সিনেস্কোপ: এশিয়ার সবচেয়ে ছোট হলে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা!
‘বাংলাদেশি চলচ্চিত্র উৎসব’ নামক সপ্তাহব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসবের মধ্য দিয়ে গতমাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলো নারায়ণগঞ্জের প্রথম মিনিপ্লেক্স ‘সিনেস্কোপ’। ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে নগরীর আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে এই ক্ষুদ্র সিনেমা হলের উদ্বোধন করা হয়।
আধুনিক এই প্রেক্ষাগৃহটি তৈরী হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিনেমাকার এর যৌথ উদ্যোগে। স্বাধৗন ধারার নির্মাতা মোহাম্মাদ নূরুজ্জামান ডালিম (পরিচালক, মাস্তুল) তার স্বপ্নকে সত্যি করার মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জবাসী তাদের শহরের প্রথম মিনিপ্লেক্স পেলো।
এই মিনিপ্লেক্সের সবথেকে ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট হলো, এর আসনসংখ্যা মাত্র ৩৫টি! নেট ঘেঁটে পুরো এশিয়াতে এর থেকে কম আসনবিশিষ্ট মিনিপ্লেক্স খুজেঁ পাইনি। এর কাছাকাছি সংখ্যার একটি মিনিপ্লেক্স আছে জাপানে, যার আসনসংখ্যা ৪০। সুতরাং, এটিকে এখন এশিয়ার সবচেয়ে ছোট সিনেমাহল বলা-ই যায়!
তো গত ২০শে সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) রাতে ঠিক করলাম এ সিনেমা হল কেমন সেটা একবার দেখা যাক। এর পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ শহরটা একটু ঘুরে দেখা যাবে, নারায়ণগঞ্জে এখনো টিকে থাকা বাকি সিনেমাহলগুলোর অবস্থা কেমন সেটাও পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এক ঢিলে অনেক পাখি মারার মতন! ব্যস, পরেরদিন (শনিবার) সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম যান্ত্রিক কোলাহল থেকে একটু দুরে থাকার উদ্দেশ্যে।
বাসে করে চাষাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গেলাম। এরপর একটা রিক্সা নিলাম আলী আকবর চুনকা পাঠাগার পর্যন্ত। রিক্সা থেকে নেমে দেখি বেশ বড় একটা লাইব্রেরী, এর ভেতরেই মিনিপ্লেক্স। রাস্তার অপরপাশে রয়েছে গুলশান সিনেমা হল, সেখানে চলছে আমদানি করা ছবি “প্যানথার”।
বাইরে জনমানুষে পূর্ণ একটি এলাকা হলেও ভেতরের পরিবেশ খুবই শান্ত, নীরব। ভেতরে গিয়ে “মাটির প্রজার দেশে” একটা টিকেট কেটে আবার বেরিয়ে পড়লাম। শো শুরু হতে এখনো প্রায় দুই ঘন্টা বাকি; আরেকটু ঘুরে দেখি কি কি দেখা যায়।
গুলশান হলটার বাহ্যিক গঠনটা অনেকটা ঢাকার রায়েরবাজারের মুক্তি সিনেমাহলের মতো। হলের পরিবেশ ততটা ভালো লাগলো না, কিন্তু টিকেটের দাম তুলনামূলক বেশ চড়া। ঢাকার মুক্তিতে এর অর্ধেক দামে সিনেমা উপভোগ করা যায়। অন্যদিকে চাষাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম নিউ মেট্রো সিনেমাহলে, এটার পরিবেশ অনেকটা ঢাকার মিরপুরের এশিয়া সিনেমাহলের মতো। চলছে দেশী ছবি “অবতার”, এখানেও টিকেটের দাম একটু বেশিই মনে হলো।আর সিনেস্কোপে সকালে দিকে টিকিটের দাম ১০০ টাকা, দুপুরের পর ১৫০ টাকা। অল্প সময়ে আরো অনেককিছু দেখলাম, সেগুলো নিয়ে নাহয় পরে আলোচনা করা যাবে।
ঠিক সময়ের আগেই পুনরায় সিনেস্কোপে এসে পৌছালাম। হলরুমের বাইরের জায়গাটা বেশ বড়, উত্সবে দেখানো হচ্ছে এমন চলচ্চিত্রের পোস্টার লাগানো সেখানে। কিছু পুরোনো ভিউকার্ড, স্ট্যাম্প ও রঙিন সিল দেখতে পেলাম। আশা সিনেমা হল নামে একটি সিনেমাহলের টিকেট, পোস্টার এখানে দেখতে পেলাম। এই হলটি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, হয়তো পূর্বে আশেপাশেই এ হলটি ছিল।
