হালদা : পরিচ্ছন্ন ছবি
হালদা
পরিচালক : তৌকীর আহমেদ
অভিনয় : জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রুনা খান, দিলারা জামান, ফজলুর রহমান বাবু, মোমেনা চৌধুরী, শাহেদ আলী ও সুজাত শিমুল।
গল্প : আজাদ বুলবুল
চিত্রনাট্য ও সংলাপ : তৌকীর আহমেদ
চিত্রগ্রহণ : এনামুল হক সোহেল
শব্দ : রিপন নাথ
সঙ্গীত : পিন্টু ঘোষ
কণ্ঠ : পিন্টু ঘোষ, সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা, সুকন্যা
রেটিং : ৪/৫
একবার গুণী অভিনেতা-নির্মাতা মাহফুজ আহমেদ আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার কাছে ভালো চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা কি? আমার উত্তর ছিল অনেকটা এরকম: ভালো চলচ্চিত্র সেটিই, যে চলচ্চিত্র আমি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করবো; প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে আসবার পরও যে চলচ্চিত্র আমাকে ঘুমুতে দেবে না। যে ছবির চরিত্রগুলো দীর্ঘদিন বাস করবে আমার চিন্তা ও চেতনার রাজ্যে। যে চলচ্চিত্র দেখে আমার চোখ জুড়াবে, মন জুড়াবে, হাসির দৃশ্যে হাসাবে, আবেগের দৃশ্যে কাঁদাবে, প্রেমের দৃশ্যে প্রেমানুভূতি গাঢ়ো করবে। ছবি থেকে কোনো বার্তা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলে, সেটি হবে বাড়তি পাওনা। ভণিতা না করে সরাসরিই বলি, তৌকীর আহমেদ পরিচালিত হালদা দেখবার পর আমার রায়: এটি ২০১৭ সালের এখন পর্যন্ত সবচাইতে ভালো ছবি। প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকা ওইটুকুন সময়ে নদী এবং নারীর আর্তনাদ আমি অনুভব করতে পেরেছি। হাসু, বদি, নাদের, সুরত বানু, জুঁই চরিত্রগুলোর হাহাকারে আমার বুক কেঁপেছে। চেনা জানা মুখস্থ একটি প্রেমের গল্পকে হালদাপাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের সংকট এবং হালদার ক্রমাগত দূষণের মোড়কে কী নান্দনিকভাবে মুড়িয়েছেন পরিচালক! দেখে মুগ্ধ হতে হয়। পদ্মা এবং তিতাসের পর বাংলা চলচ্চিত্রে আরেকটি নদীর গল্প উপহার দিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলেন নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। আমাদের এই নদী মাতৃক দেশে নদী ও মা মাছ বাঁচিয়ে রাখার সম্মিলিত প্রয়াস হিসেবে ‘হালদা’ চলচ্চিত্র কিছুটা একঘেয়ে হতে পারতো। ব্রিকফিল্ডের ধোঁয়া, কারখানার ময়লা, বৃক্ষ নিধন, অনাবৃষ্টি, মাছে ডিম না দেয়া-বিষয়গুলো প্রামাণ্যচিত্র মনে হতে পারতো। কিন্তু সুকৌশলী নির্মাতা তা হতে দেননি। নদীর বাঁক বদলের মত একটি দুঃসাহসিক প্রেমের গল্প ঢেউ খেলেছে পুরো ছবি জুড়ে। বাংলা চলচ্চিত্রে এতটা সাহসী প্রেমের গল্প এতটা সংবেদনশীলভাবে অতীতে কেউ উপস্থাপন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তৌকীর আহমেদ এ ক্ষেত্রে শতভাগ সফল। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ‘হালদা’র চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ সাম্প্রতিকালে খুব কম-ই দেখেছি।
এই দেশে জন্ম নিয়েও যারা বহুকাল ধরে দেশকে অনুভব করেন না কিংবা রূপসী বাংলার রূপ সম্পর্কে যাদের সম্যক ধারণা নেই, ‘হালদা’ দেখা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এনামুল হক সোহেলের চিত্রগ্রহণ এ ছবির অন্যতম প্রধান সম্পদ। ঝুম বৃষ্টিতে থৈ থৈ করা নদী কিংবা হাঁটু ডুবা কাদায় টব টব শব্দ যে কারো মনে বৃষ্টি ঝরাবে। গোধূলি বেলায় কিংবা ভোর রাতে, মাঝ নদীতে কিংবা মাঝ সমুদ্রে, নদীর বুকে বৃষ্টি কিংবা সন্ধ্যার বুকে মেঘ-সবকিছুতেই ছিল স্বাপ্নিক আবেশ। বজ্রপাতের এত সুন্দর ব্যবহার এর আগে কোনো ছবিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ‘হালদা’র প্রতিটি ফ্রেমই এ কারণে একেকটি পেইন্টিং। ব্যাঙের বিয়ে, গ্রামের বিয়েতে বরের জন্য গেট ধরা, বিয়ের নৌকা, নৌকা বাইচ, বলি খেলা, পালা গান, আকাশে মুহূর্মুহু বজ্রপাত, সমুদ্র, নৌকা, নদী, আকাশ, সর্ষে ক্ষেত, বড় মাছ, মাছের পোনা, কুকুরের ডাক, ছাগল, পাখি-সব মিলিয়ে ‘হালদা’কে বলবো আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি। এক অনন্য দলিল। অসম্ভব সুন্দর লোকেশন বাছাইয়ের জন্য নির্মাতাকে সাধুবাদ জানাই। আজাদ বুলবুলের সময়োপযোগী গল্প বাছাই করবার জন্য নির্মাতা তৌকীর আহমেদ শতবার সাধুবাদ পাবেন। মা মাছ শিকারের অনুতাপে যে জেলের রাত নির্ঘুম হয় কিংবা জেলে কন্যারও যে মাছের প্রতি নির্মোহ মায়া কাজ করে-এ ছবি দেখে অনুভব করেছি। চিত্রনাট্যকার এবং সংলাপ রচয়িতা হিসেবেও নির্মাতা বোধের জায়গাগুলোতে শক্ত অবস্থানে ছিলেন। যেমন: নাদের (জাহিদ হাসান) যখন হাসুকে (তিশা) বলেন: তোঁয়ার খাম বাইচ্ছা বিয়ানো। উত্তরে হাসু বলেন: সেই বাইচ্ছা বাঁইছবো ক্যামনে? নদীত কারখানার বর্জ্য, বাতাসে বিরিকফিল্ডের ধুঁয়া। আরেকটি দৃশ্যে হাসু যখন বদি’কে (মোশাররফ করিম) বলেন, কার কতা ভাইবতা লাইজ্ঞো? বদি বলে, সাগর চারি আইলে সাগরের কতা মনত পরে। নদী চারি আইলে নদীর কতা। হাসুর প্রশ্ন: আর মানুষ? মানুষের কতা নঅ ভাবুন? চট্টগ্রামের ভাষায় মনে না থাকলেও কিছু সংলাপ আমি এখনো বহন করছি, যেমন: স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না। স্বপ্ন দেখা ছেড়ো না/ ভালোবাসায় মিথ্যে বললে পাপ নেই / জলের এক নাম জীবন, আবার সেই জলেরই আরেক নাম মরণ/ অপেক্ষা শুধু সুন্দরই না, কষ্টেরও। মজার কিছু সংলাপও ছিল: মাছে যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা কি করবো? সুরত বানুদের পরিচয় বিলীন হয়ে যাওয়ার হাহাকারের দৃশ্যটি এ ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। সুরত বানুর (দিলারা জামান) আর্তি: ‘হাসু, আমারে সুরত কইয়া ডাকো’-এই সংলাপ দেখে শুধু নারীদেরই নয়, অনেক পুরুষ দর্শকেরও চোখ চিকচিক করতে দেখেছি। এ ক্ষেত্রেও পরিচালক আরেকবার সফল। সমাজে নারীদের অবস্থান যে আসলে কোথায়, চোখে আঙুল দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। বড় বৌয়ের (রুনা খান) সংলাপেও এই প্রেক্ষাপট সুস্পষ্ট: পয়সাওয়ালা গরিব গরতন বউ আনে কিল্লাই জানো? বউ জানি অয় পরীর মত। কাম খরে বান্দীর মত।
মুক্তির আগে চট্টগ্রামের ভাষায় ‘হালদা’ নির্মিত হয়েছে বলে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। তবে ছবি দেখতে গিয়ে সাবটাইটেলের কারণে কোনো সমস্যাই হয়নি। তাছাড়া দু-একজন বাদে প্রায় সবাই এই ভাষার প্রতি পূর্ণ সুবিচার করেছেন। যদিও ছবির শুরুতে সেন্সর সনদপত্রে তৌকীর আহমেদ-এর নামের বানান ‘তৌকির আহমেদ’ লেখা হয়েছে, ছবির সাবটাইটেলেও বেশ কয়েকটি বানান ভুল ছিল-তবে সেসব ভুল এড়িয়ে গিয়েছি। ডুব দিতে চেয়েছি ‘হালদা’র মূল গল্পে। যদিও চূড়ান্ত দৃশ্যটি অনুমেয় ছিল। মন চেয়েছিল অন্য কোনো সমাপ্তির। তাছাড়া হাসু কেন এতটা দূর্গতিনাশিনীর রূপে আবির্ভূত হলেন কিংবা তার অনাগত সন্তানের বাবা আসলে কে-বিষয়গুলো আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেও আশেপাশের অনেক দর্শককেই দেখেছি প্রশ্ন তুলতে। তবে আমি একজন দর্শক হিসেবে এ বিষয়গুলোতেই বেশি করে হাত তালি দেবো এটা ভেবে, এ ছবির প্রায় প্রতিটি চরিত্রই ধূসর। চিরাচরিত চলচ্চিত্রের মত এরা সবাই সাদা কিংবা কালো নয়। এ কারণেই হাসু যখন বড় বৌকে বলেন, চাবিটা দাও। ওটা আমার। কিংবা আমার গলার হার পড়ছো কেন?-বুঝে নেই হাসু যে কোনো কিছুর বিনিময়ে নিজের অধিকার রক্ষায় সচেতন। অবলা নারী হয়ে থাকতে চায় না সে।
‘হালদা’ ছবির আরেকটি প্রধান সম্পদ শক্তিশালী অভিনেতাদের অভিনয়। তৌকীর আহমেদের ছবিতে অতীতেও দুর্বল অভিনেতাদের সবল হতে দেখেছি, সে তুলনায় ‘হালদা’য় ছিল তাবৎ জাঁদরেল অভিনেতাদের সমাবেশ। পর্দায় তাদের অভিনয়যুদ্ধ দেখা ছিল দর্শকের জন্য বড় প্রাপ্তি। তারপরও এ ছবিতে নায়কদের নায়ক তিশা। এ বিষয়ে কেউই দ্বিমত করবেন না। তিশা এর আগেও বেশ কটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে ছোট পর্দার গুণী ও এ মুহূর্তে সবচাইতে জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে বড় পর্দায় এতটা শক্তিশালী হতে এর আগে কখনো দেখিনি। ছবির শুরু থেকে শেষ-অদ্ভুত এক মায়ার বাঁধনে দর্শককে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিশা। হতদরিদ্র জেলের মেয়ে হয়েও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হাসুর নদী রক্ষার পাশাপাশি বেঁচে থাকার যে আকুতি, তা তিশার মত অভিনেত্রীর পক্ষেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। বিয়ের পর প্রেমিককে ছেড়ে হাসুর বিদায়ের দৃশ্যে তিশার অভিব্যক্তি কিংবা শাশুড়ির হাতে ভাত খাওয়ার দৃশ্যে চোখ দিয়ে তিশার অভিনয় কিংবা একদম শেষে নাদের যখন বলে চলো, নতুন করে দিন শুরু করি-ঐ দৃশ্যে তিশার বাঁকা হাসি আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে এ ছবির জন্য তিশা সর্বোচ্চ পুরস্কার পাবার যোগ্যতা রাখেন। বিনা মেকআপে কিংবা কম মেকআপে তিশা যেন আরো উজ্জ্বল এ ছবিতে। তিশাকে এর আগে কোনো চলচ্চিত্রে এতটা সুন্দরী লেগেছে বলে পড়েনা। বাংলা চলচ্চিত্রে শক্তিশালী নারী চরিত্রের তালিকায় তিশার ‘হাসু’ থেকে যাবে আজীবন। তার সারল্য, প্রেম, বেদনা, বিদ্রোহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর কৃতিত্ব যেমন তিশার, তেমনি নির্মাতারও।
যেমন: জাহিদ হাসান কিংবা মোশাররফ করিমকে হালদা’য় তাদের চেনা চরিত্রের বাইরে নিয়ে এসেছেন পরিচালক। এজন্য-ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। মেধাবী অভিনেতা জাহিদ হাসানকে ছোট পর্দায় সাম্প্রতিককালে তার মেধা প্রমাণ করার মত তেমন কোনো চরিত্রে দেখিনি। তবে ‘হালদা’য় নিজের বহুমুখী সত্তাকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। ‘তিতলী ভাইয়া কঙ্কা ভাইয়া’ কিংবা ‘ক্যকু ক্যকু’ সংলাপের কারণে বিখ্যাত জাহিদ হাসান যখন চিৎকার করে বলেন, ‘স্বীকার খর বাইচ্ছা খার???’-তখন সত্যিই বুক কেঁপে ওঠে। মোশাররফ করিমের বিচার হবার দৃশ্যে জাহিদ হাসানের দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার অভিব্যক্তি এবং সেই সঙ্গে বলি খেলা’র প্রতীকী দৃশ্য দেখে অস্ফুটেই বলে উঠেছি-‘অসাধারণ!’ যদিও অন্যদের চেয়ে জাহিদ হাসানের চাঁটগার ভাষায় দখল কিছুটা কম। তারপরও জাহিদ হাসানের প্রতি কৃতজ্ঞতা তৌকীর আহমেদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ‘নাদের’-এর মত চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের বিস্মিত করবার জন্য।
একই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আমাদের দেশের অন্যতম মেধাবী অভিনেতা মোশাররফ করিমের প্রতিও। আমরা যারা অনেকেই ছোট পর্দায় মোশাররফ করিমের হাসির নাটক দেখতে দেখতে ক্লান্ত কিংবা অভিযোগ করি কেন তিনি ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেন না, তাদের জন্য ‘হালদা’ এ বছরের শ্রেষ্ঠ উপহার। অন্যদের তুলনায় ‘বদি’ চরিত্রে মোশাররফ করিমের অভিনয় দেখাবার সুযোগ ছিল কম, তবে যতটুকুই পেয়েছেন, অভিব্যক্তি দিয়ে লেটার মার্কস সহ পাশ করেছেন প্রিয় এই অভিনেতা। অসহায় জেলে কিংবা ব্যর্থ প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার পেটে অনাগত সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করার দৃশ্যে মোশাররফ করিমের চোখ আমার মন ছুঁয়েছে।
একইভাবে মন ছুঁয়ে গেছে ররুনা খানের অভিনয়। বড় বৌ জুঁইয়ের চরিত্রে রুনা খান ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এই জুঁই স্বামীর বাসর ঘর সাজিয়ে পেয়ালায় মদ ঢেলে দেয়। স্বামীর বিয়ের রাতে স্বামীকেই প্রশ্ন করে, বিলাই ন মারিবেন ফয়লা রাতিয়া? এই জুঁই ছোট বৌয়ের দুধে ধুতরা মেশায়, সিঁড়িতে সাবানের ফেনা ছেটায়, ছোট বৌয়ের অবর্তমানে তার গয়না পড়ে, খবরদারি করে! বঞ্চিত নারী কতটা হিংস্র হতে পারেন-রুনা খানের অভিনয় দেখে নতুন করে বুঝেছি। রুনা খান যদি নিয়মিত চলচ্চিত্রে শক্তিশালী কিছু চরিত্রে অভিনয় করেন, আমরা হিন্দি ছবির টাবু, বিদ্যা বালন কিংবা কঙ্কনা সেন শর্মার মত বড় পর্দায় একজন অভিনেত্রী পেতে পারি। তবে এর জন্য নির্মাতা এবং চিত্রনাট্যকারদেরও সে সুযোগ দিতে হবে।
যেমনটি সুযোগ পেয়ে ‘হালদা’ ছবিতে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন অভিনেত্রী দিলারা জামান। এমন প্রবীণ অভিনয়শিল্পীদের জন্য আমাদের দেশে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লেখা হয়না। তবে ‘হালদা’য় ব্যতিক্রম। এ ছবিতে দিলারা জামান তার দাপুটে অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন এ বয়সেও কেন তিনি সেরা। ‘সুরত বানু’ চরিত্রে তিনি একই সাথে ছেলের বৌকে শাসন করেন, আবার সেই হাতেই বৌকে মুখে তুলে খাইয়ে দেন। জাদুকরী এক ব্যক্তিত্ব! প্রেক্ষাগৃহে বসে তার অভিনয় দেখছিলাম আর বারবার মনে হচ্ছিল, যত দ্রুত সম্ভব তাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরতে হবে।
ফজলুর রহমান বাবু তুলনায় ‘হালদা’য় সুযোগ পেয়েছেন কম। তবে জাত অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু যখন যে চরিত্র ধারণ করেন পর্দায় যেন সে চরিত্রটিই হয়ে ওঠেন। এ ছবি দেখতে গিয়েও মনে হয়েছে তিনি যেন সত্যিই হতদরিদ্র অসহায় এক জেলে। অন্যান্য চরিত্রে মোমেনা চৌধুরী, শাহেদ আলী, সুজাত শিমুল নিজেদের অভিনীত চরিত্রের রূপায়নে আন্তরিক ছিলেন।
তবে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় পূর্ণতা পেয়েছে ছবির বাকি বিভাগগুলোর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কারণে। পোষাক ও রূপসজ্জায়ও ‘হালদা’ বিশ্বাসযোগ্য কাজ উপহার দিয়েছে। আবহ সংগীত ছিল হৃদয়গ্রাহী, ‘এ’ ক্লাস। কৌশিক রায়ের ডিআই কালার গ্রেডিং দু-এক জায়গায় ধারাবাহিকতা হারালেও সব মিলিয়ে চমৎকার। রিপন নাথের শব্দগ্রহণ কিংবা অমিত দেবনাথের সম্পাদনা ‘অসাধারণ’। পালা গানের ব্যাপ্তি আরেকটু কমিয়ে আনা যেত, সেই সঙ্গে কণ্ঠও আরো ভালো হতে পারতো।
সংগীত বিভাগে অবশ্য হালদা তৌকীর আহমেদের আগের ছবিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। প্রতিটি গানের ব্যবহারই প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে। মাইজভান্ডারী গানের সাথে আমরা মাথা দুলিয়েছি। ‘প্রেমের আগুন’ মন ছুঁয়ে গেছে। ’গম গম লার’ স্থায়ীভাবে প্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। তবে এ ছবির তো বটেই, ২০১৭ সালের সেরা গানের তালিকায় ‘হালদা’র ‘নোনাজল’-এর নাম উল্লেখ থাকতেই হবে। হাসু সব কিছু হারাবার পর আবার নতুন জীবন পায়। কিন্তু সব পাওয়া কি আর পাওয়া হয়? পাবার পরও প্রতি মুহূর্তে ভয়, যদি আবার হারিয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটের ওপর সৃষ্টি ‘নোনা জল’ গানে পিন্টু ঘোষের সুর, সংগীত, গায়কী, তার সঙ্গে নন্দিতা’র গায়কী এবং তৌকীর আহমেদের গীত ও চিত্রায়ণ-সব মিলিয়ে ‘অপূর্ব’।
যদিও ভালোর উল্টোপিঠে মন্দও আছে। অণুবীক্ষন যন্ত্র ছাড়াও ‘হালদা’র বেশ কিছু খুঁত খালি চোখেই দেখা গেছে। তবে সেসব এড়িয়ে গেছি আনন্দ নিয়েই। কারণ ‘হালদা’ শুধু আমাকে বিনোদিত-ই করেনি, বিকশিতও করেছে। শুরুতেই বলেছি, ভালো ছবি থেকে যদি বার্তা পাওয়া যায় সেটি হবে আমাদের জন্য বাড়তি পাওনা। ‘হালদা’ থেকে আমরা শিখেছি, ‘হালদা’র মত আরো অনেক নদীকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। সম্পদশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে কিংবা জলদস্যুদের আক্রমণের কারণে যদি জেলেদের রোজগার বন্ধ হয়ে যায় কিংবা তাদের জীবন বিপন্ন হয়-দিন শেষে সেটি আমার, আপনার কারো জন্যই মঙ্গলকর হবে না।
প্রিয় তৌকীর আহমেদ, এই বার্তা নতুন করে সবার অন্তরে জাগিয়ে তুলবার জন্য আপনার এবং ‘হালদা’ পরিবারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। ব্যর্থতা আমাদের, আমরা দেশের মেধা দূরে ঠেলে পরগাছা, পরজীবী হয়ে বিদেশী শিল্পী/ নির্মাতা/ কলাকুশলীদের দিয়ে গল্পহীন, মানহীন, অসার, অখাদ্য কিন্তু ১০-১২ কোটির ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করি। অথচ আপনি ‘অজ্ঞাতনামা’র মত কম বাজেটের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বিদেশের মাটিতে ১১ বার দেশের নাম উজ্জল করেন। ৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করে ‘হালদা’র মত বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি নির্মাণ করেন। আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে জানাই হাজারো সালাম। শ্রদ্ধা। কৃতজ্ঞতা।
: রিভিউটি দৈনিক সমকালের ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় সংক্ষিপ্তরূপে প্রকাশিত।