Select Page

সোহেল রানা, আমাদের ড্যাশিং হিরো

সোহেল রানা, আমাদের ড্যাশিং হিরো

১৯৭৪ সাল,কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ‘মাসুদ রানা’ আসছে চলচ্চিত্রের পর্দায়। পরিচালক হচ্ছেন মাসুদ পারভেজ, তিনিই প্রযোজক। যিনি এর আগে ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের খাতায়। মাসুদ রানা নির্বাচনের জন্য সুমিতা দেবীসহ অনেকেই ছিলেন নির্বাচকের ভূমিকায়,কিন্তু কাউকেই মন মতো পাওয়া গেল না।

অবশেষে উনারা সিদ্ধান্ত নিলেন পরিচালক মাসুদ পারভেজই হবেন নায়ক মাসুদ রানা। প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও পরে রাজি হয়ে যান, নাম লিখান নায়কের খাতায়। তবে মাসুদ পারভেজ নয়, তিনি নায়ক রূপে আবির্ভূত হন অন্য নামে, যেই নামে তিনি সারা বাংলায় খ্যাত, তিনি চলচ্চিত্রের অঙ্গনের একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ‘সোহেল রানা’।

মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে সিনেমার উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব স্মরণ করে। নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন চাষী নজরুল ইসলামকে। ১৯৭২ সালে মুক্তির পর এই সিনেমা সব দিক দিয়েই ইতিহাস রচনা করেছিল। এর দুই বছর পর মাসুদ রানা দিয়ে পরিচালক ও নায়ক রুপে অভিষিক্ত হন। স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেনের চিত্রনাট্যে গোঁফযুক্ত মাসুদ রানাকে তখনকার দর্শকরা বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন, এই ছবিতে প্রথম অতিথি শিল্পী হিসেবে হাজির হন নায়ক রাজ রাজ্জাক।

‘ভালোবাসার মূল্য কত, আমি কিছু জানি না’ আজাদ রহমানের কন্ঠে ‘এপার-ওপার’ সিনেমার এই গান পেয়েছে কালজয়ীর মর্যাদা। গোয়েন্দা চরিত্রের পর রোমান্টিক চরিত্রে এই ছবিতে আবির্ভূত হন, এটিও বেশ জনপ্রিয় সিনেমা। বাংলা চলচ্চিত্রে ‘গোঁফ’ যদি কারো জন্য যদি বিশেষ হয়ে থাকে তবে তা সোহেল রানার জন্যই। ‘দস্যু বনহুর’ এর মত রোমাঞ্চধর্মী সিনেমাও করেছেন।

জনপ্রিয়তার দরুন নিজের পরিচালনার বাইরেও একের পর এক ছবিতে অভিনয় করতে থাকেন। তেমনি এ জে মিন্টুর প্রথম ছবি ‘মিন্টু আমার নাম’, এই সফল ছবিতে তিনিই ছিলেন নাম ভূমিকায়। হিন্দি শোলের অনুকরণে নির্মিত দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ এ অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রটি করেছিলেন, এটিও বেশ জনপ্রিয় সিনেমা। এছাড়া গডফাদার অনুকরণে বারুদ, সেলিম জাভেদ, ওস্তাদ সাগরেদ, জনি, শরীফ বদমাশ সহ বেশ কয়েকটি অ্যাকশন ধারার ছবিতে অভিনয় করেছেন। ততদিনে তিনি খেতাব পেয়ে গেছেন ‘ড্যাশিং হিরো’র খেতাব।

‘বন্ধু আমরা তিনজন, সুমন রাজন মোহন’ বন্ধুত্ব নিয়ে দিলীপ বিশ্বাসের ক্ল্যাসিক ছবি ‘জিঞ্জির’ র ছিলেন তিনবন্ধুর একজন, এই ছবিতে আরো অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক ও আলমগীর। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া ক্যারিয়ারের আরেক উল্লেখযোগ্য ছবি ‘জীবন নৌকা’, সম্ভবত সেরা অভিনয় এই সিনেমাতেই, পরিচালক তিনিই। ‘তুমি যেখানে আমি যেখানে’ নিজের পরিচালিত ‘নাগ পূর্ণিমা’র অত্যন্ত জনপ্রিয় গান এটি, এই গানে তিনি ববিতার বিপরীতে রোমান্স করেছিলেন।

১৯৮৬ সালে প্রযোজক হিসেবে অভিনব আয়োজন করেছিলেন। মার্শাল আর্টকে এনেছিলেন সিনেমার পর্দায়, নায়ক হিসেবে অভিষেক করান নিজের ভাই রুবেলকে। সিনেমার নায়ক রুবেল,মসুপারহিট এই ছবিতে পরিচালক হিসেবে নবজন্ম হয় শহিদুল ইসলাম খোকনের যার প্রথম ছবি ‘রক্তের বন্দী’ ছিল ফ্লপ। রুবেলের জনপ্রিয়তার পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব উনার। দুই ভাই মিলে অভিনয় করেন বীর পুরুষ, মাকড়শা, ঘরের শত্রু, চোখের পানি, বিশ্বপ্রেমিক, দুঃসাহস, আজকের হিটলারসহ অনেক ছবিতে। রুবেলের প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘বাঘের থাবা’ তিনিই পরিচালনা করেছিলেন।

শিষ্য শহিদুল ইসলাম খোকন তাকে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান থেকে অনুপ্রানিত চরিত্রের ছবি ‘কমান্ডার’। নিজের নামেই একটি ছবি করেছিলেন নাম ছিল সোহেল রানা, ‘দাতা হাতেমতাই’ও করেছিলেন। মূলত নব্বই দশকের শুরুর থেকেই অভিনয় কমিয়ে দেন, পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতেন। ক্যারিয়ারে আরো উল্লেখযোগ্য ছবি হাঙ্গর নদী গ্রেনেড ও টাকা। অনেকদিন পর অভিনয় করেন সহশিল্পী কবরীর পরিচালিত সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’ তে।

দক্ষ অভিনেতা হয়ে অনেক ভালো ভালো সিনেমায় অভিনয় করলেও জাতীয় পুরস্কারের স্বীকৃতি মিলেনি, অবশেষে ১৯৯৬ সালে সাধারন মানের ছবি ‘অজান্তে’ দিয়ে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান, দ্বিতীয়বার পার্শ্ব চরিত্রে পান ‘সাহসী মানুষ চাই’ সিনেমার সুবাদে, সর্বশেষ পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।

নায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক সব মাধ্যমেই যারা দ্যূতি ছড়িয়েছেন তিনি তাদের মধ্যে অগ্রতম, গুনাহগার, ঘেরাও আরো দুইটি অন্যতম পরিচালিত ছবি, প্রযোজনা তো করেছেন অনেক ছবি। তবে ‘খাইছে তোরে’ নামক ছবি বানিয়ে দর্শকদের হতাশ করেন, যদিও ছবি হিট। সর্বশেষ বানিয়েছেন ভালোবাসার মূল্য কত ও রিটার্ন টিকেট। তবে শেষের দিকে প্রযোজিত,পরিচালিত ছবিগুলোর প্রতি আরো সচেতন হতে পারতেন। ছেলে মাশরুর পারভেজও এসেছেন চলচ্চিত্রে, অদৃশ্য শত্রু ও গোয়িং হোম বানিয়েছেন।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র ও নাটক বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন