হাত-চোখবাঁধা অবস্থায় প্রায় একঘণ্টা গাড়িতে, যা দেখেন পরিচালক আজিজ মেহের
সাংবাদিক, পরিচালক, লেখক-প্রকাশক অনেক পরিচয় আজিজ মেহেরের। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন নকশাল নেতা ও পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল, দেবেন শিকদার)-এর সাধারণ সম্পাদক।
আজিজ মেহের ১৯৩২ সালের ১৪ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমানের কালনায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জ। তার বাবা মিজানুর রহমান ছিলেন পুলিশ অফিসার। বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুখলেছুর রহমান, আরেক বড় ভাই খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক ইবনে মিজান। বড় বোন অধ্যাপিকা মুসলেমা খাতুন, ছোট বোন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক অধ্যাপিকা মকবুলা মঞ্জুর।
২০১৭ সালের ১০ আগস্ট ঢাকায় ৮৫ বছর বয়সে মারা যান আজিজ মেহের। জানা যায়, পরিবারের দেয়া নাম ছিল এস এম মসিউর রহমান। ডাক নাম টুঙ্কু। রাজনৈতিক কারণে ছদ্মনাম নিয়েছিলেন আজিজ মেহের। চলচ্চিত্রে এসেও এই নামই বহাল থাকে। কালক্রমে তার আসল নামটিই হারিয়ে যায়। তার সর্বত্র পরিচিতি ছিল আজিজ মেহের নামেই।
সম্প্রতি মেয়ে তানিয়া হাসানের সূত্র ধরে আজিজ মেহের জীবনের কিছু কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে গেল। সেখানে বলা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর গুমের শিকার হয়েছিলেন এ চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
গত ১৪ আগস্ট ফেসবুকে ‘আয়না ঘর, আজিজ মেহের, এবং অনিন্দ্য বিজয়’ নামে স্মৃতিচারণমূলক লেখা পোস্ট করেন।
তিনি লেখেন, “১০ আগস্ট আমাদের বাবার সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল, কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল না। চোখের জলে ঝাপসা দৃষ্টি, মনে পড়ছিল সেই কালরাত্রির কথা, ১৯৭৫ সন জানুয়ারি মাস, কনকনে শীতের সন্ধ্যা মোহাম্মদপুর কাজী নজরুল ইসলাম রোডের ১২ নং বাড়ির বাইরে ঘরে বসে নতুন ক্লাসের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছি। দরজায় কে যেন ঠুকঠুক করে আওয়াজ করলো, ও এলাকায় আমরা সবাই সবাইকে চিনি, এমন কী বিহারীদের সঙ্গেও আমাদের সবার খুব ভালো সম্পর্ক তাই কোনো রকম চিন্তা না করেই দরজা খুলে দিলাম। দরজায় দাঁড়ান সাদা চাদরে মোড়ান পেটান শরীরের লম্বা মানুষটিকে আধো অন্ধকারেও সহজেই চিনতে পারলাম- মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইব্রাহীম সার্জেন্ট। আমাদের স্কুলে যাতায়াত করার পথে তার সঙ্গে প্রায় দেখা হতো, সে সময়ে রাস্তায় বখাটে ছেলেরা খুব উত্যক্ত করতো আমাদের, তাই তিনি টহল দিতেন। পাড়ার টুটুল নামের একটি ছেলে সাহস করে ওনাকে দূর থেকে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘স্যার উনি আমাদের পাড়ার সবচেয়ে লক্ষ্মী একটা আপু, ইভটিজারের যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পান। আমরা তো ছোট তাই কিছু করতে পারি না, আপনি একটু আপুটাকে দেখে রাখবেন।’
