
সাবা : ব্যক্তিগত অবলোকন
‘সাবা‘-র পরতে পরতে আমি নিজের বাবার শেষ দিনগুলোকে খুঁজে পেয়েছি এবং দর্শক হিসেবে চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু আবিষ্কার করেছি। চলচ্চিত্র যদি জীবন থেকেই নেয়া হয়ে থাকে তবে ‘সাবা’ আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে দেখিয়েছে। ‘সাবা’ তো এখানেই সফল
২০০৩ সালে মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ভেতর থেকে একা হয়ে যান। ডাক্তার বলেন, খুব খেয়াল রাখার জন্য। বাবার সাথে ছায়ার মতো থাকতাম। ভাইদের মধ্যে বেশিরভাগ ঢাকায় থাকার সুবাদে ছোটদের মধ্যে আমিই ছিলাম বাড়িতে। ভোরে উঠে হাঁটতে বের হতেন বাবা তখনও আমি সাথে যেতাম। একদিন আমি ঘুম থেকে উঠতে না পারায় বাবা একাই যান হাঁটতে। তারপর হঠাৎ বাড়িতে লোকজনের সমাগমে ঘুম ভাঙে। দেখি বাবাকে দুজন ধরাধরি করে বারান্দায় বসাচ্ছে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেছে জানালো তারা। ঠিক তার এক সপ্তাহের মাথায় বাবা প্যারালাইস্ট হয়ে গেলেন।

প্যারালাইস্ট হবার পরের দিনগুলোতে বাবার যে নিঃসঙ্গতা আমি দেখেছি এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি তখন হাইস্কুলের ছাত্র। বাবার জন্য অনেকদিন স্কুলে যেতাম না। বাড়িতে বোন আর আমি বাকিরা তো সবাই ঢাকায়। বেশিরভাগ সময় আমিই দেখাশোনা করতাম বাবার। আমি যেদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হতাম বাবা করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত যেন আমি গেলে তিনি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যাবেন। কখনো কখনো বাবার চোখের ভাষাকে উপেক্ষা করে আর স্কুলে যেতে পারতাম না। বন্ধুরা বাড়িতে চলে আসত এত কেন স্কুল কামাই করছি সেজন্য। বাবা মায়ের কথা বলতেন বারবার কিন্তু আমার শুনতে ভালো লাগত না কখনো কখনো কারণ লোকে বলত যখন মা-বাবার মধ্যে কেউ একজন আগে চলে গেলে পরেরজনও তার কাছে চলে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর জন্য বাবা মায়ের কথা বললে আমি প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলতাম কেননা বাবাকেও হারাতে চাইতাম না। মা হারানোর কষ্ট তো পেয়েছেই বাবা হারানোর কষ্ট পেতে চাই না। বাবা মাঝে মাঝে অতীতের গল্প করতেন। তাঁর কত ভালো ভালো দিন ছিল, কত মানুষের উপকার করেছেন যারা তাঁর খবর রাখেনি সেসব বলে কখনো কাঁদতেন। সম্পদ পরের জন্য ব্যয় করেও তার বিনিময়ে সামান্য সৌজন্যও পাননি এসব বলে বলে আফসোস করতেন। বেড়াতে যেতে চাইতেন প্রচুর। আমি যখন পুকুরপাড়ে নিয়ে যেতাম ডানহাত আর ডানপা নেতিয়ে পড়ত। স্বাস্থ্যবান বাবা আমার ঐ অবস্থায় কতটা অসহায় হয়েছিলেন! পুকুরপাড়ে গিয়ে হাতে ঢিল তুলে দিলে পুকুরে ছুঁড়ে মারতেন আর বলতেন ছোটবেলায় বন্ধুরা মিলে এটা করতেন। ঐ টুকরো স্মৃতিটাই মনে করে তাঁর আনন্দ হত। যেদিন বলতাম বাইরে নিয়ে যাবো সেদিন তাঁর খুশি দেখে কে! বাবাকে বেশিরভাগ সময় আমিই গোসল করাতাম। পানি গায়ে ঢাললে শিশুদের মতো আনন্দ করতেন তখন মনে হত বয়স হয়ে গেলে মানুষ আসলেই শিশুর মতো হয়ে যায়। দিনাজপুর শহরের একটা ফিজিওথেরাপি সেন্টারে বাবার চিকিৎসা করা হয়েছিল। সেখানে তারা চিকিৎসা পর্যাপ্ত না দিয়েও অনেক টাকা নিয়েছিল। সেখানে বাবা আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। যেদিন বাড়ি থেকে কেউ যেত বাবা হাউমাউ করে কাঁদতেন, সেখানে থাকতে চাইতেন না। অবশেষে বাবাকে বাড়িই ফেরত আনা হয় তাঁর মানসিক অবস্থা দেখে। বাড়িতেই চিকিৎসা করা হত। বাবার দিন এভাবেই কাটছিলো, সবকিছু ভালোই চলছিলো কিন্তু একদিন ভর দুপুরে সবাই যখন দুপুরের খাবারের পর ঘুমাচ্ছিল বাবা খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলেন যেটি এর আগে কখনোই ঘটেনি। হঠাৎ চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি বাবাকে বারান্দায় শুইয়ে দেয়া হচ্ছে, তাঁর চোখ দুটো তখন অনেক বড় বড় হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিলেন তারপর চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। আমার হাতে হাত রেখেই তাঁর চলে যাওয়া।
‘সাবা’ ছবি দেখতে দেখতে মেহজাবিন মায়ের প্রতি যেভাবে দায়িত্বগুলো পালন করছিলো আমার নিজের বাবার প্রতি তাঁর শেষ দিনগুলোতে ঠিক সেভাবেই দায়িত্ব পালন করেছি। মেহজাবিন বা সাবা যখন মাকে একা রেখে কাজে বের হত আর মা অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নিজের নিঃসঙ্গতা বুঝিয়ে দিত ঠিক একইভাবে আমি স্কুলে যাবার সময় বাবাও একদৃষ্টিতে তাকাতেন আমি যেন না যাই সেটাই বলতে চাইতেন। ‘সাবা’-র পরতে পরতে আমি নিজের বাবার শেষ দিনগুলোকে খুঁজে পেয়েছি এবং দর্শক হিসেবে চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু আবিষ্কার করেছি। চলচ্চিত্র যদি জীবন থেকেই নেয়া হয়ে থাকে তবে ‘সাবা’ আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে দেখিয়েছে। ‘সাবা’ তো এখানেই সফল।
মেসেজ :আমার ব্যক্তিগত মেসেজ হলো আপনাদের মা-বাবা যতদিন বেঁচে আছেন তাদের সেবা করুন। তারা কি খেতে চায়, কোথায় ঘুরতে চায়, কোন স্বপ্নের কথা বলে সব অনুধাবন করুন। তাঁরা যখন থাকবেন না কেবল তখনই এর মূল্য বুঝবেন শুধু তখনই বুঝবেন আই রিপিট শুধু তখনই বুঝবেন নয়তো আফসোসের সীমা থাকবে না। আমি সৌভাগ্যবান মনে করি নিজেকে মা-বাবার সেবা করতে পেরেছি।