সু-রঙ্গ/সুড়ঙ্গ
(কাহিনিফাঁস। কাহিনিফাঁস।। কাহিনিফাঁস।।। চিত্রনির্মাতা বন্ধুর পরামর্শে..)
‘সুড়ঙ্গ’ ছায়াছবির মোটামুটি দুইটা অধ্যায় বলা যেতে পারে। প্রাক-সুড়ঙ্গ ও উত্তর-সুড়ঙ্গ; অর্থাৎ কিনা সুড়ঙ্গ কাটিবার আগের কাল ও পরের কাল। গল্পের গতি/পেইস, দৃশ্য-পরিকল্পনা, পোলাপাইন্যা প্রণয় অনুভূতির প্রকাশ বা অনুভূতির পোলাপাইন্যা প্রকাশ, আবহের নামে লাগাতার বাদ্যযন্ত্র পরিবেশন ইত্যাদি বিবেচনা করলে এটাকে দুইটা ছবিই বলা চলে। এবং সেদিক থেকে পরিণত দর্শকদের জন্য প্রথম অংশটা বাদ দিয়ে দেখালেই নির্মাতা সুবিচার করতেন বেশি। তবে এটাও ঠিক বাংলাদেশের দর্শকদের সামনে ৬০/৭০ মিনিটের কোনো মালামাল দেয়া যায় না। এটা প্রকৃতই ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ ছায়াছবির দেশ। আজকাল দর্শকরা যে ৩ ঘণ্টার জায়গায় ২ ঘণ্টার জন্যই হলে যেতে রাজি থাকছেন, তাতেই আমাদের সকলের খুশি থাকা উচিত। ফলে নির্মাতার প্রাক-সুড়ঙ্গ অংশটি না দেখালে চলছিল না। তাছাড়া তিনি হয়তো ভেবেছেন ওই অধ্যায়েই মাসুদের পত্নীপ্রেমকে ফুটিয়ে তোলা গেছে।
ত্রিসীমানায় দৃষ্টিপথে কোনো বাড়ি ঘর পড়ে না এমন একটি গ্রামে বেশ ক্যামেরা-উপযোগী লম্বা একটা বাড়িতে থাকেন মাসুদ। ত্রিসীমার একদিকে পাহাড়ের আভাস, আরেকদিকে চমৎকার একটা পুষ্করনি, একটু ত্যাড়ছা করে এলে দুটি একটি ঘোড়ার গাড়ি থাকে। জনমনুষ্য বলতে কিছু না-থাকায় ওই ঘোড়ার গাড়িগুলোও ক্যামেরা-উপযোগিতার আনন্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় মনুষ্যবিহীন একটা মেলা হয়; একটা অন্তত শালিস বসে মানুষজন নিয়ে – সেগুলো ধরে নিতে হবে বিশাআআল গ্রামের অন্য কোনো প্রান্তে আছে। সেখানে অবশ্যই ময়নার জনৈক ভাইয়েরও একটা বাসা থেকে থাকে যেখানে ময়নার সাথে মাসুদের বিয়েটা হয়। মাসুদ একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রি যাঁর দেশে থাকতে এক্সপার্টিজের সীমানা মোবাইল থেকে ফ্রিজসারানি, স্ট্রিট লাইট লাগানি থেকে আরও কী কী যেন। তাঁর পুরান একটা বাইক আছে যাতে চড়ে তিনি সারানি-মারানি করে থাকেন। তবে এই গ্রামের সবচেয়ে গরিবদের মধ্যেরও তিনি একজন; অন্তত সেরকমই প্রতিপাদ্য গল্পবলিয়ে নির্মাতার।
তিনি একজন লোভী প্রেমিকা হবুবউয়ের খপ্পরে পড়ে যান; এবং বুঝতে না-পেরে তাঁকে বিয়ে করে এনে বউয়ের লোভ মেটাতে হাঁসফাঁস করে টাকা বেশি আয়ের লক্ষ্যে মালয়েশিয়া যান। সেখানে গিয়ে বেতন ও জব-ডেস্ক্রিপশনজনিত প্রতারণার শিকার হন। ইত্যবসরে লোভী বউ মাসুদের জিগরি দোস্ত জহিরের সাথে প্রথমে যৌনমিলন তারপর বিবাহমিলন করেন; ও চলতি ভাষায় ‘ভেগে যান’। মালয়েশিয়া থেকে বউয়ের জন্য ফিরে এসে বাস্তবে গাদাগাদা পাওনাদারের চাপে পড়ে যান মাসুদ, যেসব ধারদেনা ওই লোভী বউয়ের কীর্তি। ফলে বাড়িটাও তাঁর বিক্রি করে দিতে হয় (ওই যে ক্যামেরাকাতর লম্বা বাড়িখানা)। এরপর শহরে (চট্টগ্রাম বা আশপাশ হবে) গিয়ে টাকা আয়ের জন্য যারপরনাই যা-তা করতে করতে