সালমান মারা না গেলে ওমর সানী আরও জনপ্রিয় হতেন
এই কথাটা কি আমি বলবো? এই নিয়ে ভেবেছি তিনটা দিন। আমি নিজেও বুঝি আমি যতোটা স্বপ্নবান, ততোটা কাজের না। তারপরও একদিন একজন আমার কাজের খুব সমালোচনা করলেন, আমার কী যে মনখারাপ হয়েছিলো! এখন আমিও একজনের সমালোচনা করবো, তিনি জানতে পারলে হয়তো তারও মনখারাপ হবে। কিংবা জানলেনই না বিষয়টা; কিন্তু সমালোচনাটা তো আমি করলাম বা লিখলাম! তারপর মনে হলো, না লিখলেও আমিতো ভেবেছি। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে, প্রকাশ আর অপ্রকাশের তফাৎ-এ।
যাইহোক, ভূমিকা শেষ। মূল কথায় আসি। কথাটা হচ্ছে, সালমান শাহ মারা না গেলে, ওমর সানী আরও জনপ্রিয় নায়ক হয়ে উঠতেন। ফলে ‘গরীবের রানী’র চেয়েও অধিক হিট সিনেমা থাকতে পারতো তার দখলে। বলে নিই, চুরানব্বইয়ে এসে সালমান শাহ-মৌসুমীর দ্বন্দ্ব এবং একে অন্যের সাথে চলচ্চিত্র না করার সিদ্ধান্তে আমি চলে যাই মৌসুমীর দলে।
পাঁচ ক্লাসে পড়া আমি চুপচাপ মৌসুমীর ভিউকার্ড কিনি। আর আমার মনে হতো পাশের বাসার প্রিয়তম মেয়েটি দেখতে অনেকটা মৌসুমীর মতোই। তাই আমিও ভাবতে থাকি লম্বামুখো সালমান শাহ আর এমনকি! মৌসুমী যেখানে, আমিও সেখানে। বলাইদা তখন পত্রিকা বিলি করতেন সাইকেলে করে। আমি সিনেমার পত্রিকা দেখতাম তার সাইকেলের সামনে সাঁটা থাকতো। কখনও সখনও উল্টে পাল্টে দেখতাম। বলাইদা বলতেন, এইসব ছোট মানুষের জন্য না। এই বলে তিনি হাত থেকে নিয়ে নিতেন। দিতেন ‘কিশোর তারকালোক’, ‘এইটা দেখো’। কিন্তু মন পড়ে থাকতো ‘তারকালোকে’। তারকালোকেই জেনেছিলাম মৌসুমী আর সালমান শাহ এক সাথে সিনেমা করবে না। মৌসুমী প্রথমে সকলের পরে ওমর সানি’র হয়ে গেলো।
‘সকলের’ বলছি এই কারণে যে, আমরা মৌসুমীকে দেখি অমিত হাসানের সাথে (মৌসুমী), ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে (ভাঙচুর), রুবেলের সাথে (বিশ্ব প্রেমিক) এবং শেষে ওমর সানীর সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে যান। এবং আমরাও ওমর সানীকেই মেনে নিই। আমরা তার অভিনয় বিবেচনায় আনি না। আমাদের বোধ হয় এমন মনে হয় যে, এটাতো সিনেমাই! একটু বাঁকা ত্যাড়া হয়ে কথা বললে কী আসে যায়!
মৌসুমীর সাথে ওমর সানীর প্রথম ছবি খুব সম্ভবত দোলা। হিন্দু-মুসলমানের প্রেম-দ্বন্দ্ব নিয়ে সিনেমা। আপনি যদি সিনেমাটা দেখে থাকেন তাহলে আপনি আমার সাথে একমত হবেন কিনা জানি না, পুরো সিনেমায় ওমর সানী-ই একমাত্র ব্যতিক্রম। যে নায়ক এইভাবে কথা বলে, এইভাবে ইমোশন প্রকাশ করে, তাহারে কোন নায়িকা পছন্দ করবে! আর কেউ করে নাই, মৌসুমীই পছন্দ করছে। কী আর করা যাবে! আর আমাদের দর্শকেরও রুচিবোধ তৈরি হয় নাই। দর্শক একই সিনেমায় প্রেম, অ্যাকশান, নাচ-গান দেখতে চাইতো। ফলে সিনেমার পরিচালকরাও একই গল্প বছরের পর বছর বানিয়ে যেতে লাগলো। কেউ কেউ যে ব্যতিক্রম কিছু করার চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু দেখা গেছে ব্যতিক্রম চলচ্চিত্রগুলো দর্শক সেভাবে নেয়নি। যেমন চেতনা, আবদার ইত্যাদি।
আবদার মূলত হুমায়ূন আহমেদের রচনায় সুভাষ দত্তের সিনেমা ছিলো। ইলিয়াস কাঞ্চন, চম্পা, অমিত হাসান, অরুণা বিশ্বাস প্রমুখের অভিনয়ে একেবারে বাণিজ্যিক ছবি। অন্যরা কীভাবে নিয়েছিলো জানি না। সিনেমটা হিট না ফ্লপ তাও জানি না। শুধু মনে আছে ফুলপুর উত্তরা সিনেমাহলে এই সিনেমা দেখে আর আর কতিপয় দর্শকদের সাথে আমিও বিরক্ত নিয়ে বের হয়েছিলাম। ধুর! তেমন মারপিট নাই সিনেমায়!