পরদিনই স্কুলে যাওয়ার পথে ইব্রাহীম সার্জেনের মোটর সাইকেল আমার পথ রোধ করে দাড়ায়, তিনি নিজের ব্যাজের দিকে আংগুল তুলে বললেন, ‘খুকি, আমি ইব্রাহীম সার্জেন্ট কেউ বিরক্ত করলে আমাকে জানাবে, মেরে চামড়া তুলে দেবো।’ সেদিন থেকে আর কোনো বদ পোলাপান আমার দিকে মুখ তুলে চায়নি, এতটাই নিরাপদে ছিলাম। আজ দরজার সামনে তাকে সাদা চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা অবস্থা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম, সালাম দেবার কথা মনেও পড়লো না। উনি বুঝতে পেরে, গলাটা একটু কেশে হাসার চেষ্টা করলেন বললেন, ‘খুকি ভালো আছো?’ আমার মাথা তখন কাজ করছিল না, এতরাতে উনি আমাদের দরজায়, তাও সাদা চাদরে পুলিশের পোশাক ঢাকা দেয়া, হাত দুটোও চাদরের তলায় সম্ভবত পিস্তল হাতে। উনি আবার গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘বাবা বাড়ি আছেন? ওনাকে বলো আমি দেখা করতে এসেছি।’
বাবা তখন নিত্যরাতের মতো শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন, তাকে গিয়ে খবরটা দিলাম। উনি বিছানা থেকে উঠে প্রথমে ঘরের পিছনের জানালার পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, ‘ওনাকে গিয়ে বলো, আমি কাপড়টা বদলে আসছি।’ পুলিশরা বন্দুক তাক করে বাড়ির পিছন দিকটা ঘিরে রেখেছিল যেন বাবা সেদিক দিয়ে পালিয়ে না যান। উনি বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। বাবা কাপড় বদলাচ্ছেন খবরটা সার্জেন্ট সাহেবকে দিতেই তিনি মাথা নাড়লেন।
আমি আবার একছুটে ভিতরে গিয়ে দেখি মায়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পরছে বাবা বলছেন, ‘মধু ভয় পেওনা আমি ফিরে আসবো, মন শক্ত করো।’ সৌভাগ্যক্রমে সে সময় আমাদের বড় ভাই প্রয়াত মানব বাড়িতে ছিলনা, তাহলে সেও রক্ষা পেতনা। ইব্রাহীম সার্জেন্ট আমাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলে, বাবা নিয়ে পুলিশের জীপ করে হুশ করে চলে গেলেন।
এরপরের পাঁচটা দিন যে আমাদের কীভাবে গেলো তা সেটা শুধু তারাই অনুভব করবেন, যাদের স্বামী-সন্তানরা এভাবে হাওয়া হয়ে গেছেন। পাঁচদিন পর কোনো এক থানার জমাদারের হাতে সিগারেটের প্যাকেটের উল্টা দিকে লেখা একটা চিরকুট পেলেন মা, ওতে লেখা ছিল, ‘এখনো বেঁচে আছি তবে আর কতদিন থাকবো তা জানিনা। অন্য কায়েদীদের কাছে শুনেছি এখান ঢোকার এবং বাইরে যাবার পথ কোনটা, কেউ জানে না। যদি পারো জনাব মনসুর আলী সাহেবের (সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সিরাজগঞ্জের মানুষ) সঙ্গে দেখা করো, যেন লাশটা অন্তত পাও। সম্ভব হলে পত্রবাহকে একশত টাকা দিও, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ও গেছে। তোমাদের সবার জন্য শুভেচ্ছা রইলো।’ নিচে কোনো স্বাক্ষর ছিল না, তার প্রয়োজনও ছিল না, ওনার অতি পরিচিত প্যাঁচান হাতে লেখাই যথেষ্ট।
পাঁচটা মাস আমার মা রাতদিন এক করে দিয়ে মানুষের দোরে দোরে ঘুরেছেন, শেষ পর্যন্ত মনসুর আলী সাহেবের নাগাল পেয়েছিলেন। মনসুর আলী সাহেব আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা হলেও খুব ভালো করে আমাদের বাবাকে চিনতেন, জানতেন সেই ছাত্র বয়স থেকে পাকিস্তানের কবল থেকে পূর্ববাংলাকে মুক্ত করার জন্য প্রাণপণ লড়ই করেছেন, জীবনের বেশিরভাগ সময় চোর-পুলিশ খেলার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বামরাজনীতি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে ধরা পড়ে জেলখানায় অকথ্য নির্যাতনে শিকার হয়েছেন। আমার মা তার পালক পুত্রকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধা দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার অপরাধে জেল খেটেছেন। কপাল ভালো ছিল মায়ের, কারণ তিনি সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত শিরাজী বাড়ি ‘বানীকুঞ্জে’র মেয়ে ছিলেন, তাই আর্মীরা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাক আর্মি বা রাজাকাররা মাঝে মাঝে আমাদের গ্রামে হানা দিয়েছে, তেমন কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু স্বাধীনতার একমাস পরে আমাদের মুগবেলাইয়ের গ্রামের বাড়িটা তথাকথিত কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভেঙে তছনছ করে দেয়, লুট করে নিয়ে যায় যতটুকু পারে বাকি জিনিস উঠানে স্তুপ করে আগুন লাগিয়ে দেয়, নিতান্তই করুণা করে সম্পূর্ণ বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়নি। এরাই বেলাই এবং আশপাশের গ্রামের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে খুন করে ফুলজোড় নদীতে ভাসিয়ে দেয়, কারণ সেই সকল মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল না।
১৯৭৫ সাল, সে সময়ে আওয়ামী লীগের দুঃশ্বাসন একেবারে চরমসীমা অতিক্রম করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীও খুব হতাশ আর ক্ষুদ্ধ ছিলেন তার দলের প্রতি, তিনিও ভাবেননি স্বাধীনতার পরও আমার বাবাকে আবার এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। আল্লাহ্র অসীম কৃপায় এবং জনাব মনসুর আলীর বদন্যতায় আমরা বাবাকে ফিরে পাই। তবে বাবার দেয়া আয়না ঘরের বিভীষিকাময় বর্ণনা বহুবছর আমাকে ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
বাবা যখন আয়না ঘরে বন্দি, শেখ মুজিবর রহমান তখন রাজশাহীতে তার সৃষ্ট রক্ষী বাহিনীর সমাবেশে হুকুম দিয়েছিলেন, ‘নকশাল দেখামাত্র বিনা বিচারে গুলি করবা।’ সেই বছরই ১৫ আগস্ট শুধুমাত্র দুটি বিষবৃক্ষ রেখে স্বপরিবার নিঃচিহ্ন হয় শেখ পরিবার। এবার ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তার যোগ্য উত্তরসুরী কন্যা হাসিনা যখন একই আদেশ দিল, ‘আন্দোলনকারীদের দেখা মাত্র গুলি করার’— তখনই মনে মনে বলেছিলাম, ‘পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে, পতন অনিবার্য!’”
