সুনেত্রা কাহিনী
সুনেত্রা..
সুন্দর নেত্রের অধিকারী..
শুধুই সুন্দর নেত্রের অধিকারী নয় সুন্দর অভিনেত্রীও। চোখের অভিনব গড়ন বা বাদামী ধাঁচ একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তাঁর। কণ্ঠেও ছিল মোহনীয়তা। সহজেই আকর্ষণ করার মতো। অনেক ছবি না করলেও মানসম্মত কাজ করেছে।
জন্ম ভারতের কলকাতায় ১৯৭০ সালের ৭ জুলাই। মূলনাম রীনা সুনেত্রা কুমার। সম্ভবত ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছিল তাই ফাতেমা হক নামেও দেখা যেত। তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় মাস্টার্স।
মঞ্চ থেকে তার অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয়। কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’-য় রানার্স আপ হয়েছিল এবং চুক্তি অনুযায়ী টলিউডে ‘সহধর্মিণী’ ছবিতে অভিনয় করেছিল। সেখানে ‘সিঁথির সিঁদুর, মনসা কন্যা, দানব’-সহ আরো ছবিতে অভিনয় করেছিল। বাংলাদেশী পরিচালক মমতাজ আলী তাকে ঢালিউডে অভিষেক আনেন। প্রথম ছবি ছিল তখনকার হার্টথ্রব নায়ক জাফর ইকবালের বিপরীতে ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘উসিলা।’ ঢালিউডেই সবচেয়ে বেশি ছবি করেছিল। তখন সময়টা এমন ছিল কলকাতা থেকে বেশকিছু নায়িকা ঢালিউডে এসেছিল। এ বিষয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘চিত্রালী’-তে কভার স্টোরি হয়েছিল এবং সুনেত্রাকে নিয়েও হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার মায়াবী হাতছানি।’ সুনেত্রা পাকিস্তানি ছবিতেও কাজ করেছিল যার মধ্যে সেখানকার হার্টথ্রব নাদিমের বিপরীতেও ছিল।
ঢালিউডের সেই সময়ের ব্যস্ত সব নায়ক জসিম, সোহেল রানা, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না সবার সাথেই সুনেত্রা ছবি করেছে। সেই হিসেবে ব্যস্ত নায়িকা ছিল অনায়াসে।
বাংলাদেশে তার উল্লেখযোগ্য ছবি : ‘পালকি, ভাইবন্ধু, বোনের মতো বোন, যোগাযোগ, ভুল বিচার, সাজানো বাগান, রাজা মিস্ত্রী, ঘর ভাঙ্গা ঘর, কুচবরণ কন্যা মেঘবরণ কেশ, শুকতারা, সুখের স্বপ্ন, রাজা জনি, বাদশা ভাই, ছোবল, ভাই আমার ভাই, দুঃখিনী মা, বন্ধু আমার, বিধান, নাচে নাগিন, সর্পরাণী, বিক্রম, উসিলা, লায়লা আমার লায়লা, শিমুল পারুল, ভাবীর সংসার, আমার সংসার, ধনরত্ন, নির্দয়, উচিত শিক্ষা, ঘরের সুখ, সাধনা, আলাল দুলাল।বাংলাদেশে অভিনীত শেষ ছবি – ঘর ভাঙ্গা ঘর।
১৯৯০ সালে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘পালকি’ ছবিটি সুনেত্রাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি দিয়েছিল। গ্রাম-বাংলার ছবিতে সুনেত্রা নিয়মিতই ছিল কিন্তু এ ছবিটি তাকে খ্যাতি দিয়েছিল। ডাবল রোলের অভিনয় করেছিল প্রবীরমিত্র ও ফারুকের বিপরীতে। ছবির গল্পে কুষ্ঠরোগীর চরিত্রে অভিনয় করেছিল। নিজের কুষ্ঠ হওয়ার কারণে নিজেকে অপরাধী ভেবে সন্তানকে ফেলে চলে যায় বনে। যাবার আগের সিকোয়েন্সটি অসম্ভবরকম টাচি। তার স্বামী প্রবীরমিত্র মাঠে নামাজ পড়ছে মেয়েকে শুইয়ে রেখে আর সুনেত্রা নিজের মেয়েকে দূর থেকে দেখছে। আদর করতে চাইলেও পারছে না। খুবই টাচি ছিল সিকোয়েন্সটি। অনেকদিন পর মা সুনেত্রা আবার ফিরে আসে। একটা পালকিকে ঘিরে ছবির গল্প অন্যদিকে মোড় নেয়। খুব করুণ গল্পের ছবি ছিল এবং সুনেত্রা ডাবল রোলে অসাধারণ অভিনয় করেছিল। অনেকের মতে এটাই তার সেরা ছবি। তবে ‘বোনের মত বোন’ ছবিটিও অন্যতম সেরা।
বড়বোন তার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেয় সাথে দিয়ে যায় ভালোবাসার মানুষ কাঞ্চনকেও। একটা ভুল বোঝাবুঝিতে কাঞ্চনের সাথে বিয়ে হয় সুনেত্রার বড়বোনের। কাঞ্চন সুনেত্রাকে ভালোবাসত। সুনেত্রা পরে জিদের বশে মিজু আহমেদকে বিয়ে করে। শেষের সিকোয়েন্সটি অনবদ্য ছিল। বড়বোনের কবরে সুনেত্রা এসে কপাল ঠুকছে আর চারদিকে জোরে জোরে বাতাস বইছে বেদনা বোঝাতে। তখনকার ছবিতে আবেগ ফুটিয়ে তোলা হত পারফেক্টভাবে।
‘ভাইবন্ধু’ ছবিতে সুনেত্রা ও কাঞ্চনের ‘সত্য কি মিথ্যে কি’ এ গানটি খুবই জনপ্রিয়। গানের নির্মাণ সেই সময় অনুযায়ী খুব আধুনিক ছিল। গানের শুরুতে কাঞ্চন পড়ে যায় বিপদে। সুনেত্রা গান না শুনে ছাড়বেই না বেচারা কাঞ্চন তো পড়ল বিপদে। তখন বন্ধু জাফর ইকবালই ছিল ভরসা। সোফার ওদিকে লুকিয়ে হাতের ক্র্যাচগুলোকে গীটারের মত ব্যবহার করে শুরু হল গান। গানের মধ্যে শুরুতেই সুনেত্রার করতালি দিয়ে সুপার নাচ দেখে বলতেই হয় মেয়েটি শিখেই অভিনয়ে এসেছিল। গানটির কথা, সুর, অভিনয়, লোকেশন চোখ জুড়ানো। এ ছবির ‘তুমি এলে সমুখে’ এ গানটার সুর অ্যামেজিং। কাঞ্চনের সাথে সুনেত্রার অসাধারণ স্টেজ পারফরম্যান্স ছিল। হাতে গীটার আর চমৎকার নাচ। এখন আইটেম গানের ছলে যে তথাকথিত আধুনিক সেজে অশ্লীলতা করা হচ্ছে তখনকার এই গানগুলোর কাছে এগুলো কিছুই না। গানটির কথা, সুর আর প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের গায়কীতে মুগ্ধতা আনে। ‘ভাইবন্ধু’-র শেষ সিকোয়েন্সে জাফর ইকবাল যখন নিজের চোখ নিজে অন্ধ করে দেয় তখন অপারেশন থিয়েটারে কাঞ্চন, দিতি, সোহেল চৌধুরী তাদের সাথে সুনেত্রার চমৎকার স্যাড এক্সপ্রেশনটিও চোখে ভাসে। জাফর ইকবালের বিপরীতে ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর, বন্ধু আমার’ ছবিতেও তার অভিনয় অসাধারণ ছিল। অভিনয়সমৃদ্ধ আরো ছবি আছে তার বিশেষ করে ফোক ঘরানার ছবিগুলোতেও অনবদ্য ছিল।
সুনেত্রা বর্তমানে কোথায় থাকে সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ভাসা ভাসা কিছু তথ্যে আছে পাকিস্তানি এক মঞ্চ অভিনেতাকে বিয়ে করে সেখানেই থাকে আবার বাবার বাড়ি কলকাতাতেই থাকার কথা শোনা যায়।
সুনেত্রা আমাদের আশি-নব্বই দশকের বাণিজ্যিক ছবির উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী। গ্রাম-শহর প্রেক্ষাপটে সহজ-সরল মেয়ে থেকে আধুনিক মেয়ের ভূমিকাতেও অভিনয় করে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করেছিল। ভালো ছবি, ভালো অভিনয় এগুলো যতদিন টিকে থাকবে সুনেত্রাও বেঁচে থাকবে ততদিন আমাদের চলচ্চিত্রে।