হলরুমের বাইরের জায়গা প্রশস্ত হলেও ভেতরের জায়গাটা বেশ ছোট, অতিরিক্ত আসন বসানোর মতো তেমন কোনো জায়গা রাখা হয়নি, একদম গুনে গুনে পঁয়ত্রিশটাই আসন ধরেছে। সেইসাথে দর্শক রেসপন্স দেখে আরো বেশি হতাশ হয়েছিলাম, গুনে গুনে আমিসহ নয় জনকে খুজেঁ পেলাম। হলকর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানলাম, গতকাল “সূর্য দীঘল বাড়ী” ও “গোলাপী এখন ট্রেনে” হাউসফুল গেছে। আজ সকালের “সূর্য দীঘল বাড়ী” এবং “মাটির প্রজার দেশে” এর সেল কম হলো, আবার বিকেলের “ছুটির ঘণ্টা” ও রাতের “সুজন সখী” অগ্রিম বুকিং এ হাউসফুল হয়ে গেছে।
“মাটির প্রজার দেশে” এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম। এর আগে স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখেছিলাম। এ সিনেমাটা গল্পের দিক থেকে বলুন, অভিনয়ের দিক থেকে বলুন, কিংবা কারিগরি দিক থেকে বলুন… সবদিক থেকেই মুগ্ধতা ছড়ানোর মতো। আমি মনে করি নিয়মিত সিনেমা দেখা কোনো বাঙালি দর্শকের জীবদ্দশায় অন্তত একবার এছবিটা দেখা উচিত।
এ ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে একজন প্রতিনিধি এসেছিল দর্শকদের রেসপন্স গ্রহন করতে, তিনি ছবি শুরু হওয়ার আগে এবং শেষ হওয়ার পরে দর্শকদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
সব মিলিয়ে সিনেস্কোপ পরিদর্শন শেষে তাদের প্রতি আমার কিছু পরামর্শ কিংবা অনুরোধ রইলো:-
১। এটা পরম ভাগ্যের ব্যাপার, সিনেমাহলটি একটি জনমানবপূর্ণ জায়গায় স্থাপন করা গেছে। পাশেই রয়েছে আরেকটি সিনেমাহল, সুতরাং এখানে সিনেমাপ্রেমী দর্শকের অভাব হবে না। তাই এই মিনিপ্লেক্স সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে আসনসংখ্যা বাড়ানো। এশিয়ার ছোট সিনেমাহল নিয়ে গর্ব করে বিলাসীতা দেখানোর সময় এখন না, এখন বাংলা সিনেমা খুবই খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হলরুমের বাইরে যে পরিমাণ জায়গা পড়ে আছে, চাইলেই সেখানে ৩৫ আসনের আরো একটি মিনিপ্লেক্স তৈরী করা যাবে।
২। এ হলে সাম্প্রতিক সময়ের সিনেমা আনার চেষ্টা করতে হবে, এক্ষেত্রে চাইলে আপনারা স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ব্লকবাস্টার কিংবা চট্রগ্রামের সিলভার স্ক্রিনের সাথে কোলাবরেট করে আনতে পারেন। এতে করে খরচ কম হবে, সাথে নতুন সিনেমা আনাও সহজতর হবে।
৩। সিনেস্কোপের প্রমোশন আরো জোরালো করতে হবে, সেটা অনলাইনে হোক কিংবা মাঠপর্যায়ে। একশোজন সিনেস্কোপ সম্পর্কে জানলে এর মধ্যে অন্তত পাঁচজন এহলে এসে সিনেমা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করবেই!
৪। জনপ্রিয় সব পাবলিক ফিগারকে তাদের সিনেমার প্রমোশনের জন্য এখানে আনা যেতে পারে। বর্তমান নাম্বার ওয়ান, শাকিব খানের জন্মস্থান এই নারায়ণগঞ্জ এ। সিটি কর্পোরেশন উদ্দ্যোগ নিলে তিনি নিশ্চয়ই তার জন্মভূমিতে আসতে আপত্তি জানাবে না!
৫। ভালো একটি মিনি ফুড কোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে; সফট ড্রিংকস, চিপস, ফাস্টফুড, কফি প্রভৃতি খাবার যেনো হাতের নাগালে পাওয়া যায়।
৬। সর্বোপরি, সিনেস্কোপকে দিনের পর দিন সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য আরো লোকবলের ব্যবস্থা করতে হবে। যথেষ্ট লোকবল না থাকলে যেকোনো বড় দায়িত্ব সহজে সামলানো যায়না।
উপরোক্ত বিষয়গুলি আমলে নিলে ভবিষ্যতে এটি নারায়ণগঞ্জের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠবে। আমার বিশ্বাস, নারায়ণগঞ্জবাসীর আক্ষেপ একদিন দুর হবে এবং ভবিষ্যতে তারা এরকম একাধিক মিনিপ্লেক্সে চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারবে। কষ্ট করে ঢাকায় আসতে হবে না।