ক্লান্ত ও মদ্যপ মাসুদ বুদ্ধি করতে থাকেন। তারপর সুড়ঙ্গ কেটে ব্যাংক ডাকাতি করে ফেলেন। কিন্তু টাকাটা ওভারট্রাম্প করে আরেক পক্ষ নিয়ে যায়। এই পুরা সময়ে মাসুদের ব্যক্তিত্বের একটা উল্লেখযোগ্য প্রতিপাদ্য ছিল বউপ্রেম। অর্থলোভী বউ এইসব ডাকাতিমূলক টাকার গন্ধে আবার প্রেমার্দ্র হয়ে ওঠেন। যাহোক, মধ্যিপথ্যে নানান ধরনের বাধা আসে মাসুদের – বেহাত টাকা, গ্রেপ্তার, জেলপালানি, সুড়ঙ্গ খুঁড়বার ৯টি মাস ইত্যাদি। কিন্তু এ দফা নানান হুজ্জত শেষে পুরান বউকে আবার ফিরিয়ে আনেন বটে; তবে মনের ভিতর মেলা হিংস্রতা সমেত। ইত্যবসরে বন্ধু ও বউয়ের বর্তমান স্বামী জহিরকে খুন করেন (সেটা আমাদের তেমন একটা দেখা লাগেনি)। নতুন একটা বাড়িতে (আবারও ত্রিসীমানায় কোনো বাড়িঘর ছাড়া বান্দরবানের একটা বাড়ি) পুরান বউকে ৩৪ কোটি টাকা সমেত তোলেন। আবারও মাটি কাটাকাটি শুরু করেন। সেখানে টাকার সাথে পুরান বউকে ভরে রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেন। এভাবে লোভী বউকে শাস্তি দেন মাসুদ। ছবিটাও শেষমেশ শেষ হবার একটা সুযোগ পায়। আমরা বুঝতে পারি প্রেমকাতর মাসুদ, অর্থলোভী বউয়ের অত্যাচারে পাষণ্ড হয়ে পড়েছেন।
এই ছবিতে কী কী বিষয়বস্তু এসে বা ঢুকে পড়েছিল তার একটা শিথিল তালিকা হতে পারে: প্রেমপিরিতি, বিয়া, কাতর-নরম বিবাহিত প্রেমিক, অর্থলোভী বউ, দাম্পত্যের জ্বালা, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা গৃহস্থালি সহিংসতা, শ্রম-অভিবাসন বা লেবার মাইগ্রেশন, স্ত্রীজাতির পরকীয়া, পুরুষের লাম্পট্য, অভিবাসী শ্রমিকের শোষণ-বঞ্চনা, ব্যাংক ডাকাতি, রিরংসা, জিঘাংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা ইত্যাদি। ডেভেলপমেন্ট, পরিবেশ, ক্লাইমেট এগুলোও এসেছিল কিনা এখন আর মনে পড়ছে না। সব ইস্যুই কোনো না কোনো ভাবে আধা-জ্বাল-দেয়া, আধা-সিদ্ধ, এমনকি একটুও জ্বাল না দেয়া কাঁচা আলু ঝোলে ছেড়ে দেবার মতো সরবরাহ করা হয়েছে। এমনকি মাসুদের বন্ধু জহির যে মাসুদের বড় বন্ধু, বউকে জিম্মায় রেখে আসার মতো বন্ধু, সেটাও ছবিগল্পে বুঝবার জন্য ৩০টা সেকেন্ডে কিছু প্রতিষ্ঠিত করার দায় নেন না পরিচালক। অবশ্য জমির দালাল জহির, সম্ভবত, জমির দালালি নাই এমন কোনো অবসরের দিনে, ল্যাম্পপোস্টের মই ধরে থেকেছিলেন বলে মনে পড়ে, যেটা স্বাভাবিক দুনিয়ায় বিদ্যুৎকর্মীর বন্ধুর না ধরে ‘সহকারীর’ ধরার কথা। আর সেই মই-আরোহন কালেই মাসুদের দৃষ্টিনিপতন ঘটে হবুবউয়ের পানে, যাকে প্রেম বলা হয়ে থাকে; এবং মাসুদের মই থেকে পতন ঘটে। যাকগে, বুঝে নেয়া যায় যে ওঁরা ভাল বন্ধু। সব ইস্যুই এই ছবিটাতে বুঝে নিতে হয়।
আন্দাজ করা যায় এই ছবির প্রযোজক প্রতিটা নিয়োগের ব্যাপারে অত্যন্ত উশুল করে নেবার পক্ষপাতী ছিলেন। সেটা ঘটে থাকলে সঙ্গীত/শব্দ পরিচালকের/-বৃন্দের উপর দিয়ে অত্যাচার গেছে। সেই অত্যাচার তাঁরা (সাইবারে খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম এই গুরুদায়িত্ব তিনজন মিলে নিয়েছেন; অথবা হয়তো তিনজন থাকাতেই দর্শকদের কিছু বেশি শব্দ কনস্যুম করতে হয়েছে) পুষিয়ে নিয়েছেন দর্শকশ্রোতাদের বকরি বানিয়ে। লাগাতার কিছু না কিছু বাদ্য বাজাতে থেকেছেন তাঁরা পুরো ছবি জুড়ে – অধিকাংশ যার নিরর্থক, কখনো কখনো ভুলার্থক, অল্প কিছু সময় বিটিভিমূলক শিশুতোষ। এর বাইরে তাঁরা পাশ্চাত্যীয় ক্রাইম-থ্রিলারের হেভি-সাউন্ড ব্যবহার করেছেন যেখানে, কিছুটা অন্তত স্বস্তি নিতে পারবেন তখন দর্শকে। এবং অবশ্যই যে কয়েক সেকেন্ড এঁরা পর্দাকে বাদ্যবাজনামুক্ত রেখেছেন সেটা সুবর্ণ-নৈঃশব্দ্য হিসাবে দর্শকের ভাল লাগবে। ‘আইটেম সং’টা কেটে সেইভ করে রেখে দিলে মোটের উপর যেকোনো ছবিতেই বসানো যাবে। এই ছবিতেই বরং স্থান-কাল-পাত্র বিবর্জিত আরো একটা কাঁচা আলু ছিল মাত্র।
প্রটাগনিস্ট আফরান নিশোর অভিনয় না থাকলে যে কী হতো! কিন্তু লাগাতার দক্ষ অভিনয়ের জন্য গল্পরেখার সামঞ্জস্য বা ‘রিয়েলিটি-ঘনিষ্ঠতা’ বা শক্ত যুক্তিপ্রবাহ দরকার পড়ে। সেটা নিশো যথেষ্ট পেয়েছেন তা তিনি নিজে দাবি করলে ঠিক আছে; দর্শক হিসাবে যে সেই দাবি করব ততটা শিথিল মন নাই আমার এক্ষণে। শহিদুজ্জামান সেলিম ব্যাংক ডাকাতির পর গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসাবে ঢোকেন। পুরা ‘শো-স্টিলার’। চাঁটগাই একটা ভাষাতে ননচ্যালান্ট উৎসুক, ক্রিমিনালের দক্ষতায় মুগ্ধ এবং শুকনামুখে ছোট কথায় রসিকতা করতে থাকা এক চরিত্রে অনবদ্য। বস্তুত, তিনি হাজির হবার পরই মনে হয় ছবিতে কিছু জায়গায় সংলাপ সুলিখিত হয়েছে। ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড চরিত্রের ছোট্ট উপস্থিতি উজ্জ্বল। বিশ্বাসঘাতক বন্ধু, মাসুদের বউয়ের পরকীয়া-সাথি জহির চরিত্রে মোস্তফা মনোয়ার খারাপ করেননি। কিন্তু তিনি দুর্দান্ত সব কাজ এর আগে করেছেন। এই স্ক্রিপ্টে কিছু একটা ভেজাল হয়েছে যে তাঁকেও তাঁর তুলনায় মলিন লেগেছে। কিন্তু আরেক বিচারে এই ছবির প্রটাগনিস্ট আসলে ময়না। এই চরিত্রের রূপকার তমা মির্জাকে আমার উল্লেখযোগ্যরকম অনাকর্ষণীয় লেগেছে। আমি তাঁর কাজ ভালমতো লক্ষ্য করি ‘ক্যাফে ডিজায়ার’-এ। তিনি তীক্ষ্ণ অভিনয় করেছেন সেখানে। ‘সুড়ঙ্গ’-তে ময়নার চঞ্চলমতি, অর্থলোভী ও আরাম-আয়েশ ও সংসর্গপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে গিয়ে তিনি একটা বিদঘুটে রকমের হাইপিচ-মনোটোনাস অভিনয় শৈলী বেছে নিয়েছেন। একেই তো গল্পরেখাতে আধাছেঁড়া সুতা, তার মধ্যে এই অভিনয়রীতিতে এত্ত বড় একটা চরিত্র সারাটা ছবি জুড়ে থেকেও নিতান্ত অগোচরে থেকে যান। তাঁর এই অভিনয়রীতিটার জন্য আমার কৌতূহলটা থেকেই যাবে। হতে পারে তিনি বড়জোর পরিচালকের নির্দেশ পালন করেছেন। কিন্তু কেন?
যদি ক্রাইম-থ্রিলার বা ড্রামা দেখবেন বলে হলে যান, তাহলে আরাম করে চা-নাস্তা খেয়ে ইন্টারভ্যালের পরে গেলেও পারবেন। একটা আধা বা সিকি ক্রাইম-থ্রিলার দেখে এসেছেন এই মর্মে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারবেন।