Select Page

সিনেমার পোস্টার: সময়ের সাথে সাথে শিল্পটিল্প ধুয়ে চলে গেছে

সিনেমার পোস্টার: সময়ের সাথে সাথে শিল্পটিল্প ধুয়ে চলে গেছে

সৈয়দ শামসুল হকের কোন একটি উপন্যাসে সিনেমার পোস্টার নিয়ে বর্ণনা ছিলো। উপন্যাসের নাম মনে নেই। সিনেমার পোস্টারের বর্ণনাটা ছিলো এমন, পোস্টারে নায়িকাকে প্যাঁচিয়ে একটা সাপ নায়িকার স্তনের উপর ফণা তুলে আছে। বেদের মেয়ে জোছনা ও শঙ্খমালা সিনেমায় অঞ্জু ঘোষকে দেখেছি হেতু এই বর্ণনা পড়ে কল্পনায় অঞ্জু ঘোষকে প্যাঁচিয়ে একটি শাপ তার স্তনের কাছটায় ফণা তুলে আছে এমন একটি দৃশ্যই ভেসে ওঠে।

সিনেমাহলে আমার দেখা অঞ্জু ঘোষের প্রথম সিনেমা ডাকু মর্জিনা। নব্বই দশকের একেবারে শুরুর দিকে বাবার চাকরি সূত্রে গ্রাম থেকে মফস্বল শহরে স্থানান্তরিত হই। আমাদের বাসা থেকে খুব কাছে ছিলো সোনালী টকিজ। ফলে বাসা থেকে সিনেমাহলের গানবাজনা, সংলাপ, হৈচৈ সব শোনা যেতো। আমি প্রতিদিন গিয়ে সিনেমাহলের পোস্টার দেখে আসতাম। টিকিট কাউন্টারের ওখানটায় নানান সিনেমার পোস্টার ছিলো। সেইসব পোস্টার দেখে দেখে সিনেমা সম্পর্কে ধারণা নিতে চেষ্টা করতাম। যদিও বাঙলাদেশের সিনেমার পোস্টার মূলত সিনেমার মতোই বৈচিত্রহীন। সিনেমাহলের সামনে বড় ব্যানার টানানো থাকতো। হাতে আঁকা গোলাপি রঙের নায়ক-নায়িকার মুখ সম্বলিত সেইসব ব্যানারে নায়ক-নায়িকার কিছুটা আদল শুধু ধরা পড়তো। ব্যানার খুব একটা টানতো না। তবে পোস্টার দেখতে যেতাম। বিশেষ করে সিনেমার কিছু স্থিরচিত্র টানানো থাকতো একটা বোর্ডে, সেটা দেখতে যেতাম। একই জিনিস তবু সারা-সপ্তাহ ধরে সেটাই দেখে দেখে ফিরতাম। চিকন-চাকন একটা লোক রিকশার দুইপাশে পোস্টার ঝুলিয়ে মাইকিং করতো, ‘হ্যাঁ ভাই, নাচেগানে ভরপুর নায়িকা অঞ্জু ঘোষের ছবি ডাকু মর্জিনা সোনালী টকিজের রূপালি পর্দায় দেখতে চলে আসুন।’ উনার কণ্ঠটা অনেকটা রেডিওর মাজহারুল ইসলামের মতোই ছিলো। কিংবা মাজহারুল ইসলামের মতোই বলতো।

যাইহোক, এই ভূ-খণ্ডে সিনেমা শিক্ষিত ও শিল্পীমনা মানুষের হাত ধরে সূচিত হলেও, ক্রমেই সিনেমার চোখ ধাঁধাঁনো উজ্জ্বল জগত চলে যায় ধনী রুচিহীন ফটকাবাজদের হাতে। আর যেহেতু কোন ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠেনি, তাই গুরুমুখী শিক্ষায় সিনেমার টেকনিক্যাল বিষয়াদি হয়তো গুরু থেকে শিষ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে, কিন্তু শিল্পবোধ, রুচি ইত্যাদি গুরু থেকে শিষ্য খুব একটা নিতে পারে নাই বোধ করি। ফলত বাঙলাদেশের সিনেমা ক্রমেই খারাপের দিকে গেছে। একই কথা সিনেমার পোস্টারের ক্ষেত্রেও। আপনি যদি মুখ ও মুখোশ থেকে শুরু করে সুতরাং, আনোয়ারা, ধীরে বহে মেঘনা, গোলাপি এখন ট্রেনে, আবার তোরা মানুষ হ প্রভৃতি সিনেমার পোস্টার দেখেন, তবে দেখবেন যে, একটা শিল্পীত স্পর্শ পোস্টারে রয়েছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শিল্পটিল্প ধুয়ে চলে গেছে।

