হুমায়ূনীয় বৈশিষ্ট্য ও রূপান্তরিত শিল্পে ‘দেবী’
একজন হুমায়ুন আহমেদ যখন থাকবে না তাঁর মতো করে আর কয়জন দেখাতে পারবে নাটক/চলচ্চিত্র? এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসত। আজ হুমায়ুন আহমেদ নেই তাঁর পাঠক আছে। পাঠকমাত্রেই দর্শক। হুমায়ুন তাঁর নির্মিত ছবিগুলোর সাথে পাঠক বা দর্শককে যেভাবে কানেক্ট করতে পারতেন অন্যরা কতটুকু পারতেন দেখার বিষয়। হুমায়ূন তাঁর নির্মিত ছবির বাইরে অন্য নির্মাতা যারা তাঁর ছবিগুলো নির্মাণ করেছিলেন এই দুয়ের মধ্যে তফাত বা ভালো লাগা কতটুকু থাকে। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ (১৯৯৪) উপন্যাস থেকে একই নামে নির্মিত ছবির নির্মাতা ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ খুশি হয়েছিলেন মোস্তাফিজুর রহমানের নির্মাণ দেখে। ছবিটি অনেকেরই প্রিয় তালিকায় আছে অথচ নির্মাণ কিন্তু হুমায়ূনের না। হুমায়ূন আহমেদের নির্মাণ বৈশিষ্ট্য রেখে মোস্তাফিজুর রহমান ছবিটি করেছিলেন দর্শক তাই হুমায়ূনের মতো করে ছবিটি পেয়েছিল। আজ হুমায়ুনহীন ২০১৮ সালে এসে তাঁর জনপ্রিয় ‘দেবী’ উপন্যাস থেকে একই নামে অনম বিশ্বাস নির্মিত ছবি ‘দেবী‘ হয়ে উঠল হুমায়ূনীয় বৈশিষ্ট্যের ছবি।
হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে তাঁর ছবিতে দর্শক ধরে রাখার উপাদান রাখতেন যেমন গল্পের গতি ঠিক রাখা, সুন্দর অভিনয়, হিউমার রেখে চরিত্রের ডায়লগ দেয়া, ভালো ফিনিশিং এগুলোর সবই ‘দেবী’ ছবিতে আছে।
‘দেবী’ রূপান্তরিত শিল্প। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রের অভিযোজন ঘটেছে। সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের সম্পর্ক এবং দূরত্ব দুটোই ঠিক রাখা হয়েছে ছবিতে। পরিচালক গৌতম ঘোষ এ সম্পর্কে বলেছেন-‘সাহিত্য চলচ্চিত্রে অনূদিত হয় রূপান্তরিত নয়। চলচ্চিত্র সময় ও গতি নিয়ে খেলে সাহিত্য তা করে না। সবচেয়ে ভালো হয় সাহিত্যিকের যে অভিজ্ঞতা তার সাথে পরিচালকের অভিজ্ঞতা মিশে যায়।’ গৌতম ঘোষের কথায় সাহিত্যিক ও লেখকের অভিজ্ঞতার জায়গাটিতে হুমায়ূন আহমেদ ও অনম বিশ্বাসের মিল আছে। হুমায়ূনকে গভীরভাবে স্টাডি করে অনম বিশ্বাস ছবিটি নির্মাণ করেছেন তাই দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে বা পাবে। হুমায়ূনের অভিজ্ঞতায় একজন রানু, নীলু, মিসির আলী তাদের চরিত্র সৃষ্টির অভিজ্ঞতা আছে আর অনম বিশ্বাস দর্শকের কাছে তাদেরকে গ্রহণযোগ্যতায় আনতে তাঁর অভিজ্ঞতাকে চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন।
অভিযোজন সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে ঘটে খুব সতর্কভাবে। একটার সাথে আরেকটা হুবহু কখনোই থাকে না, থাকলে দুই শিল্পই এক হয়ে যেত। ‘দেবী’ বইয়ের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী যদি কোনো পাঠক দর্শক হয়ে সিনেমাহলে গিয়ে বইয়ে রানু-নীলু-মিসির আলী যেমন ছিল ঠিক সেভাবেই চায় তবে চলচ্চিত্রের স্বাধীন ভাষায় সমস্যা হবে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’-তে ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুদৃশ্য বাড়ির মধ্যে দেখিয়েছেন কিন্তু পরিচালক সত্যজিৎ রায় তার মৃত্যুদৃশ্যটি দেখিয়েছেন বাড়ির বাইরের জঙ্গলে। সত্যজিতের যুক্তি ছিল জঙ্গলে মৃত্যুদৃশ্যটি দেখালে বেশি করুণ মনে হবে। নর্মালি বোঝা যায় বাড়ির মধ্যে অনেকের সামনে মৃত্যু হবে বা বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে কিন্তু জঙ্গলে তা ঘটবে না তাই করুণ লাগবে। ‘দেবী’ বইয়ের মতো করে হুবহু চাইলে ঢাকা শহরের অনেক পরিবর্তন করতে হবে যা এ সময়ে সম্ভব নয়। রানুর কিছুটা মাঝবয়েসী ইমেজ, নীলুর প্রযুক্তির সাথে যোগাযোগ দেখানো কিংবা মিসির আলীকে চঞ্চল চৌধুরীর মাধ্যমে অভিনয়ের মাধ্যমে রোগা করে তুলে ধরার চেষ্টা এগুলো সবই অভিযোজনের ফল। বিবর্তিত সময়ের সাথে বর্তমানে ‘দেবী’ কেমন হবে তার একটা পরিচিতি আছে ছবিতে।
ছবির ঘরানায় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার পুরোদমে ছিল। ‘হরর’ বিষয়টা পরিবেশগতভাবে এসেছে কারণ ‘দেবী’ ভর করে রানু ও নীলুর উপর এবং এর প্রভাবেই ভয়ের আবির্ভাব। আর ‘মিস্ট্রি’ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের একটা অংশ। মিসির আলী এ অংশের সমাধান বা অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে কাজ করেছে। ছবিতে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারে এগুলো ছিল :
সাসপেন্স- এরপরে কি ঘটবে এমন সিচুয়েশনে ছিল রানু, নীলু, মিসির আলী, বাসেত, আনিস সবাই।
ড্রামা – ঘটনার ঘনঘটা চলে পুরো সময়।অ্যাকশন – ভয়ের পরিবেশ তৈরি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও ভয়েসে। পাশাপাশি দেবী-র মাধ্যমে দর্শককে ভয় পাওয়ানো।
প্যারানইয়া – রানুর অবসেশন, মিসির আলীর সন্দেহ।
অভিনয়ে মিশ্র ছবি ‘দেবী।’ রানুর ভূমিকায় জয়া আহসান বিকল্পহীন পারফর্মার। তার অভিনয় নিখুঁত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং পরিস্থিতিমতে স্বাভাবিক। নীলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়াকে নিয়ে দর্শকের দুশ্চিন্তা থাকলেও তার চরিত্রের মানসম্মত পারফরম্যান্স করেছে। মিসির আলী চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী এসময়ের সেরা নির্বাচন যিনি বইতে তরুণ প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত যারা হুমায়ূনের আকণ্ঠ পাঠকভক্ত। সীমাবদ্ধতা খুঁজলে আনিস বা সাবেতের চরিত্রে খোঁজা যাবে। অনিমেষ আইচ ও ইরেশ যাকের তাদের সাধ্যে অভিনয় করেছে কিন্তু মনে রাখতে হবে হুমায়ূন আহমেদ তাদের চরিত্রে গভীরতা তত রাখেননি। তবে তারা ভারিক্কি অভিনয়টা করলে হয়তো এ ধরনের ছবিতে দেখতে ভালো লাগত।
আর্থার কোনান ডয়েলের ‘শার্লক হোমস’ তো আর আমরা বানাই না। আমাদের হাতের কাছে যা আছে সেই ভাণ্ডার থেকে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ থেকে অনম বিশ্বাসের ‘দেবী’ সময়ের সেরা ছবি। জানা গল্পকে সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রের ভাষায় রূপান্তরিত শিল্পে বারবার দেখার মতো ছবি মনে হবে।