Select Page

হানিফ সংকেত একজনই

হানিফ সংকেত একজনই

‘এই মিলনায়তন ও এই মিলনায়তনের বাইরে যে যেখানে বসে এই অনুষ্ঠান দেখছেন আপনাদের সবাইকে জানাই সাদর সম্ভাষণ’ চিরচেনা এই ‘introducing speech’ মানেই হানিফ সংকেত। বহুল জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের আপামর জনগণের কাছে পৌঁছে গেছেন। আমরা কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হয়ে গেলেও ‘ইত্যাদি’ আছে আগের মতোই, আছেন হানিফ সংকেত।

তার জন্ম বরিশালে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে। মূলনাম এ.কে.এম. হানিফ। হানিফ সংকেত নামটাই একটা প্রতিষ্ঠান। এক জীবনে যা করেছেন ও করে যাচ্ছেন তার কোনো তুলনা হয় না।

লিজেন্ড ফজলে লোহানী-র ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা যায় তাঁকে। ফজলে লোহানী-ই তাঁর উপস্থাপনার গুরু। পরবর্তী সফল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও সফল উপস্থাপক হিশাবে ‘ইত্যাদি’-তে আগমন ঘটে হানিফ সংকেত-এর। তাঁর উপস্থাপনা অনবদ্য। ‘ইত্যাদি’ শুধু বিনোদনে নয় মানবিক বিষয় উপস্থাপন, সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরা, মানুষের কল্যাণে অবদান রাখা, প্রতিভা অন্বেষণ ও প্রতিষ্ঠিত করা এসবের জন্য একটি আদর্শ অনুষ্ঠান। নব্বই দশকীয় প্রজন্মের কাছে এ অনুষ্ঠান কোন লেভেলের জনপ্রিয়তায় ছিল সেটা নতুন করে বলবার কোনো দরকার নেই।

‘ইত্যাদি’-র বিদেশি ছবির বাংলা ডাবিং যে তিনিই করতেন হয়তো অনেকে জানেও না। সেটা শুনতে শুনতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। বাংলা ফানি ডাবিংগুলো তাঁর নিজেরই করা। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক কৌতুক, স্যাটায়ার (যেমন কাশেম টিভি রিপোর্ট), মেসেজ তো আছেই। নানা-নাতির জনপ্রিয় পর্ব কিংবা নানী-নাতির পর্ব দিয়ে আলাদা ক্রেজও তৈরিরি করেছেন ‘ইত্যাদি’-তে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে দর্শকদের পরিচিতি দিতেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তারকাদের সাক্ষাৎকার নিতেন যেমন- শাহরুখ খান (২০০৪)। বিদেশি পর্যটকদের বাংলা ভাষায় পারফর্ম করাতেন।

তাঁর মতো স্টাইল করে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে তাঁকে নকল করতে গিয়ে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছিল অন্যান্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে। তিনি একমাত্র উপস্থাপক যিনি কোনো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে দর্শকদের গাছ উপহার দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় গাছ হলো ‘পরিবেশবন্ধু।’ তিনিই একমাত্র উপস্থাপক যিনি ‘ইত্যাদি’-র পাশাপাশি ‘মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে দর্শক চাহিদায় সেরা উপস্থাপক। উপস্থাপনা যে একটা শিল্প তিনি প্রমাণ করেছেন। দেশে প্রথম ভেজালবিরোধী আন্দোলন ‘ইত্যাদি’-র মাধ্যমে শুরু হয় এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাহসী কোনো অনুষ্ঠান (যেমন ক্রাইম প্রোগ্রাম) এগুলোর আইডিয়া বা অনুপ্রেরণা ‘ইত্যাদি।’ বিবিসি-র জরিপেও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছে ‘ইত্যাদি।’

টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের প্রযোজনাশিল্পে তিনি অন্যতম সেরা পথ প্রদর্শক। তাঁর প্রযোজনায় অন্যান্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যেমন ‘ঝলক, ঈদ আনন্দমেলা, কথার কথা’ এগুলো প্রচার হত।

হানিফ সংকেত একজন নাট্যকারও। বিটিভিতে রোজার ঈদে ‘ইত্যাদি’ আর কোরবানীর ঈদে তাঁর লেখা নাটক প্রচার হত নিয়মিত। বিটিভি থেকে একসময় এটিএন বাংলাতে তাঁর নাটক প্রচার শুরু হয়। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য নাটক – ঘরের খবর পরের খবর, দুর্ঘট, সুসময়ে সকলেই, তোষামোদ খোশ আমোদ, কিংকর্তব্য, শোধবোধ, ভূত অদ্ভুত, ধন্যবাদের অন্যবাদ, পুত্রদায়, বিপরীতে হিত, কুসুম কুসুম ভালোবাসা, তথাবৃত যথাকার, আয় ফিরে তোর বারান্দায়, ফিরে আসে ফিরে আসা, সন্দেহে মনদাহ, ভুলে ভেসে কূলে আসা, শেষ অশেষের গল্প, বিশ্বাসের নিঃশ্বাস ইত্যাদি। তাঁর নাটকের নাম ছিল ক্রিয়েটিভ। নাটকগুলো হত শিক্ষণীয়।

নাটক লেখার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন। ‘কুসুম’ নাটকের হানিফ সংকেত-কে অনেকেরই মনে থাকবার কথা। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ছিল।

চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন এমনকি গানও গেয়েছেন। ১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আগমন’ ছবিতে প্রথমবার অভিনয় করেন খলনায়কের ভূমিকায়।কমন ডায়লগ ছিল-‘ঘটনা যেন প্যাঁচ না খায়।’ ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ ছবির হোমরা চোমরা গড়নের হানিফ সংকেত বাপ্পারাজের গ্রাম্য শত্রু হয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিল। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল ঘোটন ঘোষ। বাপ্পারাজের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং ষড়ডন্ত্র করাই তাঁর কাজ ছিল। ‘ঢাকা-৮৬’ ছবিতেও বাপ্পারাজের বন্ধু সহপাঠী চরিত্রে ‘পাগল হতে আর দেরি নাই’ শিরোনামের একটা গানে তাঁকে দেখা যায়। কণ্ঠশিল্পী হন এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রথম প্রেম’ ছবিতে ‘মর্জিনা’ গানে। গানটি ছিল এমন – ‘তু তু তু তু তু তা রা মর্জিনার বাপ মার্কামারা’। মজার এ গানটিতে তিনি খুব মজা করেই গেয়েছিলেন। গানটি খুব জনপ্রিয় ছিল রেডিওতে। একসময় বিয়েবাড়িতে বাজানো হত। গানটিতে ছবিতে স্টেজ পারফরম্যান্স করেছিল সজীব তাহের।

দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে। যেমন :

১৯৭৫ – আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার
১৯৮২ – অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার
১৯৮৭ – বাংলা একাডেমী পুরস্কার
২০০১ – অশ্বিনীকুমার স্বর্ণপদক
২০০৬ – জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার
২০১০ সালে একুশে পদক
২০১৪ – জাতীয় পরিবেশ পদক

‘জীবনানন্দ দাশ পদক’, ‘অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক’-সহ আরো পদকে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া ‘ইত্যাদি’ মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ টিভি অনুষ্ঠানের পুরস্কার পায়। পরে ওই ক্যাটাগরিটি বিলুপ্ত হয়।

আমরা খুব সৌভাগ্যবান প্রজন্ম যে হানিফ সংকেতের মতো বহুমুখী প্রতিভার কিংবদন্তিকে পেয়েছি। হানিফ সংকেত দেশে একটাই আছে। আর হবে না।


মন্তব্য করুন