সালতামামি ২০০০: বহুমুখী মন্দায় আক্রান্ত ঢালিউড
নতুন শতাব্দির শুরুটা ভালো হয়নি ঢালিউডে। ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া ৮৯টি সিনেমার মধ্যে বেশির ভাগই ব্যবসা করতে পারেনি। তখনকার বিনোদন বিষয়ক ম্যাগাজিন ছায়াছন্দের সালতামামির শিরোনাম ছিল ‘মন্দাক্রান্ত বছর’। প্রতিবেদক লিয়াকত হোসেন খোকন এ ব্যর্থতার জন্য স্যাটেলাইট সংস্কৃতির প্রসার, ডিস ওয়ালাদের অবৈধ ছবি প্রদর্শন ও নির্মাতাদের অযোগ্যতাকে দায়ি করেন।
এ বছরের সিনেমা ছিল— চিটার নাম্বার ওয়ান, জিদ্দি সন্তান, নারীর মন, আশা আমার আশা, গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান, বিদ্রোহ চারিদিকে, এ বাঁধন যাবে না ছিড়ে, রাজা নাম্বার ওয়ান, তুমি যে আমার, বাবা কেন আসামী, দৌড়, বিদ্রোহী আসামী, লণ্ডভণ্ড, হিংস্র থাবা, রাজু মাস্তান, দুষ্টু ছেলে মিষ্টি মেয়ে, বিষে ভরা নাগিন, বিনি সুতার মালা, তেজি সন্তান, জীবন চাবি, নাজায়েজ, জখম, মৃত্যু যন্ত্রণা, কষ্ট, জানের জান, হীরা চুনি পান্না, আজ গায়ে হলুদ, বস্তির শাহেন শাহ, কারিশমা, মনে পড়ে তোমাকে, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঝড়, লেডি রংবাজ, সবাইতো সুখী হতে চায়, হৃদয় নিয়ে যুদ্ধ, মনে রেখো পৃথিবী, অশান্তির আগুন, দুই চোর, আখেরী জবাব, লেডি র্যাম্বো, জ্যান্ত কবর, বাবা মাস্তান, গোলাম, সাইক্লোন, খাইছি তোরে, যাবি কই, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, কালা কাফন, প্রেমের নাম বেদনা, জামিন নাই, ধাওয়া, বর্ষা বাদল, যোদ্ধা, আমার প্রেম আমার অহংকার, পেশাদার খুনী, প্রেমিক ডাকাত, কালু মামা, পাল্টা হামলা, সবার অজান্তে, ওরা সোলজার, তুমি আমার ভালবাসা, এরই নাম দোস্তি, তের পাণ্ডা এক গুণ্ডা, তোমার জন্য ভালবাসা, আসিরন কেন ঢাকায়, রাজারানী, সাবধান, জিন্দা দাফন, বর্তমান, নয়া কসাই, আমার প্রতিজ্ঞা, কসম বাংলার মাটি, জোর যার মুল্লুক তার, গিরিঙ্গীবাজ, ভয়ংকর নারী, ক্ষ্যাপাবাসু, জুম্মন কসাই, ভয়াবহ, চুরমার, অসভ্য মানুষ, বিষাক্ত নাগিন, এই মন চায় যে, কুখ্যাত খুনী, ফুল নেবো না অশ্রু নেবো, কাটা রাইফেল, কিলার, আমি গুণ্ডা আমিই মাস্তান, দুই দুয়ারী ও চুপি চুপি।
এর মধ্যে ‘দুই দুয়ারী’ বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের দুটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। আর ‘চুপি চুপি’ ঈদের দিন বিটিভিতে প্রদর্শিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিপ্রাপ্ত ৮৯টি ছবির মধ্যে অধিকাংশ ছবিই সামাজিক অ্যাকশনধর্মী। প্রায় সব ছবিতেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবার জন্য কাহিনী গড়ে উঠেছে। হাতে গোনা কিছু ছবি ব্যবসাসফল হয়। এ সব ছবির সিংহভাগ দর্শক ছিল দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক নয়তো অন্য কেনো পেশাজীবী সাধারণ মানুষ।
অনেক ছবি মুক্তি পেলেও ঢালিউড ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। অনিশ্চয়তার পেছনে কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ছবির বাজার মন্দা যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল স্যাটেলাইট ব্যবসায়ীদের দেশীয় নতুন ছবির অবৈধ প্রদর্শনী। বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে নিয়মিত পুরনো বাংলা ছবির প্রদর্শনীও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলচ্চিত্র ব্যবসার।