তো আসলে আমাদের দর্শকদের রুচিই তৈরি হয়নি তখনও। তাই নির্মাতারাও একই ফরম্যাটে এক চিমটি দেশপ্রেম, আধসের প্রেম, এক মুঠো মারপিট নিয়ে সিনেমা বানাতে থাকলেন। আমরা ওমর সানীকেও প্রথম সারির নায়ক হিসেবে নিয়ে নিলাম। ৯৪-এ-ই সম্ভবত সালমান শাহ কন্যাদান ও প্রেমযুদ্ধ নামে লিমাকে বিপরীতে নিয়ে দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, ভালো লাগেনি। বিশেষ করে কন্যাদানের গল্পটা চমৎকার হলেও সালমান শাহর চরিত্রটা তার বয়সের সাথে যায়নি বলে মনে হয়েছিলো। তবে বড়রা সালমান শাহ’র দুই সময়ের দুই ব্যক্তিত্বের অভিনয় দক্ষতাকে প্রশংসা করেছিলেন। খুব সম্ভবত দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর কন্যাদান সিনেমাটা হিট হয়নি। এরপর সালমান শাহ- দেলোয়ার জাহান ঝন্টুকে এক সাথে পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি ইউটিউবে একটা ভিডিওতে দেখলাম, ঝন্টু সাহেব সালমান শাহকে অগুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে কথা বলেছেন।
সালমান শাহ সুপার ডুপার হিট হলেন, সমালোচনা-আলোচনায় আসলেন স্বপ্নের ঠিকানা সিনেমা দিয়ে। ‘এই সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে সালমান শাহ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছিলেন’- এমন একটা বিষয় ছড়িয়ে পড়েছিলো। আর এই সিনেমার গানগুলো ছিলো শ্রোতাপ্রিয়। অথচ শুনেছিলাম স্বপ্নের ঠিকানা মুক্তির সপ্তাহে ঢাকা শহরে হল পায়নি। মে বি মৌসুমী-ওমর সানীর মুক্তির সংগ্রামের কারণেই। কিন্তু ঠিকই স্বপ্নের ঠিকানা বাজিমাত করে দেয়। আর সালমান শাহ জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যান। ওমর সানীও পেছনে ছিলেন না। প্রেমগীত, প্রথম প্রেম, আত্ম অহংকার প্রভৃতি সিনেমায় যেমন রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তেমনি আখেরি রাস্তা, মুক্তির সংগ্রাম, ক্ষুধা ইত্যাদি সিনেমায় অ্যাকশান হিরো হিসেবে তাকে আমরা পেয়েছি। গ্রহণ করেছি। এবং সালমান শাহ’র পাশাপাশি তিনিও চুটিয়ে চলছিলেন।
সমস্যা হলো সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর দর্শকরা সালমান শাহ’র অভিনয় যখন খেয়াল করলেন, তখন আর বাকিদের অভিনয় মেকি ও হাস্যকর মনে হতে লাগলো। এবং ওমর সানী আর একটা বড় ভুল করে ফেলেছিলেন সালমান শাহ’র রেখে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলোতে শাবনূরের বিপরীতে অভিনয় করে। যেমন কে অপরাধী, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবিতে ওমর সানি অধিকতর হাস্যকর হয়ে ওঠেন। ওদিকে মান্না যিনি ততোদিনে বুঝে গিয়েছিলেন সিনেমার রাজনীতি। সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর ওমর সানী-অমিত হাসানের বহু পেছন থেকে এসে নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নেন। ওমর সানী ক্রমেই তলিয়ে যান। আর হতাশায় মুটিয়ে যান।
ওমর সানী মানুষ হিসেবে খুব আবেগী, মানবিক। আবেগী হেতু মাঝে মধ্যে মাথা গরম করে ফেইসবুকে লাইভে এসে নানা কথা টথা বলেন। তাই বলে নব্বই দশকে বাঙলাদেশের সিনেমায় তার জনপ্রিয়তা অস্বীকার করা যাবে না। তার প্রচুর ভক্ত ছিলো।
যেমন এখন শাকিব খানের প্রচুর ভক্ত আছেন। ভক্তি সাধারণত যুক্তি মানে না। তাই শাকিব খানের বিরুদ্ধে কোন কথা ভক্তরা নিতে পারে না। শাকিবের বিরুদ্ধে কথা বললেই গালি দেন। শিল্প সংস্কৃতিতে সাধারণের রুচি তৈরি করে নিতে হয়। শিল্পী বা নির্মাতা যদি দর্শকের রুচিতে নেমে আসে তাহলে দর্শক আর উপরে উঠতে পারে না। আমাদের চলচ্চিত্রও দর্শক রুচি তৈরি বিষয়ে সচেষ্ট না হয়ে দিন দিন দর্শকের রুচিতে নেমে এসেছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
যাইহোক, এটা আমার একান্ত মতামত। কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে, দুঃখিত।