শুরুর দিকে পোস্টার হাতে এঁকে ছাপাখানায় দেয়া হতো। কিন্তু পরবর্তীতে আধুনিক ছাপাযন্ত্রে ফটোগ্রাফ থেকেই পোস্টার তৈরি হতো। এইসব জেনেছি হানিফ পাপ্পুর কাছে। তিনি ঢাকাই সিনেমার পোস্টার-ব্যানার আঁকতেন। এখনো আঁকেন। আমি আদতে নব্বই দশক থেকে পরবর্তী সময়ের বাঙলাদেশের সিনেমা নিয়েই দুই-একটা কথা বলতে চাই। বলছিলাম, বাঙলাদেশের নব্বই দশকে সিনেমার যে পোস্টারগুলো দেখেছি, সেগুলোতে মূলত কোন আর্ট ছিলো না৷ পোস্টারগুলোও সিনেমাগুলোর মতোই বৈচিত্রহীন। প্রধান নায়ক-নায়িকার মুখমণ্ডলের ছবি বড় করে দিয়ে, ছোট ছোট করে আর আর অভিনেতা অভিনেত্রীদের মুখের ছবি রেখে পোস্টার তৈরি করতো। বোধ করি সিনেমায় কে কে অভিনয় করেছে সেটা জানান দেয়াই ছিলো সিনেমার পোস্টারের উদ্দেশ্য। দু-একটা সিনেমার পোস্টারে হয়তো বোমা ফুটছে, গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামছে, নায়ক -নায়িকা হাত ধরে নাচছে- এমন ছবিও থাকতো।

সম্ভবত আমি তখন ৩ ক্লাসে পড়ি। ইত্তেফাক পত্রিকার পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়ে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার পোস্টার ছাপিয়েছিলো। পোস্টারটিতে মৌসুমী পেটে গুলি খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, পাশেই হাঁটু গেঁড়ে সালমান শাহ পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে এমন একটা ছবি ছিলো। এর আগে শুধু একটা ঘটনার স্থিরচিত্র দিয়ে এমন পোস্টার দেখিনি। আমি টিএন্ডটি অফিসের পত্রিকা থেকে এই পাতাটি চেয়ে এনে বাসায় টানিয়ে রেখেছিলাম।

আরও একটি সিনেমার পোস্টারের কথা মনে আছে। হুমায়ুন ফরিদীর ন্যাড়া মাথা ফুলে আলু হয়ে আছে। এমন বড় বড় পোস্টারে শহর ছেয়ে গেলো। সিনেমার নাম অপহরণ। শহীদুল ইসলাম খোকনের সিনেমা। মনে আছে, সেই সময় সাত টাকায় স্প্রাইট পাওয়া যেতো। স্প্রাইটের বোতলের ছিপির নিচে উপহার হিসেবে ৮০০ সিসির গাড়ি, মোটরসাইকেল, ইয়োইয়ো ইত্যাদি উপহার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। সেই সময় বড় মামা বেড়াতে এলেন, স্প্রাইট খাওয়ার কথা বলে সাত টাকা নিয়ে সম্ভাব্য উপহারের লোভ কাটিয়ে দেখেছিলাম অপহরণ। আই আইয়ো! শহীদুল ইসলাম খোকনের সিনেমা মানেই বড় বড় পোস্টারে ছেয়ে যেতো।

কাজী হায়াতের চাঁদাবাজ সিনেমার একটি পোস্টার ছিলো অন্যরকম। রাজীব ফোকাসড। আর একটা সিনেমার পোস্টারের কথা বলতে চাই। মুক্তির সংগ্রাম সিনেমার একটি পোস্টার। ‘টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম ! নায়িকা মৌসুমীকে নিয়ে ওমরসানি উধাও’। – এইরূপ লেখা ছিলো পোস্টারে। তখন ছোট ছিলাম হেতু বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি বোধ হয় তারা পালিয়ে গেছে। সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর মুক্তি পাওয়া সত্যের মৃত্যু নাই সিনেমার পোস্টারটিও মানুষের বুকে শূন্যতার সৃষ্টি করেছিলো।

নব্বই দশকের শেষের দিকে সিনেমায় যেমন অশ্লীলতা শুরু হয়। পোস্টারেও অশ্লীলতা দেখা যায়। সেই আলাপে যাওয়ার আগে আমি দুটি সিনেমার পোস্টারের কথা বলতে চাই। তখন আট ক্লাসে পড়ি সম্ভবত। পৃথিবী তোমার আমার সিনেমার একটি পোস্টারে শাবনুর ভেজা খোলা শরীর নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে (অবশ্যই ছবিটি বুকের উপর থেকে) পেছন থেকে জড়িয়ে আছে রিয়াজ। পথে যেতে যেতে এই পোস্টার আঁড় চোখে দেখেছি বহুবার। আর একটি সিনেমার পোস্টার হচ্ছে তেজি সিনেমার। পোস্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মান্নার পায়ের কাছে ভাঁজ হয়ে বসেছিলো নায়িকা একা। এরপরতো মোটামোটা নারীদের স্তন ও গলাকাটা শরীর নিয়ে সিনেমার পোস্টারের যুগ চলে আসে। সেই সময়টায় সিনেমাহলে একটা শ্রেণীর দর্শকই অবশিষ্ট ছিলো। ফলত তাদের আকৃষ্ট করতে গলাকাটা পোস্টারের শহর-গ্রাম-গঞ্জ ছেয়ে যায়। পোস্টারের অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শহীদুল ইসলাম খোকন তার যোদ্ধা সিনেমার পোস্টারে কোন ছবিই রাখেন নি। কিন্ত কোন লাভ হয়নি।

বাঙলাদেশের সিনেমার অশ্লীলতম পোস্টার সম্ভবত ‘নিষিদ্ধ নারী‘ সিনেমার। পোস্টারে নায়িকা মুনমুন ন্যাড়া মাথা নিয়ে হা করে ছিলো। আর পোস্টারে লেখা ছিলো নগ্নতা মানেই অশ্লীলতা না।

#নব্বই_দশকের_বাঙলাদেশের_সিনেমা_নিয়ে_কথাবার্তা


মন্তব্য করুন