ওই বছরগুলোতে অশ্লীলতা অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, সিনেমা হলে অশ্লীল ছবি প্রদর্শনীর বিষয়টিও প্রকারান্তরে দর্শককে নিরুৎসাহিত করেছে হলে যেতে। ঢাকার ছবিতে অশ্লীলতা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, এ জন্য দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ হয়েছে। চট্টগ্রামে সিনেমা হল পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। হুমকি দেয়া হয়েছে অশ্লীল চিত্রে অভিনয় করেন এমন শিল্পীদেরও।
এ বছরের উল্লেখযোগ্য সিনেমা প্রসঙ্গে বলা হয়, সুস্থ ও সুন্দর ছবির তালিকায় আছে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত এ ছবিটি পরিচালনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ায় প্রমাণ করে যে, ভালো ছবির দর্শক এখনও আছে। শিক্ষিত রুচিবান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দর্শক এ ছবিটি বেশি দেখেছে। বাসু চ্যাটার্জির ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ও ‘চুপি চুপি’ ছবি দুটি বিটিভিতে প্রদর্শিত হয়েছে। বিদেশী পরিচালক হয়েও বোদ্ধা ও রুচিশীল দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছে বাসু চ্যাটার্জি।
সাপের কাহিনী নিয়ে ‘বিষাক্ত নাগিন’ ও ‘বিষে ভরা নাগিন’ নির্মিত হয়েছে। এ ছবি দুটি ফ্লপের তালিকায় আছে। হত্যার প্রতিশোধ আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নির্মিত হয়েছে সিংহভাগ ছবি। সব ছবির গল্প ঘুরে ফিরে একই। এ ধরনের ছবি নির্মাণ করেছেন শরীফ উদ্দিন খান, মালেক আফসারী, কাজী হায়াৎ, মনতাজুর রহমান আকবর প্রমুখ। একই গল্পকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারা ছবি নির্মাণ করেছেন। নতুনত্ব তেমন নেই। ডিপজল সব ছবিতে সন্ত্রাসী, মাস্তান নয়তো গুন্ডা। মান্না, রুবেল ও আমিন খানের পর্দায় উপস্থিতি মানেই ডিপজলের সঙ্গে মারপিট দৃশ্যে অংশ নিয়ে জয়ী হওয়া।
এ বছর কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে ঢালিউড। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, ২০০০ সালে চলচ্চিত্রে দুঃখজনক ঘটনা অভিনেতা শওকত আকবর, মঞ্জু দত্ত, গাজী মতিউর রহমান, বাবুল চৌধুরী, আবু তাহের, ফিরোজ আল মামুনের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া।
শাকিল ও পপির বিয়ের গুঞ্জন ছিলো খুবই আলোচিত বিষয়। বিষয়টি অনেকদিন ধরে সরব করে রাখে চিত্র জগতকে। এ ঘটনার পরে শাকিলের ক্যারিয়ার নিম্নমুখী হতে থাকে। শাকিলের শূন্যতা পূরণ করেন রিয়াজ ও শাকিব খান। শাকিব খানের ‘ফুল নেবো না অশ্রু নেবো’ ছবিটি বেশ ব্যবসা করে। শাবনূর-রিয়াজের প্রেম ও বিয়ের ঘটনাও গুঞ্জন হয়ে এসেছে মাঝে মধ্যে।
এ বছরের ১২টি ব্যবসাসফল ছবি হলো গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, বর্তমান, শ্রাবণ মেঘের দিন, জুম্মন কসাই, এ বাঁধন যাবে না ছিড়ে, কাটা রাইফেল, পেশাদার খুনী, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, পাল্টা হামলা, কালা কাফন, কুখ্যাত খুনী ও রাজা নাম্বার ওয়ান। কাজী হায়াৎ সর্বাধিক পাঁচটি ছবি নির্মাণ করেন।
আরো বলা হয়, অধিকাংশ ছবি ফ্লপ হওয়াতে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা হাত গুটিয়ে আছেন। বরং পুরনো ছবির প্রিন্ট দিয়ে প্রোডাকশনের খরচ তুলছেন। কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতার অভিমত ছিল, শীর্ষ নয়ক-নায়িকাকে নিলে অতিরিক্ত খরচ হয়। কখনো কখনো তাদের নামে ছবিও চলে না। নতুন মুখ নিয়ে ছবি নির্মাণ করলে খরচ অনেক কমে আসে। কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এ বছর নতুন মুখ পর্দায় উপস্থিত করেছেন। নতুন নায়িকারা হলেন কেয়া, পলি, রত্না ও পান্না।
তারকাদের অবস্থান নায়িকাদের মধ্যে মুনমুনের ছবি সবচাইতে বেশি মুক্তি পেয়েছে। ১০টি। প্রতিটি ছবিতে মুনমুন অভিনয়ের চাইতে তার দেহ প্রদর্শন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। মুনমুনের একটি ছবিও ব্যবসাসফলের তালিকার মধ্যে পড়েনি। ফ্লপ তালিকায় রয়েছে জিদ্দি সন্তান, সাইক্লোন, কসম বাংলার মাটি ও ভয়াবহ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মুনমুনের পরে শাহনাজের অবস্থান। ছবির সংখ্যা ১৪টি। শাবনূরের ১৩টি, মৌসুমীর ১২টি, পপির ১১টি, একার আটটি, পূর্ণিমার ছয়টি, তামান্নার তিনটি, কুমকুমের দুটি, রাকা, উর্মি ও শিল্পীর একটি করে ছবি মুক্তি পেয়েছে।
২০০০ সালে ঢাকার ছবিতে বিদেশী নায়িকা ঋতুপর্ণার মুক্তি পেয়েছে তিনটি ছবি। প্রিয়াংকার মুক্তি পেয়েছে দুটি, মনিকা বেদী, উষা থাপা, রিয়া সেন, রাবিনা, শতাব্দী ও আয়েশা জুলকার একটি ছবি মুক্তি পায়।
নায়কদের মধ্যে মান্না ও আমিন খানের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা সমান- ১৬টি করে। প্রতিটি ছবিতে একক নয়তো প্রধান নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন তিনি। আমিন খান ১৬টি ছবিতে অভিনয় করলেও কয়েকটি দ্বিতীয় নায়ক ছিলেন। অধিকাংশ ছবিই ছিল ফ্লপ।
মান্না অভিনীত ১৬টি ছবির মধ্যে ১১টি ছবিই ব্যবসাসফল তালিকায় রয়েছে। রিয়াজের মুক্তি পেয়েছে ১৩টি ছবি, রুবেলের ১৪টি, শাকিল খানের ১১টি, শাকিব খানের ১০টি, ফেরদৌস, ইলিয়াস কাঞ্চন ও অমিত হাসানের ছয়টি করে, বাপ্পারাজের পাঁচটি ও মাহফুজ আহমেদের চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছে।
এদের মধ্যে সুস্থ ও রুচিসম্মত ছবিতে ফেরদৌস আলাদা একটা অবস্থান করে নিয়েছেন। ভারতের ছবিতেও ফেরদৌসের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। শাকিল, ইলিয়াস কাঞ্চন ও অমিত হাসানের অবস্থান আগের মতো আর নেই। এদের অভিনীত প্রতিটি ছবিই ফ্লপ।
দ্বিতীয় সারির নায়কদের মধ্যে শাহীন আলমের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ১৩টি ও মেহেদির নয়টি। তাদের অবস্থান তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। খলনায়কদের মধ্যে মিশা সওদাগরের ছবির সংখ্যা বেশি। ২২টি। ডিপজলের মুক্তি পেয়েছে ২০টি ছবি। রাজিবের ১৭টি, মিজু আহমেদের ১৩টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। চরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেনের ১৭টি, প্রবীর মিত্রের ১২টি, খলিলের ছয়টি, রাজ্জাকের পাঁচটি, গোলাম মুস্তাফা ও সাইফুদ্দিনের তিনটি করে ছবি মুক্তি পেয়েছে।
[সালতামামির পেপার কাটিংটি প্রকাশ হয়েছে ফিল্ম অ্যান্ড থিয়েটার গ্রুপে। সংগ্রহকারী ফায়সল বারী]