সাহিত্যের অভিযোজন : বিপ্লবী ফাগুন হাওয়ায়
ফাগুন হাওয়ায় (in spring breeze)
গল্প – টিটো রহমান
পরিচালনা – তৌকীর আহমেদ
শ্রেষ্ঠাংশে – তিশা, সিয়াম, সাজু খাদেম, রওনক হাসান, আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু্, আফরোজা বানু, শহীদুল আলম সাচ্চু, ফারুক আহমেদ, যশপাল শর্মা প্রমুখ।
মুক্তি – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
রেটিং – ৮/১০
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুরবেলার অক্ত,
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত।
প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে’
– একুশের কবিতা, আল মাহমুদ
ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের মৌখিকভাবে ভালোই শোনা যায়। চলচ্চিত্র ইতিহাসকে অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারে আমরা ভুলে যাই। তাই বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের জন্য ভাষা আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ছবির অভাব থাকে এদেশে। অভাবটা ঘোচালেন নির্মাতা তৌকীর আহমেদ।
তৌকীর আহমেদ তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে নিজেকে নতুনভাবে চেনাচ্ছেন দর্শকের কাছে। নতুন ছবি ‘ফাগুন হাওয়ায়’ তাঁর নতুন এক্সপেরিমেন্ট। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে অভিযোজন ঘটিয়ে ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ছবি উপহার দিলেন দর্শককে। টিটো রহমানের গল্প ‘বউ কথা কও’ থেকে নির্মিত হলো ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবি। নামকরণের পেছনে তৌকীর সৃজনশীল বরাবরই। ভাষা আন্দোলন বাংলা বঙ্গাব্দের হিসেব কষলে বসন্তে বা ফাল্গুনে হয়েছিল তাই সেই মৌসুম বা সময়কে মেনশন করেছেন ‘ফাগুন হাওয়ায়’ বলে। নামটি কাব্যিক ও সৃজনশীল।
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অমর অধ্যায়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের ঘোষিত প্রচারণার বিপরীতে ছাত্র আন্দোলন তৈরি হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশে। ছাত্র আন্দোলনের সেই ইতিহাসকে লেখক টিটো রহমান ‘বউ কথা কও’ গল্পে তুলে ধরেছেন। একটি পাখির বন্দীজীবন ও মুক্ত আকাশে বিচরণের স্বপ্নকে ঘিরে গল্পটি রচিত হয়েছে বিপ্লবী ভাষায়। পাখি মূলত রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করেছে স্বপ্নরাষ্ট্র বা ‘ইউটোপীয়’ চেতনায়। সেই রাষ্ট্র নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম করেছে তার তারুণ্যশক্তি দিয়ে। ছবিটি সেই গল্পের রাষ্ট্র ছবিতে বাস্তবসম্মতভাবে উঠে এসেছে।
বলিউড থেকে নেয়া অভিনেতা যশপাল শর্মা ছবিতে সবচেয়ে বেশি স্ক্রিনটাইম পেয়েছে। তাকে পারফেক্টলি কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক। তাঁর চরিত্রটি নেগেটিভ রোলে পাকিস্তানি শাসকের প্রতিনিধি যার কাজ তার সরকারের হুকুম একটি জনপদের মানুষের উপর প্রয়োগ করা। মানুষকে উর্দু শেখানোর প্রকল্পে হাত দেয়। জোরপূর্বক এ কাজের বিরুদ্ধে তরুণরা জেগে ওঠে। মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয়।
প্রতিবাদের ভাষায় ছবিতে স্পেসিফিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে গল্পে যা আছে তাকে কাজে লাগিয়ে নতুনত্ব এনে। পয়েন্ট আকারে বলা জরুরি :
১. পাখি
‘বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দী করে লাভ কি?’ সিয়ামের মুখের এ সংলাপ বনের পাখির বন্দীজীবনকে রাষ্ট্রের বাস্তবতায় দেখিয়েছে। ‘বন’ যেমন অনেক গাছপালার জায়গা ঠিক তেমনি ‘রাষ্ট্র’-ও অনেক মানুষের জায়গা তাই তার অধিবাসীদের আটকে ফেলা হলে প্রতিবাদ হবেই। তিশা তখন পাখিটিকে উড়িয়ে দেয় এবং এখানে বন্দীর বিপরীতে মুক্তির চেতনা আসে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে।
২. নাটক
তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সিয়াম, তিশা, সাজু খাদেম ও অন্য অনেকের মাধ্যমে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মঞ্চায়ন বা রিহার্সেল ক্যাম্পেইন দেখানো হয়েছে। ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ছিল দীনবন্ধু মিত্রের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভাষা। আন্দোলেনর শেকড়টি মজবুত করে দেখানো হয়েছে এখানে। এমনকি দোকানের নাম ‘কৃষ্ণকুমারী’ দেখানো হয়েছে যা ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক। মাতৃভাষা বাংলায় রচিত নাটকের ভাষা ছবিতে প্রতিবাদ হয়ে এসেছে।
৩. ভূত, জ্বিন
ভূত বা জ্বিন হয়ে ভয় দেখানো হয়েছে পাকিস্তানি শাসক যশপাল শর্মা বা দোসর ফারুক আহমেদকে। হরর পরিবেশ তৈরি করে প্রতিবাদ দেখানো হয়েছে।
৪. ডার্ক কমেডি
যশপাল শর্মা, ফারুক আহমেদের সংলাপে ডার্ক কমেডির ব্যবহার ছিল। হাস্যরসের মাধ্যমে ট্রল করা হয়েছে। যেমন – ফারুক আহমেদ উর্দু ক্লাস নেয়ার সময় ‘বউ কথা কও’ পাখির নামের অর্থ জানতে চায় তখন উর্দুতে অনুবাদ করে ফারুক বলে-‘বিবি, বাত কারো।’ এমন আরো সংলাপ আছে যেগুলোতে ট্রল করা হয়েছে কমেডি যোগ করে। তাছাড়া যশপাল, ফারুক তাদের পরিণতির দিকে যাবার সময়ও কমেডি ছিল প্রতিবাদ।
৫. মিছিল, দেয়াল লিখন
মিছিল ছিল দেখার মতো ছবিতে সাথে দেয়াল লিখনও। দেয়াল লিখনে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দেশলাই কাঠি’ কবিতার ব্যবহার কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মাল্টিস্টারার ছবির গুণে অভিনয়ের প্রতিযোগিতা পুরো ছবি জুড়ে। যশপাল শর্মার মতো পেশাদার বলিউড অভিনেতার সাথে আমাদের তিশা, ফজলুর রহমান বাবু, আবুল হায়াত যখন ডমিনেটিং অভিনয়টা করে যাচ্ছে আপনি দর্শক হয়ে গর্ব বোধ করতেই পারেন। তিশা-সিয়াম রসায়ন বা পারফরম্যান্স নিয়ে যাদের সন্দেহ ছিল ছবি দেখার পর তা নাও থাকতে পারে। ‘তোমাকে চাই’ গানটি তাদের রসায়নকে সুরেলা করেই দেখিয়েছে।
– আজকাল এত উর্দু বলেন ক্যান?
– উর্দু হইল মুসলমানগো ভাষা
– ভাষার আবার মুসলমানি করাইলেন ক্যামনে!
এই কথোপকথন লোম দাঁড় করিয়ে দেবে। অথবা পাকিস্তানি সরকারের আন্ডারে থাকা বাঙালি পুলিশ বাংলাকে সাপোর্ট করে যখন আপনার অনুভূতি অন্যরকম হতে বাধ্য। এসব ছবির বিশেষ দিক।
১৯৫১ থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত প্রেক্ষাপটে গ্রাম, শহর লোকেশন খুঁজে পাওয়া অবশ্যই কঠিন ছিল। বাগেরহাট, খুলনা থেকে লোকেশন নেয়া হয়েছে। ক্যামেরা কথা বলেছে বাস্তবতার দিক থেকে, মিছিলের সময় ড্রোন শটগুলো দেখতে ভালো লাগবে। সীমাবদ্ধতার কথা যদি বলা হয় তবে ইন্টেরিয়রে কারো কারো কাছে দু’একটি অসঙ্গতি ধরা পড়তে পারে। সাবটাইটেলে বাংলা ও ইংরেজিতে গোলযোগ দেখা গেছে কিছু কিছু জায়গায়। পুরনো বানানরীতিতে ‘পাকিস্থান, সহযোগীতা’ এগুলো অনেকের চোখে লাগতে পারে।
চ্যালেন্জ নেয়াকে অ্যাপ্রিশিয়েট করা উচিত। তৌকীর আহমেদ ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ছবি হিসেবে সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে অভিযোজন করে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নির্মাণ করেছেন। এতদিন যারা ভাষা আন্দোলনের ছবি নেই বলে আক্ষেপ করেছেন তাদের কর্তব্য ছবিটি দেখা এবং অন্যদের দেখতে বলা। হতে পারে তৌকীর আহমেদ এতে অনুপ্রাণিত হয়ে পরের ছবিতে নতুন কোনো ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেবেন।
‘এখন যৌবন যার
মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’
হেলাল হাফিজের কবিতার সাথে ছবিতে মিছিলে যাবার জন্য আকুতি দেখে আপনারও গা শিউরে উঠতে পারে মিছিলে যাবার জন্য যে মিছিল থেকে জন্ম নিয়েছিল ভাষা আন্দোলনের বিপ্লবী ফাগুন হাওয়া।