Select Page

সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি কেন?

সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি কেন?

তিন বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করে দর্শক মনে অমর সালমান শাহ। দর্শকদের মুকুট পেয়েছেন, কিন্তু একবারের জন্যও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ওঠেনি তার মুকুটে।

এই সময়ে সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ের মতো অভিনয় করেও বিচারকদের চোখ এড়িয়ে গেছেন বলে কারও কারও মত। আবার কেউবা বলছেন, প্রতিভাধর হলেও পুরস্কার জয়ের মতো সিনেমা তিনি পাননি।

এই অভিনেতার জন্মবার্ষিকীতে আবার দর্শক হৃদয়ে বাজছে অকালে তাকে হারানোর সুর। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম।

টেলিভিশন নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু করা ইমন চৌধুরীর ১৯৯৩ সালে সালমান শাহ নামে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায় ঘরে। এটা আত্মহত্যা না কি হত্যা, তার কিনারা এখনও হয়নি।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিভাগে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রতি বছরই তা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।

সালমান শাহ কেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পেলেন না?

উত্তরে তার প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সে সময়ে যারা জুরি বোর্ডে ছিল, তারা মনে করেছে সালমান শাহ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মতো অভিনয় করেননি। তাই তারা দেন নাই।”

তবে তিনি মনে করেন, কেয়ামত থেকে কেয়ামতে পুরস্কার জয়ের মতো অভিনয়ই করেছিলেন সালমান শাহ।

“আমার কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমায় সালমান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেত। কিন্তু সে সময় এফডিসিতে এটা নিয়ে অনেকে আন্দোলন করল যে, গল্প কপি করা ছবিকে পুরস্কৃত করা যাবে না। অথচ ছবির গল্প অনুপ্রাণিত হলেও আমরা তো আমাদের মতো করে বানিয়েছি। সালমান শাহ তার মতো করে অভিনয় করেছেন। তারপরও তাকে শুধু এই কারণ দেখিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হল না।”

“আমাদের দেশে মেধার মূল্যায়ন হয় না। এর পরে যারা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে, তাদের দিকে তাকালে সালমান শাহর জন্য শুধু আফসোসই হয়,” বলেন সোহান।

সালমান শাহকে নিয়ে ‘তোমাকে চাই’ বানিয়েছিলেন মতিন রহমান। সিনেমাটি যেমন ব্যবসাসফল হয়েছিল; তেমনি প্রশংসিত হয়েছিল সালমান শাহর অভিনয়।

মতিন রহমান বলেন, “জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডে যারা থাকেন, তাদের নিশ্চয়ই বুদ্ধিদীপ্ত বিবেচনা থাকে। তাদের কাছে সালমান শাহর অভিনয় হয়ত পুরস্কার পাওয়ার মতো মনে হয়নি।”

তবে তিনিও বলেন, “এই সিনেমায় ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটা ব্যবহৃত হয়। গীতিকার হিসেবে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে পুরস্কৃত করা যেত।

“নির্মাণের কথা বাদই দিলাম। হয়ত আমার চেয়েও অনেক ভালো নির্মাণ ছিল। কিন্তু সালমান, রুদ্র কিংবা অন্য অনেক অভিনেতা/অভিনেত্রীই পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার ছিলেন। এরা কেউ বিচারকদের বিবেচনায় আসেনি বলেই পুরস্কার পাননি। এখন আর বলার কিছু নেই।”

বিচারকদের সালমান শাহর প্রতি বিরূপ মনোভাব ছিল কি না- প্রশ্ন করলে মতিন বলেন, “না। এমন কিছু ছিল না। সালমানকে সবাই পছন্দ করত। দর্শক, সহশিল্পী, নির্মাতা সবাই তাকে ভালোবাসত। যারা জুরিবোর্ডে ছিলেন তারা তো বাংলাদেশেরই মানুষ। তারা এসব নিশ্চয়ই জানতেন।”

অনেকে মনে করেন, সালমান তখন সবে চলচ্চিত্রে এসেছেন, ফলে তার পুরস্কার জয়ের সময় পড়ে ছিল।

বিচারকদের তেমন কোনো চিন্তা ছিল বলে মনে করেন কি না- প্রশ্নে মতিন বলেন, “দুই একজনের ভেতর এমন চিন্তা কাজ করলেও বিচারক প্যানেল তো ১০-১২জনের সমন্বয়ে গঠিত। বাকিদের নিশ্চয় এমন চিন্তা ছিল না।”

তিনি মনে করেন, সালমান শাহর মৃত্যুর পর যে সিনেমাগুলো মুক্তি পেয়েছে, সেখানে কোনো একটির জন্য জাতীয় পুরস্কার তাকে দেওয়া যেত।

সালমান শাহকে নিয়ে ‘এই ঘর এই সংসার’ নামে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন সময়ের আলোচিত নির্মাতা মালেক আফসারী।

তিনি বলেন, “জাতীয় পুরস্কার অবশ্যই পেত। সে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তার অভিনয়, সংলাপ, চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া সবই ইউনিক। এই ঘর এই সংসার ছবিতে অভিনয়ের জন্যই জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল। লাখো দর্শক বলছে সালমান শাহর অভিনয় দেখে তারা কান্না করেছে। বিচারক প্যানেলের ১০-১২ জন তো আর এই লাখ লাখ দর্শকের বাইরের কেউ নন। তারা চাইলেই সালমান শাহকে বিবেচনায় আনতে পারতেন।”

মালেক আফসারী বলেন, “জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়ার সময় বিচারক প্যানেল যদি ভাবতে থাকেন, কে কোন দল করে, কে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে, সেটা দেখে পুরস্কার দিতে হবে, সেটা খুবই অন্যায়।”

জাতীয় পার্টির নেত্রী নীলা চৌধুরীর ছেলে ছিলেন সালমান শাহ।

“কোটি দর্শক যাকে ভালো বলতে পারে, যার অভিনয়ের প্রশংসা করতে পারে, ১২জন বিচারক তাকে ভালো মনে না করলে সালমান শাহর কিছুই যায় আসে না। আমি মনে করি সালমান শাহ আজীবন দর্শকের মাঝে বেঁচে থাকবে,” বলেন মালেক আফসারী।

 সালমান শাহ হৃদয়ে ছিলেন, থাকবেন

সালমান শাহকে নিয়ে ‘কন্যাদান’ নামে একটি সিনেমা বানান দেলোয়ার জাহান ঝণ্টু। তিনি বলেন, “সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার মতো কোনো চরিত্র পায় নাই। পুরস্কার পাওয়ার জন্য ভালো পরিচালক দরকার, ভালো চরিত্র দরকার। সালমান তা পায় নাই।”

কন্যাদান চলচ্চিত্রের সালমান শাহর অভিনয় কেমন হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মোটামুটি। পুরস্কার পাওয়ার মতো কোনো অভিনয় সে করে নাই।”

সালমান শাহর পরে যারা এ পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবাইকে সালমানের চেয়ে এগিয়ে রেখে এই নির্মাতা বলেন, “বিচারক প্যানেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, সচিব, চলচ্চিত্র বোদ্ধা, বড় সাংবাদিকরা থাকেন। তারা নিশ্চয়ই এসব ভালো বোঝেন।”

সালমান শাহ যে তিন বছর সক্রিয় ছিলেন, সেই ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অভিনয় করেছেন, সেই সময়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনবারই জেতেন শক্তিমান অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ।

আসাদ ১৯৯৩ সালে সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্রের জন্য, পরের বছর দেশপ্রেমিক চলচ্চিত্রের জন্য আলমগীর, পরের বছর অন্যজীবন চলচ্চিত্রের জন্য আবার আসাদ, তার পরের বছর অজান্তে চলচ্চিত্রের জন্য সোহেল রানা এবং তার পরের বছর দুখাই চলচ্চিত্রের জন্য আসাদ পুরস্কার পান।

সালমান শাহর সময়কার আরেক জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ওমর সানী বলেন, “সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ পাননি। তিনি ছবিই করেছেন মাত্র ২৭টা। শতাধিক সিনেমা করেও অনেকে পুরস্কার পাননি।”

এ প্রজন্মের চিত্রনায়ক নিরব হোসেন বলেন, “সালমান শাহ জাতীয়ভাবে ভালোবাসা পেয়েছেন। এখন যারা জন্ম নিচ্ছে তারাও সালমান শাহকে পছন্দ করে। তার কাজ দেখে। সালমান শাহ যদি বেঁচেও থাকতেন এবং পুরস্কার নাও পেতেন, তাও তার আক্ষেপ থাকত না বলে আমি মনে করি। দর্শকের ভালোবাসাটাই সালমান শাহর জন্য বড় জাতীয় পুরস্কার। তার আর কিছু লাগে না।”

*সালমান শাহর জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবেদনটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে পূর্ব প্রকাশিত।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

লেখক ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন