Select Page

৫৫ কোটি টাকা পুঁজি হারানো বছর/সালতামামি ১৯৯৯

৫৫ কোটি টাকা পুঁজি হারানো বছর/সালতামামি ১৯৯৯

গত শতকের শেষ বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালকে ‘বাংলা সিনেমার জন্য অভিশাপের বছর’ বলে মতামত দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। আশা করেছিলেন, শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু প্রায় ২৫ বছর পর আমরা সেই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছি যে, অভিশাপ কাটতে কত সময় লাগবে! ওই বছর ৮৭টি ছবি মুক্তি বাবদ বিনিয়োগ হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। পুঁজি ফেরত এসেছে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। আর বাকি ৫৫ কোটি টাকা গচ্ছা যায়।

প্রথম আলোতে কামরুজ্জামান বাবুর করা সালতামামি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ৯৯ সালে চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস। উপশিরোনামে দেখা হয়, ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ, ৫৫ কোটি টাকার খবর নেই

প্রতিবেদনে বলা হয়, বছর শেষে শীর্ষ দশের তালিকায় সুপারহিট ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ১১টি ছবি। ২১টি ছবির প্রযোজক কোনো রকম তাদের বিনিয়োগ ফেরত আনতে পেরেছেন। বাকি ৫৫টি ছবিই ফ্লপ। আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের তুলনায় এ বছর ১০ কোটি টাকা বেশি গচ্চা দিতে হয়েছে প্রযোজকদের। অথচ ধারণা করা হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৯৮ সালটাই নব্বই দশকের সবচেয়ে মন্দার বছর। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, শতাব্দীর ভয়াবহ মন্দা সিনেমার বাজার হচ্ছে ১৯৯৯ সাল।

৮৭টি ছবির মধ্যে যে ২১টি ছবি মোটামুটি ব্যবসা করেছে সেগুলো হচ্ছে- কে আমার ব্যবা, মোস্তফা ভাই, হঠাৎ বৃষ্টি, রবি মাস্তান, ভণ্ড বাবা, বুকভরা ভলোবাসা, ম্যাডাম ফুলি, জননেতা, অনন্ত ভালোবাসা, জোর, জবরদখল, বাঘের থাবা. লাল বাদশা, কদম আলী মাস্তান, বিলাত ফেরত মেয়ে, ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা, সন্তান যখন শত্রু, মরণ কামড়, লাভ ইন থাইল্যান্ড, দুজন দুজনার, রাজার ভাই বাদশা ও ধর।

মন্দার বছরে নির্মাণ হয়েছিল উল্লেখযোগ্য ১৫টি ভালো ছবি- শিবলি সাদিকের ‘পাহারাদার’, মনোয়ার খোকনের ‘একটি সংসারের গল্প’, ‘স্বপ্নের পুরুষ’, মতিন রহমানের ‘আমি তোমারি’, ওয়াকিল আহমেদের ‘ভুলনা আমায়’, শওকত জামিলের ‘প্রাণের প্রিয়তমা’, শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘পাগলা ঘণ্টা’, সোহানুর রহমান সোহানের ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ইস্পাহানি আরিফ জাহানের ‘শত্রু ধ্বংস’, মালেক আফসারীর ‘লাল বাদশা’, বাদল খন্দকারের ‘মিস ডায়না’, শাহ আলম কিরণের ‘মনের মিলন’, নায়করাজ রাজ্জাকের ‘সন্তান যখন শত্রু’ ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘রাগী’। এসব ছবির মধ্যে ম্যাডাম ফুলি, অনন্ত ভালোবাসা, লাল বাদশা ও সন্তান যখন শত্রু পুঁজি ফেরত পেলেও বাকি ১১টি ছবিই ফ্লপ।

এর আগে বছর ১৯৯৮ সালেও অবাক হওয়ার মতো একটি বিষয় ছিল যে, প্রত্যেক বছর যে নির্মাতাদের ছবি শীর্ষ দশের মধ্যে থাকে তাদের মধ্যে অনেক নির্মাতা বক্স অফিসে ছবি হিট করাতে পারেননি। উল্লেখযোগ্যরা হলেন শহিদুল ইসলাম খোকন, বাদল খন্দকার, সোহানুর রহমান সোহান, ওয়াকিল আহমেদ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও শিবলি সাদিক।

আরো বলা হয়, বাংলা সিনেমার হাতে গোনা কয়েকজন নির্মাতা আছেন যাদের নাম শুনে দর্শক হলে যেতে চায়। এদের কয়েকজন হলেন শহিদুল ইসলাম খোকন, বাদল খন্দকার ও সোহানুর রহমান সোহান। কিন্তু তাদের জন্য বছরটি ভালো ছিল না। ‘এ বছরের সফল পরিচালকরা’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েক জন নির্মাতা সিনেমা ব্যবসাটাকে একেবারেই অচল হতে দেননি। এরা হলেন মনতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াৎ, রায়হান মুজিব, আজিজ আহমেদ বাবুল, মহম্মদ হাননান, মতিন রহমান, মনোয়ার খোকন, শাহাদৎ হোসেন বাদশা, আাজাদী হাসনাত ফিরোজ ও মুস্তাফিজুর রহমান বাবু।

মনতাজুর রহমান আকবরের দুটি ছবি সুপার-ডুপার হিট হয়েছে- ভয়ঙ্কর বিষু ও মগের মুল্লক। কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ ছবিটি দারুণভাবে ব্যবসা সফল হয়েছে [যা পরবর্তীতে কাল্ট মর্যাদা পায়]। রায়হান মুজিব ও আজিজ আহমেদ বাবুল পরিচালিত ‘খবর আছে’ রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করে। অন্যদিকে মতিন রহমানের ‘বিয়ের ফুল’ ও মনোয়ার খোকনের ‘জিদ্দি’ বছরের শুরুতেই অসাধারণ ব্যবসা করায় ধারণা করা হয়েছিল বছরজুড়ে ছবির ব্যবসা ভালো যাবে। কিন্তু দুই নির্মাতা তাদের পরবর্তী ছবিতে ব্যবসায়িক রেকর্ডের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি।

মহম্মাদ হাননান তার ‘ভালোবাসি তোমাকে’ ও শাহাদৎ হোসেন বাদশা ‘রানী কেন ডাকাত’ ছবি দুটি সিনেমার ব্যবসায় গতি ফিরিয়ে আনেন। দুই তরুণ নির্মাতা মুস্তাফিজুর রহমান বাবু ‘স্পর্ধা’ ও আজাদী হাসনাত ফিরোজ ‘কাজের মেয়ে’ নামের দুটি সুপারহিট ছবি উপহার দেন। ‘কাজের মেয়ে’ এতটাই দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল যে, টানা তিনদিন হরতালেও সিনেমা হলগুলো ছিল দর্শকে কানায় কানায় ভরপুর। মালেক আফসারীর ‘রাজা’ ভালো ব্যবসা করেছে। তবে ছবিটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে দেখা গেছে, শীর্ষ দশ তালিকায় যৌথভাবে ১১টি ছবি স্থান পেয়েছে।

‘সিনেমার ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার?’ এ প্রশ্ন ছিল প্রতিবেদনে। এর কারণ হলো ব্যবসায়িক মন্দা। বলা হচ্ছে, ১৯৯৯ সালে ৫৫ কোটি টাকা পানিতে খোয়া গেছে আর ৪৫ কোটি টাকা ব্যবসা করেছে। সঙ্গত কারণে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে যে, তাহলে কি সিনেমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার? এ বিষয়ে পরিচালক ও নায়ক-নায়িকারা একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন।