এরপর ১৭ আগস্ট ‘আয়না ঘর, আজিজ মেহের এবং অতঃপর’ শিরোনামের আরেক পোস্টে তানিয়া হাসান লেখাটি পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
পেশায় কাউন্সেলিং সাইকজলিস্ট ও লেখক তানিয়া হাসান লেখেন, “আমাদের বাবা আজিজ মেহের স্কুলে পড়ার বয়স থেকে মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় সিরাজগঞ্জের ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ছিলেন ভাষা আন্দোলনের আহ্বায়ক এবং আমাদের বাবা ছিলেন যুগ্ম-আহ্বায়ক। এভাবেই তিনি সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সে সময় তো মিডিয়ার যুগ ছিল না, এমনকী টিভি দেখা তো দূরের কথা এই শব্দের সঙ্গেও মানুষের পরিচিতি ছিল না— হাতে লেখা পোস্টার, রাজপথে মিটিং-মিছিল, শ্লোগান এবং বিশেষ করে আমার বাবার লেখা পথনাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে জনসচেতনতা, প্রচার এবং প্রসার গড়ে তোলা হতো, সিরাজগঞ্জের সবখানে। তার লেখা একটি পথনাটক ‘জ্বলছে আগুন খেতখামারে’ প্রচুর জনপ্রিয়তা পায় সেসময়।
১৬ ডিসেম্বর যখন দেশ প্রথমবার স্বাধীন হলো, সেদিনই ঢাকার লালবাগের কেন্দ্রীয় কারাগার খুলে দেয়া হয়— অন্য সব চোর ডাকাত, খুনি আসামিদের সঙ্গে বাবাও মুক্তি পান। কবে তাকে শেষ দেখেছিলাম মনে পড়ে না, আমরা তখন সিরাজগঞ্জে নানার বাড়িতে আশ্রিত, ১৭ ডিসেম্বর তিনি সেখানে পৌঁছান। প্রথম দেখায় বাড়ির বড়রাই চিনতে পারেনি আমাদের অতি সুদর্শন বাবাকে—একমুখ লম্বা দাঁড়ি আর এলোমেলো চুল, লম্বা ঢেঙ্গা মানুষটি কুঁজো হয়ে গেছেন, শীর্ণদীর্ণ শরীর খোশপাঁচড়ায় ভরা, শরীরের যত্রতত্র কালশিটে আঘাতের চিহ্ন, ঠোঁটের চারপাশে কালো পোড়া দাগ, খুকখুক করে কাশছেন, যক্ষ্মার রোগী— সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকু নেই বাড়ির বাইরের দরজায় ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফাছিলেন। আমরা ভাইবোনেরা অবাক হয়ে এক অচেনা বাবাকে দেখিলাম,পরিচয় না দিলে বোঝার উপায় ছিল না তিনি কে।
এরপর শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন, আমার বাবা তখন সম্পূর্ণ সহায় সম্বলহীন, আশ্রয়হীন, কর্মহীন, একমাত্র ভরসা আমাদের মায়ের প্রাইমারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের চাকরি। স্বাধীনতার আগেও যে অবস্থা খুব সুবিধার ছিল তাও না, তখনো বলতে গেলে সংসারের হাল মায়ের হাতেই ছিল। আর এখন স্বাধীনতার পর ঢাকায় আমাদের থাকার স্থানটুকুও ছিল না। আমাদের মেঝ চাচা চিত্র পরিচালক ইবনে মিজানের শ্বশুরবাড়ির একটা অংশে একবছর ছিলাম আমরা।
তারপর আমার মায়ের চাকরির সুবাদে মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম রোডের বিহারীদের একটি পরিত্যক্ত দোতালা বাড়ির নিচের তলার একটি অংশে থাকার সৌভাগ্য হয় আমাদের। তবে সেটাকে বাড়ি না বলে লঙ্গরখানা বললেই সঠিক হয়, সারা বছর সেখানে বামদলের লোকজনদের আনাগোনা, কেউ কেউ বছরের পর বছর পর থেকেছে। আয়নাঘর থেকে ফিরে আসার পর বাবা বলেছিলেন, পেছনে হাতমোড়া, চোখবাঁধা অবস্থায় প্রায় একঘণ্টা গাড়ি চলার পর থামে, সেই অবস্থায় তাকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। কী ঘটতে যাচ্ছে, কোথায় তাঁকে রাখা হয়েছে, আশপাশের সেলগুলোতে কারা আছেন বোঝার কোনো উপায় ছিল না, আলো-বাতাসহীন ছোট্ট একটি কুঠুরি কোনো রকমে একজন মানুষ গুটিসুটি মেরে থাকতে পারে, সেখানেই জল খাওয়ার এবং ত্যাগ করার ব্যবস্থা। পাশের কুঠুরিতে একজন কয়েদী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি মাঝে মাঝে জোরে কাতরে উঠতেন— তার গলার আওয়াজে চিনতে পেরেছিলেন— তিনি ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, পরে জানতে পারেন তাদের দলের মাথাদের ওখানে আটক করে রাখা হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর বাবা চিনতে পেরেছিলেন সেটা ছিল গ্রিনরোডের ডিবি অফিস, তিনি যেন বুঝতে না পারেন কোথায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে সেজন্য একঘণ্টা অকারণে গাড়ি সারা শহর ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল।
বিখ্যাত সব গুণীজন এবং বাম রাজনৈতিক কর্মীরাও হরহামেশা আসা-যাওয়া করতেন, নজরুল ইসলাম রোডের বাড়িতে, বাবারা দরজা বন্ধ করে মিটিং করতেন। এমনকি আজকের শাহরিয়ার কবির (ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক এবং সেই খুশিতে এখন নিজেই দালাল হয়ে গেছেন স্বৈরাচারের, হি হি) তখন ২৬-২৭ বছরের, তিনি সক্রিয়ভাবে বামরাজনীতির ধারকবাহক ছিলেন, জ্বালাময়ী কবিতা লিখতেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে— নিয়মিত আসতেন আমার বাবার কাছে।
আমি নিতান্ত কিশোরী হলেও সেই বয়সে একটি বিষয় খুব ভালো বুঝেছিলাম, উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জনসংযোগ এবং অঢেল অর্থ ছাড়া অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো আমাদের দেশে অন্তত খুব কঠিন ছিল সেময়, বামপন্থীদের শ্লোগান ‘লাঙল যার জমি তার’ তাই আজও বাস্তবায়িত হয়নি। খালি পেট আর খালি হাতে যেখানে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন সেখানে ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব।
একটা স্বাধীনদেশের শাসক যখন স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়, তখন অবধারিতভাবেই সমস্ত বিরোধী দলকে নিষ্ক্রিয় এবং নিশ্চিহ্ন করে দেয়াটা তাদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়— এভাবেই নির্বিচারে হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের খেলায় মেতে ওঠেন তারা। সেই সাথে যুক্ত হয় অসাধু ক্ষমতালোভী বহুমানুষ, স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ পূর্ণ করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে— অসংখ্য নিরীহ মানুষকে খুন, রাহাজানি, ভূমি দখল, মেয়েদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে- বাম-রাজনীতির অনুসারীদের সমূলে উচ্ছেদে তাদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বর্বরোচিত।”
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ জে কারদারের ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’ ছবির ব্যবস্থাপনা সহকারী হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্রে আসেন আজিজ মেহের ‘এই তো জীবন’ ছবির প্রযোজনা ব্যবস্থাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। কাজ করেছেন চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সাথেও।
আজিজ মেহেরের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘আওর গম নেহী’ (যৌথভাবে ইবনে মিজানের সাথে), তবে ছবিটি মুক্তি পায়নি। আবারো বড় ভাই ইবনে মিজানের সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করেন ‘একালের রূপকথা’ ছবিটি, মুক্তিপায় ১৯৬৫ সালে। তিনি এককভাবে পরিচালনা করেন ‘বিচার’ ও ‘আকাশ পরী’।
চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি তিনি অভিনয় করেছেন, কাহিনী ও সংলাপ লিখেছেন। আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, রূপালী সৈকতে, পরিণীতা’সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন আজিজ মেহের। কাহিনী ও সংলাপ লিখেছেন, ‘জংলী মেয়ে’ ও ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’ ছবির।
লেখক আজিজ মেহেরের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে- স্মৃতি শুধু স্মৃতি নয়, নিষিদ্ধ কথকথা, আনন্দের ডায়েরী, ইনোনি শকুন্তলার ভালোবাসা, প্রভৃতি। ‘বস্তু প্রকাশন’ নামে তার নিজের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল।