Select Page

হৃদয় ততটা জুড়ালো না

হৃদয় ততটা জুড়ালো না

হৃদয় জুড়ে 
ধরণঃ রোম্যান্টিক ড্রামা
গল্প ও পরিচালনাঃ রফিক সিকদার
প্রযোজনাঃ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লি.
অভিনয়ঃ নীরব হোসেন (অমিত), প্রিয়াঙ্কা সরকার (নীলিমা), নুসরাত জাহান পাপিয়া (সোনালী), মনির হোসেন যুবরাজ (আরিয়ান), সাইফ চন্দন, ডন, সুব্রত (নীলিমার বাবা), রিনা খান (আরিয়ানের মা), রেবেকা রউফ (অমিতের মা), শিবা শানু, কাজী হায়াৎ, জাহিদ হাসান প্রমুখ।
শুভমুক্তিঃ ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

নামকরণঃ ২০১৬ এর শেষের দিকে যখন এছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয়, তখন এর নাম ছিল “আমি শুধু তোর হবো”, পরবর্তীতে নামটি পরিবর্তন করে “ভালোবেসে তোর হবো” রাখা হয়। দীর্ঘ ঝামেলা পেরিয়ে যখন ছবিটির কাজ পুনরায় শুরু হয়, তখন এর নামকরণ করা হয় “হৃদয় জুড়ে”। মূলত এই তিনটি নামই এ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখানো একটি চিঠিতে খুজেঁ পাওয়া যায়। যারা সৎভাবে তাদের প্রিয়জনকে ভালোবাসে, তারা কখনোই তাদের প্রেমের প্রতি অবিচার করতে পারে না। কারণ ভালোবাসার মানুষটি সর্বদা তার হৃদয় জুড়ে বিচরণ করে। “হৃদয় জুড়ে” চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তু কিছুটা এরকমই।

নামকরণটি আমার কাছে যথাযথ এবং সুন্দর মনে হয়েছে।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপঃ “হৃদয় জুড়ে” এর গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ তিনটিই লিখেছেন এছবির পরিচালক রফিক সিকদার। সত্যি কথা বলতে, ইতিবাচক দিকের তুলনায় নেতিবাচক দিকের পরিমাণ ঢের বেশি। তাই শুরুতে এচলচ্চিত্রে খুজেঁ পাওয়া সবথেকে বড় নেতিবাচক দিকটি আগে বলে নেই। এছবির গল্পের যে মূল বিষয়বস্তু, যাকে প্রবাদ প্রবচনের ভাষায় বলা যায় “জোর যার মুল্লুক তার”, সেটি নিয়ে আমাদের দেশে পূর্বে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। একই কনসেপ্টে এতো বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ায় দর্শকরা মোটামুটি এঘরানার ছবির সাথে অভ্যস্ত, সেইসাথে এধরনের ছবির গতিপথ কেমন হয় সেটাও তাদের কাছে প্রত্যাশিত। তাই এধরনের ছবিকে আকর্ষণীয় করতে হলে যে কাজটি প্রথমে ভালোভাবে করতে হয়, তা হলো চিত্রনাট্য ও সংলাপ। চিত্রনাট্যে এমন অপ্রত্যাশিত কিছু রাখতে হয়, যেনো শুরু থেকে শেষ অব্দি দর্শকদের খেয়াল ধরে রাখতে পারে। আমাদের দেশে এধরনের যে চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তা এই ভিন্নতার ওপর নির্ভর করেই। কিন্তু “হৃদয় জুড়ে” ছবিতে এই বিষয়টির বড্ড অভাব।

গল্প যতটা ভালো মনে হয়েছে, এছবির উপস্থাপনা হয়েছে সেতুলনায় অত্যন্ত গতানুগতিক ঢঙে.. যেখানে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা থাকবে, তাদের মধ্যে ধনী-গরিবের কিছুটা ভেদাভেদ থাকবে, এদের মাঝে কিছু তৃতীয় পক্ষ থাকবে যারা এই সম্পর্কের ঘোর বিরোধী, অতঃপর তারা কিছু আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিবে যাতে করে সবার ক্ষতি হবে। এমন ফর্মুলার চলচ্চিত্র আমাদের দেশে যে কত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এখানে উচিত ছিল গল্পের উপস্থাপনায় ভিন্নতা আনা, যেটা করতে না পারায় এছবি শুরু থেকেই দর্শককে অমনোযোগৗ করে তোলে।

দ্বিতীয়ত যে দিকটি এছবিকে ম্যাঁড়মেড়ে করে দিয়েছে, সেটি হলো মূল চরিত্রগুলোকে পর্দায় স্থিতিশীল হওয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ না দেওয়া। এর পরিবর্তে কিছু পার্শ্বচরিত্র অধিক সুযোগ পেয়েছে নিজেদের চরিত্রগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার। এতে করে যে সমস্যাটি হয়েছে, চরিত্রগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া হলেও এগুলো বাস্তবতা থেকে অনেক দুরে মনে হয়, পর্দার সামনে বসে নিজেকে গল্পের সাথে ততটা জুড়ে ফেলা যায় না।

ছবির বিশাল বড় বড় সংলাপ একটা সময় গিয়ে বেজায় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে কিছু ভালো সংলাপও ছিল। উদাহরণ হিসেবে অমিত-নীলিমার মধ্যকার প্রতিজ্ঞা করার সিকোয়েন্স, জেলখানার কিছু সিকোয়েন্স কিংবা একদম শেষের দিকে চিঠিতে লেখা কিছু সংলাপের কথা মনে করা যায়। তবে এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম, বিপরীতদিকে নব্বই দশকীয় ঘরানার বড় বড় সংলাপের পরিমাণই বেশি, অভিনয়শিল্পীরা এগুলো টেনে টেনে বলায় বিষয়টি আরো বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া স্থুল সংলাপ তো ছিলই। “আমাকে দেখলে শতবর্ষী বৃদ্ধেরও কাম জাগে, তোর জাগে না কেন?” এরকম কিছু স্থুল সংলাপে গুটিকয়েক দর্শককে মাথায় হাত দিতে দেখেছি।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ২০।

পরিচালনাঃ নির্মাতা রফিক সিকদারের এটি দ্বিতীয় ছবি। এর আগে চার বছর আগে অলমোষ্ট একই অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে তিনি “ভোলা তো যায় না তারে” নির্মাণ করেছিলেন। অনস্ক্রিণের তুলনায় অফস্ক্রিণের বিবিধ ঘটনাবলী নিয়ে সাধারণত তিনি সারাবছর আলোচনায় থাকেন, তবে সে আলোচনায় আপাতত না যাই। কথা বলা যাক তার পরিচালনা নিয়ে, যেখানে তার হাত ধরে পূর্বের ছবির মতোই আরেকটি দূর্বল নির্মাণ খুজেঁ পাওয়া গেলো মনে হলো। তার পরিচালিত দুটি ছবি দেখে তিনি সহ আমাদের দেশের নিয়মিত কাজ করা তরুণ পরিচালকদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ থাকবে… আশি কিংবা নব্বই দশকের গল্প বলার ধরন ছাড়ুন, গল্প বলার নতুন ধারা তৈরি করুন। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাড়িয়ে কোনো দর্শকই ত্রিশ কিংবা চল্লিশ বছর আগের স্টাইল ফলো করতে চাইবে না। দর্শক আকর্ষণ ধরতে হলে গল্প বলার ধরণে নতুনত্ব আনা জরুরী।

অভিনয়ঃ নীরবের গতানুগতিক ছবিগুলোতে যে দূর্বলতাগুলো খুজেঁ পাওয়া যায়, এখানেও সেই একই দূর্বলতা প্রতীয়মান। তার রূপদান করা চরিত্রগুলো কেন যেনো পুরোপুরি বাস্তব মনে হয় না, কিছুটা আরোপিত ঘরানার হয়ে যায়। কোনো চরিত্রকে সঠিকভাবে পর্দায় উপস্থাপন করতে হলে, সেটিকে দীর্ঘসময় মনেপ্রাণে ধারণ করতে হয়। তবেই সেটি বাস্তব হয়ে পর্দায় ধরা দেয়। এখানে যেরকম অভিনয় তার কাছ থেকে পাওয়া গেছে, খুব বেশিদিন মনে রাখা হয়তো যাবে না।

কোলকাতার পরিচিত মুখ প্রিয়াঙ্কা সরকার এই প্রথম পুরোদস্তুর বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেন। নীরবের মতো তার অভিনয়ও পর্দায় ততটা রিয়েলিস্টিকভাবে ফুটে ওঠেনি। এছাড়া তার সংলাপ দেওয়ার ধরণে কিছুটা আরোপিত ভাব রয়েছে, যেটি কারো ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। সম্ভবত তিনি তার নিজের ডাবিং করেননি, কন্ঠস্বরে বেশ মিল থাকায় এটি ততটা বোঝা যায়নি।

প্রধান পার্শ্বচরিত্র মনির হোসেন যুবরাজ যদি এছবিতে অভিনয় না করতেন তবেই মনে হয় ভালো হতো। এরকম অতিদূর্বল অভিনয় করে আদতে কোনো লাভ নেই, দর্শক আজ দেখে কাল ভুলে যাবে। ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে তবেই আশা উচিত, যাতে করে দর্শক আজীবন মনে রাখতে বাধ্য হয়।

আরেক গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্রে নুসরাত জাহান পাপিয়া যথেষ্ট সুযোগ পাননি কিছু করে দেখানোর, তার চরিত্রটি যেরকম ছিল তাতে করে এর থেকে ভিন্ন কিছু দেখানো যেতো।

নেতিবাচক চরিত্রে ডন, সাইফ চন্দন, জাহিদ হাসান প্রমুখেরা পূর্বের মতোই গতানুগতিক ছিলেন। রিনা খান, সুব্রত দের কিছু করে দেখানোর জায়গা কম তাই তার কাছ থেকেও গতানুগতিক অভিনয় পাওয়া গেছে। অতিথি চরিত্রে শিবা শানু ও কাজী হায়াৎ অভিনয় করেছেন।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৩০।

কারিগরিঃ ছবির কাজ শুরু হয়েছিল আজ থেকে তিন বছর আগে, সে হিসাব মাথায় রেখে কষলেও এছবির টেকনিক্যাল দিকগুলি অনেক বেশি দূর্বল। সবথেকে বেশি দূর্বলতা বোধহয় এডিটিং এ, খুবই নিম্নমানের সম্পাদনা কাজ হয়েছে এছবির। সিনেমাটোগ্রাফি গতানুগতিক ঘরানার, তেমন প্রশংসা করার মতো না।

পুরো ছবিটি ঢাকার অদুরে সাভার অঞ্চলে শ্যুট করা হয়েছে, সেহিসেবে প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তত লোকেশনগুলো ভালো লাগবে। সেক্ষেত্রেও হতাশ হয়েছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুন্দর একটি পরিবেশকে নান্দনিক উপায়ে পর্দায় উপস্থাপন করতে এছবির টিম সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কালার গ্রেডিং, লাইটিং, সেট ডিজাইন এগুলো খুবই নিম্নমানের। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ ভালো, তবে ততটা জোরালো না। কস্টিউম, মেকআপে দূর্বলতার ছাপ স্পষ্ট, দ্বিতৗয়ার্ধে দেখানো নীরবের আলগা চুল খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে।

এ অংশ পাবে ২৫% মার্ক।

বিনোদন ও সামাজিক বার্তাঃ ছবিতে থাকা গানগুলো তুলনামূলক বেশ ভালো ছিল। তিনটি গানই যথেষ্ট ভালো ও পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছে। তন্মধ্যে আমার কাছে ইমরান ও বৃষ্টির গাওয়া টাইটেল ট্র্যাকটি সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে। জনপ্রিয় গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবন এগানটি লিখেছেন, সুর দিয়েছেন ইমরান নিজেই।

সুরকার ও সংগীতশিল্পী বেলাল খান কোনালের সাথে “তুমি হীনা” ও “বিশ্বাস যদি” নামে দুইটি গান গেয়েছেন এবং সুর দিয়েছেন। প্রথমটির গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবন, দ্বিতৗয়টির গীতিকার হলেন জীবন মাহমুদ। এদুটি গানও বেশ ভালো হয়েছে। গানগুলোর কোরিওগ্রাফি করেছেন ভারতের পঙ্কজ, বেশ ভালো কোরিওগ্রাফি করেছেন।

গতানুগতিক রোম্যান্স নির্ভর ছবির তুলনায় এছবির চিত্রনাট্য কিছুটা ধীরগতির, অনেকের ক্ষেত্রে বোরিং অনুভুত হতে পারে। সিনেমায় নীরব-প্রিয়াঙ্কার মধ্যকার মজাদার খুনসুটির যথেষ্ট অভাব ছিল মনে হয়েছে।

খুন ও ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে সামনে রেখে ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ দেখানো হয়েছে এছবিতে। কীভাবে এক সাধারণ ছেলের জীবনে করুণ পরিণতি নেমে আসতে পারে সেদিকেও আলোকপাত করা হয়েছে। আইনের শ্বাসন প্রতিষ্ঠা না পাওয়া পর্যন্ত এসব থেকে সমাজের রেহাই নেই, এই বাস্তবতাই দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে এছবিতে।

এ অংশ পাবে ৬০% মার্ক।

ব্যক্তিগতঃ পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, অনেক ঝক্কিঝামেলা পার হয়ে এছবির মুক্তির দুয়ার খুলেছে। সেক্ষেত্রে এছবি যে দর্শক দেখতে পাচ্ছে এ নিয়েই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা খুশি। তবে বাস্তবতা এটাই, দূর্বল নির্মাণের ছবি যতই ভালো মেসেজ দিক, আদতে সে ছবি কোনো দর্শকের মনে দাগ কাটে না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নির্মাণশৈলীর দক্ষতা বাড়াতে হবে। সবমিলিয়ে “হৃদয় জুড়ে” খুবই দূর্বলমানের একটি রোম্যান্টিক ছবি হয়েছে, যেখানে ভালো একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

রেটিংঃ ৩.৫/১০

ছবিটি কেন দেখবেনঃ স্বল্পসময়ে অনেক দর্শককে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, যারা চলচ্চিত্রে প্রেম ও সুন্দর সব গান দেখতে পারলেই পয়সা উসুল বিনোদন পান। এছবি সম্পূর্ণ তাদের জন্য। দেখে আসুন, উপভোগ করবেন আশাকরি। বোনাস হিসেবে তো সামাজিক বার্তা হয়েছেই।


Leave a reply