিওতে মনিরুজ্জামান মনিরের কাছে ছুটে গেলেন একটা গান লিখে দেয়ার জন্য। তাদের অনুরোধে মনিরুজ্জামান মনির সেদিন রাতেই আলাউদ্দিন আলীর বাসায় গিয়ে আলীর সামনে বসেই লিখে ফেললেন ‘তোমাকে চাই আমি আরও কাছে’ গানটি এবং আলাউদ্দিন আলী তৎক্ষনাৎ গানটির সুর বেঁধে দিলেন। পরবর্তীতে এই এক গানই নসীব সিনেমার ইতিহাস তৈরি হয়ে গেলো। মনিরুজ্জামান মনির গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অনুপস্থিতিতে সুযোগ পেয়েই নিজেকে প্রমাণ করে দিলেন এরপর আলাউদ্দিন আলীর সাথে অসংখ্য সিনেমায় মনিরুজ্জামান মনির কাজ করেছিলেন।
শুধু তাই নয় আগেকার প্রযোজক পরিচালকরা কীভাবে মেধাবীদের কাজে লাগাতেন তার একটা উদাহরণ দেই। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার সাথে আলম খানের দারুণ একটা রসায়ন ছিলো। ‘নাগ পূর্ণিমা’ সিনেমার জন্য আলম খানকে এমন একটা গান তৈরি করতে বলেন যে গানটি ফোক ফ্যান্টাসি ‘নাগ পূর্ণিমা’র অন্য গানগুলোর চেয়ে আলাদা হবে। আলম খান সেই মোতাবেক মনিরুজ্জামান মনিরকে বললেন একটা গান লিখে দিতে। মনির লিখলেন ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’ টাইপের একটা রোমান্টিক গান যার সুর ও সংগীতায়োজনটা আলম খান এতো আধুনিক প্যাটার্নের করলেন যে গান শুনে কেউ মনে করবে না যে এটা একটা সর্পভিত্তিক ফোক ফ্যান্টাসি সিনেমার গান। আজও মনিরুজ্জামান মনির-আলম খানের কালজয়ী সৃষ্টিগুলোর মাঝে গানটি শ্রোতাদের মুখে ফেরে।
এই যে মেধাবী গীতিকার, সুরকার, প্রযোজক, পরিচালকদের এক মিলনমেলা ছিলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সেটা গত ১ যুগে কি আমরা আর পেয়েছি? পাইনি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আর টেলিভিশন চ্যানেল ঘুরলে আপনি আজকের চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রিতে সুপারস্টারদের অভাব পাবেন না। এখানে যে এক গান গেয়েই ভাইরাল হয়ে যায় সেই সুপারস্টার হয়ে যায় এবং তাদের ভাব দেখে মনে হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের আগে এতো বড় গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, প্রযোজক, পরিচালক এর আগে কখনও আসেনি এবং আসবেও না।
বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের ভাবের কথা আর নাইবা বললাম। মেধাশূন্য ইন্ডাস্ট্রিতে যখন ভাব দেখানোই বড় কিছু হয়ে যায় এবং যেখানে মেধার চেয়ে ভাবের গুরুত্ব বেশি হয় তখন ১০/১২ বছর পর পর ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গান নিয়েই মাতামাতি করে কিছুদিন সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আজ থেকে ২/৪ বছর পর এসব গান শ্রোতাদের মনেই আসবে না, মুখে ফেরা তো বহু দূরের ব্যাপার যার একাধিক উদাহরণ গত দেড় বা দুই দশকে আছে। ‘হাওয়া’ সিনেমার গান হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বেশিদিন লাগবে না।