সুন্দর কাঠামোতে বসানো নড়বড়ে ‘নীলচক্র’

‘নীলচক্র’ ক্যারেক্টার বিল্ডআপেও যথেষ্ট সময় নিতে পারেনি, তাই কারো কাছ থেকে অসাধারণ কোনো পারফরম্যান্স বের হয়ে আসেনি। আরিফিন শুভ এরকম বা এর কাছাকাছি চরিত্র অনেক করেছেন। তিনি ভালো অভিনেতা তাই চেষ্টা করেছেন ভিন্নতা আনার। কিন্তু যেহেতু চরিত্রটাই তেমন ভালোভাবে লেখা হয়নি তাই তাকেও আমাদের কাছে বিশেষ কিছু মনে হয় না …

[স্পয়লার নেই]

শহরে হঠাৎ করে নতুন প্যাটার্নের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যা করা প্রায় সবাই হলেন অল্পবয়সী মেয়ে। আত্মঘাতী হওয়ার আগে কিংবা পরে তাদের নিয়ে বানানো ব্লু-ফিল্ম ভাইরাল হচ্ছে। সাধারণ মানুষজন একে স্বাভাবিক মনে করলেও আদতে স্বাভাবিক কোনো চিত্র নয়, কারণ একই প্যাটার্নের হত্যা বারবার হচ্ছে। এরকম একটি কেসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ফিরিয়ে আনা হয় সিআইডি থেকে একসময় জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো এগ্রেসিভ অফিসার ফয়সাল শাহরিয়ারকে (আরিফিন শুভ)। তিনি স্বভাব মতো ইনভেস্টিগেশন করতে থাকেন এবং একটা সময়ের পর তিনি বুঝতে পারেন, খুনগুলোর পেছনে স্বয়ং তার নিজের অতীত জীবনের কোনো একটি কানেকশন রয়েছে।

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ মুক্তির প্রায় দেড় বছর পর আরিফিন শুভ বড়পর্দায় ফিরে এলেন। ফেরাটা অবশ্য খুব একটা আয়োজন নিয়ে হলো না। ‘নীলচক্র’ চলচ্চিত্রে তেমন ভাব-সাব ছিল না। দেখে মনে হয়েছে স্বল্প বাজেটে বানানো। আরিফিন শুভর স্টারডম যতটুক লেভেলে ছিল সে তুলনায় সিনেমার আয়োজন ছিল খুব কম।

অবশ্য এই কম আয়োজনের অনেকখানি আবার বেশ গোছানো। বিশেষ করে প্রশংসা করতে চাই সিনেমাটোগ্রাফি ও সম্পাদনার, খুব সুন্দর কালার টোন ও কম্বিনেশনের প্রতি খেয়াল রেখে প্রতিটি ফ্রেম ধরা হয়েছে। সাউন্ড ডিজাইন ও ডাবিং বেশ সুন্দর, কানের জন্য আরামদায়ক।

ভালো কাজ হয়েছে সংলাপ রচনায়। ছিমছাম কিন্তু চমৎকার সব অভিব্যক্তি পাওয়া গিয়েছে আরিফিন শুভ, মন্দিরা চক্রবর্তী, প্রিয়ন্তী উর্বী, মাসুম রেজওয়ান, টাইগার রবি, মনির আহমেদ শাকিল, শাহেদ আলী, ফজলুর রহমান বাবুসহ সবার কাছ থেকে।

চলচ্চিত্রের প্রথমার্ধে চলচ্চিত্রের মেইন থিম খুব সুন্দরভাবে সেট আপ করা হয়েছিল। সুন্দরভাবে সেটআপ করা হয়েছিল সাবপ্লটগুলো। সেখানে সিঙ্গেল ফাদার আরিফিন শুভর সঙ্গে মেয়ের খুনসুটি, মন্দিরা চক্রবর্তীর পারিবারিক অবস্থা আমরা দেখতে পাই, একটি অসাধু চক্র দেখানো হয় যা তদন্ত চলমান কেসটির সঙ্গে যুক্ত। প্রথমার্ধ দেখে মনে হচ্ছিল বিরতির পরের অংশে খুব জবরদস্ত একখান সিনেমা আমরা পেতে যাচ্ছি।

কিন্তু আমার এই ছোট স্বপ্ন যেন হাওয়ায় মিশে গেলো সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধ দেখে। মনে হলো যেন ছোটবেলার গণিত বইয়ের মতো, অর্ধেক লোক কিছুদিন কাজ করে এরপর তারা বাড়ি চলে গিয়েছে, বাকিরা পুরো কাজ শেষ করেছে। এতো সম্ভাবনাময় একটি প্রথমার্ধ দেখার পর দ্বিতীয়ার্ধ কেন এমন গোঁজামিল হয়ে গেল, কেন সাবপ্লটের একটারও যথাযথ সমাপ্তি টানা গেল না, এমনকি খুনির মোটিভটাও অতটা শক্তপোক্তভাবে দেখানো গেল না, বুঝলাম না। দ্বিতীয়ার্ধ দূর্বল হওয়ার কারণে সিনেমার প্রথমার্ধে দেখানো ইনভেস্টিগেশন অংশটুকুও তখন ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে, কারণ সেটার জন্য সলিড রেজাল্ট আমরা ছবিজুড়ে দেখতে পাই না।

‘নীলচক্র’ ক্যারেক্টার বিল্ডআপেও যথেষ্ট সময় নিতে পারেনি, তাই কারো কাছ থেকে অসাধারণ কোনো পারফরম্যান্স বের হয়ে আসেনি। আরিফিন শুভ এরকম বা এর কাছাকাছি চরিত্র অনেক করেছেন। তিনি ভালো অভিনেতা তাই চেষ্টা করেছেন ভিন্নতা আনার। কিন্তু যেহেতু চরিত্রটাই তেমন ভালোভাবে লেখা হয়নি তাই তাকেও আমাদের কাছে বিশেষ কিছু মনে হয় না।

অন্যদিকে অভিনেত্রী মন্দিরা চক্রবর্তীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র এটি। ‘কাজলরেখা’য় অত্যন্ত সুন্দরী এ নায়িকার পারফরম্যান্স দূর্বল লেগেছিল। এখানে তার ডায়লগ ডেলিভারি একটু বেটার মনে হয়েছে। সাপোর্টিং কাস্টের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স পাওয়া গিয়েছে। টুংটাং নামক অ্যাপের সেলিব্রিটি প্রিন্স রিমন চরিত্রে মাসুম রেজওয়ান ও টিনএজ প্রিয়ন্তী উর্বি বেশ ভালো করেছেন। টাইগার রবিকে পজিটিভ কোনো ক্যারেক্টারে দেখতে পেলাম সেটিও বেশ ভালো লেগেছে। আফসোসের ব্যাপার হলো নায়ক, নায়িকা, ভিলেন…কারো চরিত্রই ভালো করে লিখা হয়নি।

‘নীলচক্র’ কীভাবে ভালো থ্রিলার হতে পারতো? সেটি নিয়ে একটি লম্বা আলোচনা করে ফেলা যাবে। অল্পকথায় যদি বলি, ভিলেনের মোটিভ ও হিরোর সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা শত্রুতা আরো বেশি সময় নিয়ে বিল্ডআপ করা উচিত ছিল। যে সাবপ্লট খোলা হয়েছে সেগুলোর যথাযথ ক্লোজার দেয়া উচিত ছিল। আর আরিফিন শুভর মেইন ইউএসপি হলো অ্যাকশন সিকোয়েন্স। অথচ এ সিনেমায় সেরকম কোনো অ্যাকশন সিকোয়েন্স নেই। এটা সংযুক্তি প্রয়োজন ছিল কেননা এতে ইনভেস্টিগেশন পার্ট আরো বেশি উত্তেজনাকর হতে পারতো।

সব মিলিয়ে ‘নীলচক্র’ হয়তো একবার দেখার মতো চলচ্চিত্র হয়েছে। একবার দেখলেও এর সমাপ্তি আপনাকে হতাশ করে দিতে পারে।