নয়করাজ রাজ্জাকের মতে, ১৯৯৯ সালে সিনেমার ব্যবসাটাকে নষ্ট করেছে আমাদের কিছু নির্মাতাই। অশ্লীল ছবি নির্মাণ করে তারা নারী দর্শককে হল থেকে বের করে দিয়েছে। তবে এখন আমি আশাবাদী। কারণ বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অশ্লীল ও নগ্ন ছবির যে পরিমাণ আবেদন ছিল বছরের শেষে তার বিপরীতটাই লক্ষণীয় বিষয় ছিল।

তিনি আরো বলেন, আমি আশাবাদী ২০০০ সালে বাংলা চলচ্চিত্র আবারও তার হারানো ছন্দ ফিরে পাবে এবং রোমান্টিক সামাজিক ছবি দেখার জন্য দর্শক হলঘরে ভিড় করবে।

নির্মাতা শিবলি সাদিক বলেন, বর্তমান অবস্থার পেক্ষাপটে বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হলেও আগামী বছর দর্শক অশ্লীল ছবিকে বয়কট করবে এবং সুস্থ ছবিকেই গ্রহণ করবে। শহিদুল ইসলাম খোকন বলেন, আমি মনে করি এখন চলচ্চিত্রের যে দূরবস্থা চলছে তা আগামী বছর কেটে যাবে এবং মনে করি না যে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

অন্যদিকে এ বছরের সফল পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, ছবি যদি ভালো হয় তাহলে ওই ছবি অবশ্যই ভালো ব্যবসা করবে। তার প্রমাণ ভয়ঙ্কর বিষু ও মগের মুলুক।

কাজী হায়াৎ বলেন, গল্পের জোরে ছবি চলে। তার প্রমাণ আম্মাজানের ব্যবসায়িক রেকর্ড। আমি মনে করি না বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।

নায়ক মান্না ও রিয়াজের মতে, ছবির নির্মাণশৈলী, গল্প, গান ও অভিনয় যদি ভালো হয় তাহলে ছবি অবশ্যই ভালো ব্যবসা করবে। তাই মনে হয় না চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নায়িকা শাবনর ও পপির মতে, চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করার কোনো কারণ নেই। এ বছর চলচ্চিত্র শিল্পে যে রকম অস্থিরতা ছিল তা কেটে যাচ্ছে। ২০০০ সালে ছবির বাজারে সুস্থতা ফিরে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

এ বছরের ব্যবসাসফল ছবির তালিকা— ১. খবর আছে (রায়হান মুজিব ও আজিজ আহমেদ বাবুল) এবং আম্মাজান (কাজী হায়াৎ), ২. ভয়ঙ্কর বিষু (মনতাজুর রহমান আকবর), ৩. বিয়ের ফুল (মতিন রহমান), ৪. জিদ্দি (মনোয়ার খোকন), ৫. মগের মুল্লুক (মনতাজুর রহমান আকবর), ৬. রানী কেন ডাকাত (শাহাদৎ হোসেন বাদশা), ৭. ভালোবাসি তোমাকে (মহম্মদ হাননান), ৮. রাজা (মালেক আফসারী), ৯. কাজের মেয়ে (আজাদী হাসনাত ফিরোজ) এবং ১০. স্পর্ধা (মুস্তাফিজুর রহমান বাবু)।

ব্যবসায়িক সফলতার উল্লেখের পাশাপাশি ওই বছরের সেরা পাঁচ নায়ক-নায়িকার অবস্থান নির্ণয় করে প্রথম আলোর সাপ্তাহিক বিনোদন সাপ্লিমেন্ট আনন্দ।

নায়ক

মান্না: বছরটা ছিল মান্নার। তার ১৭টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। বেশ কয়েকটি ছবি ব্যবসায়িকভাবে সফলতা পেয়েছে। মান্নার হাতে রয়েছে সর্বাধিক ছবি, ১৯৯৯ সালে ২৫টি ছবির মহরত করেছেন। অভিনয় করেছেন মৌসুমী ও পপির বিপরীতেই বেশি।

রিয়াজ: ১৯৯৯ সালে রিয়াজ অভিনীত আটটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। পারিশ্রমিক নিচ্ছেন মান্নার পর পরই।

রুবেল: এ অভিনেতার কোনো ছবি বক্স অফিসের রিপোর্ট অনুযায়ী শীর্ষ দশের তালিকায় না থাকলেও রুবেলের অবস্থান তৃতীয়। এ বছর তার ছবি মুক্তি পেয়েছে ১১টি। রুবেল এবছর প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার হাতে ছবি রয়েছে ১৫টির উপরে।

আমিন খান: রোমান্টিক অ্যাকশন, সামাজিক সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার মতো নায়ক হিসেবে তাকে নির্মাতাদের পছন্দ। মিষ্টিভাষী এই নায়কের এ বছরে ১০টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। বর্তমানে আমিনের হাতে রয়েছে ১২/১৩টি ছবি।

শাকিল খান: ১৯৯৮ সালে শাকিল খান যতটা রাজত্ব করতে পেরেছিলেন, পরের বছরের প্রথম মাসেও বিয়ের ফুল ও মগের মুল্লক আসন আরো পাকাপোক্ত করে দেয়। কিন্তু এর পরে শাকিল আর এগোতে পারেননি।

নায়িকা

শাবনূর: এ বছর শাবনূরের আটটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। বছরের প্রথমেই ‘বিয়ের ফুল’ সফল হয়। অবশ্য হাতে ছবির সংখ্যা পপি ও মৌসুমের চেয়ে কম হলেও তিনি এ বছর দুই নায়িকার চেয়ে এগিয়ে।

মৌসুমী: ১৯৯৮ সালটা খুব খারাপ গেলেও ১৯৯৯ সালের মগের মুল্লুক, খবর আছে, আম্মাজান ছবি তিনটি ভালো ব্যবসা করায় মৌসুমীর চাহিদা তৈরি হয় আবার। তার ১০টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। হাতে রয়েছে ১৭টি। দু-একটি ছবিতে অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য মৌসুমী সমালোচিত হয়েছেন।

পপি: বছরটা পপির জন্য খুব একটা ভালো ছিল না, তারপরও শাবনর-মৌসুমীর সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে লড়েছেন। এ বছর পপিকে নিয়ে নানা রকম শুজব রটেছিল। তারপরও কঠিন দুঃসময় পার করে এসেছেন। এ বছর পপি অভিনীত ছবির সংখ্যা হচ্ছে ১৩টি। এ মাসুদ পারভেজ গ্রুপের দুটি ছবি হাতে পেয়েছেন তিনি। বছরের শুরুতেই সুপার হিট ছবি ‘জিদ্দি’ উপহার দিয়েছেন।

মুনমুন: সাবলীল অভিনয়ের জন্য বছরের শুরুতেই নির্মাতারা মুনমুনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। যদি পরপর কয়েকটি ছবিতে সফলতা পেতেন এবং অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য সমালোচনার শিকার না হতেন, তাহলে হয়তো শাবনূর-মৌসুমী-পপির কাতারেই থাকতেন। কয়েকটি ছবি সেই স্বপ্ন এখন অধরা, তাকে নিয়ে ভাবছেন না নির্মাতারা। তারপরও মুনমুনের হাতে বেশ কিছু ছবি আছে। তার ‘রাণী কেন ডাকাত’ ও ‘রাজা’ ভালো ব্যবসা করেছে।

শাহনাজ: বাংলা চলচ্চিত্রে দিতির পরে শাহনাজকেই ধরা হয় ভাগ্যবতী নায়িকা। দীর্ঘদিন ধরে দাপটের সাথেই অভিনয় করে চলেছেন তিনি। এ বছর শাহনাজ অভিনীত নয়টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। হাতে রয়েছে আরো নয়টি। ১৯৯৯ সালে অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয়ের কারণে শাহনাজকেও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আগের বছর নায়িকাদের মধ্যে তার বর্তমান ছিল চতুর্থ। এবার তিনি পিছিয়ে গেছেন একধাপ।


মন্তব্য করুন