‘বিকাল বেলার পাখি’ নকল! কী বললেন নির্মাতা? (ভিডিও)
ঈদুল ফিতরে ছবিয়াল রিইউনিয়নে প্রচারিত ‘বিকাল বেলার পাখি’ নাটকটি নিয়ে দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসার শেষ নেই। এর মাঝে আদনান আল রাজীব নির্মিত নাটকটি নিয়ে নকলের অভিযোগ তুলেছেন নির্মাতা আশরাফুল আলম রিপন। তার উত্তরও দিয়েছেন রাজীব। ফেসবুক থেকে পোস্ট দুটি তুলে ধরা হলো।
আশরাফুল আলম রিপন :
আমার ধন্যবাদ ফিরিয়ে নিলাম আদনান আল রাজিব !!
অনেকদিন পর ঈদের নাটক খুব জমেছিলো এবার। একদিকে ছবিয়াল রিইউনিয়ন অন্যদিকে আয়নাবাজী অরিজ্যিনাল সিরিজ নিয়ে দর্শকদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা খুব উপভোগ করেছি।অনেকদিন পর টিভি নাটক নিয়ে সহকর্মীদের চায়ের কাপে ঝড় আমাকে পুরানো দিনে ফিরিয়ে নিয়েছে।
যদিও আম্মার অসুস্থতার জন্যে ঈদের সময়ে টিভি দেখা সম্ভব হয়ে উঠেনি । কিন্তু ঈদ পরবর্তী আলোচনা আর অনুজ সাংবাদিক বন্ধুদের অনুরোধে ইউটিউব থেকে কয়েকটি নাটক দেখতে বাধ্য হয়েছি ।উপভোগ ও করেছি । ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের গল্প , নির্মানশৈলীতে অভিনবত্ব আর যত্নের ছাপ স্পষ্ট ছিলো প্রায় প্রতিটি নাটকে।এর মধ্যে আদনান আল রাজিবের ” বিকাল বেলার পাখি’ নাটকটি দেখে এতোই মুগ্ধ হয়েছি যে,আমাদের টিভি নাটকের পুরানো ঐতিহ্য ফিরে আসছে এই ভাবনায় ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম ।নাটকের গল্প আর গল্প বলার সাবলীল ধরনের জন্য আদনান কে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম , চিত্রগ্রাহক বন্ধু খসরুকেও ভালোবাসা জানাতে ভুলিনি । অনেকেই আমার পোস্টে লাইক,কমেন্টস করে নাটকটির ব্যাপারে তাদের পজেটিভ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন । আবার অনেকেও ভিন্ন ভিন্ন পোস্টেও আদনানের বিকাল বেলার পাখি নাটকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা করেছেন।
আমি যখন নাটকের পুরানো ঐতিহ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখে সাহস পেতে শুরু করেছি এমনি সময় ছোট ভাই জিয়ার ফোন । জিয়াউর রহমান যাকে বিজ্ঞাপন ইন্ড্রাস্ট্রিতে আমরা আর্ট ডিরেক্টর হিসাবেই চিনি । একবুক ভালোবাসা নিয়ে নাটকও বানান মাঝেমধ্যে । জিয়া ফোনে তার একটা পুরনো নাটক আমাকে ট্যাগ করার অনুমতি চায়। আমি সানন্দে অনুমতি দিলে সে নাটকটি একবার দেখার অনুরোধ করে।নাটকের নাম – নাগরিক।দুই বছর আগে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে ।নাটকটি দেখে আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠি।আদনানের “বিকাল বেলার পাখি” নাটকের ডুপ্লিকেট কপি-যেন জমজ ।কি গল্প, কি চিত্রনাট্য,কি চরিত্র সব একেবারে অবিকল । দুটি নাটকের চিত্রনাট্যের এই অবিকল সাযুজ্য কিভাবে সম্ভব ??
আসুন আমরা পুরো নাটকের মিলগুলো একটু লক্ষ্য করে আসি –
১। বিকাল বেলার পাখি নাটকের গল্প আবর্তিত হয়েছে বীমা কোম্পানীতে চাকুরী করা ট্রিপিক্যাল মধ্যবিত্ত ছাপোষা একব্যক্তি ও তার পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে। জিয়ার নাগরিক নাটকটির গল্প আগায় বীমা কোম্পানীর চাকুরে এক মধ্যবিত্ত ব্যক্তি আর তার পরিবারের টানাপোড়েন কে কেন্দ্র করে।প্লটের কি অদ্ভুত সাদৃশ্য তাইনা ?
২।বিকাল বেলার পাখি নাটকের প্রথম দিকেই প্রধান চরিত্র বাবু তার এক প্রতিবেশীকে ইনস্যুরেন্সের গুনাগুন বুঝিয়ে তাকে ইনস্যুরেন্স করতে উদ্বুদ্ধ করে ঠিক তেমনি নাগরিক নাটকেও একই দৃশ্য আমরা দেখতে পাই । এখানে ডায়লগ ও প্রায় হুবহু এক।
৩। বিকাল বেলার পাখি নাটকে একটি দৃশ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র বাবু পরিচিত একজনের অফিসে বীমা করা প্রস্তাব নিয়ে যাবার সময় আম নিয়ে যায় আর জিয়ার নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্র রিয়াজ চকোলেট নিয়ে যায় । এই দৃশ্যেও তাদের ডায়ালগ দৃষ্টিকটু রকমের সাদৃশ্য রয়েছে।
৪। বিকাল বেলার পাখি নাটকে আদনান কেন্দ্রীয় চরিত্র বাবু ভাইয়ের দুই সন্তানের ডায়ালগ দিয়ে সংসারের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা উপস্থাপিত করেছেন আর নাগরিক নাটকে প্রায় সেই একই সিচ্যুয়েশন আমরা দেখতে পাই রিয়াজ আর মৌটুসীর মধ্যের কথোপকথনে।
৫। বিকাল বেলার পাখি নাটকে বাবু তার মেয়ের বিয়ের জন্য তার শেষ সম্বল এফডিয়ার এর টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে বাধ্য হন আর নাগরিক নাটকে রিয়াজকে ছেলের স্কুলের জুতা কেনার জন্য মোবাইল, প্রিয় ঘড়ি বিক্রি করে দিতে দেখি আমরা।পরিস্থিতির কি অদ্ভুত রকমের সাদৃশ্য ।
৬। বিকাল বেলার পাখি নাটকে বাবু ভাইয়ের তলা এফডিয়ারের টাকার ব্যাগ চুরি হয়ে যায়। আর নাগরিক নাটকে রিয়াজের পিকপকেটের ঘটনা ঘটে।একজন ব্যাগ চুরি দিয়ে নাটকের প্রধান চরিত্রকে যে সংকটের মুখোমুখি করেছেন আরেকজন পিকপকেট দিয়ে। সিম্পলই এধার কা মাল ওধার ।
এমনি অসংখ্য সাদৃশ্য দুটি নাটকের চিত্রনাট্যের পরতে পরতে । দুই বছর আগে প্রচারিত একটা নাটকের সাথে চিত্রনাট্যের এমন সাদৃশ্য আমার কাছে কাকতালীয় বলে মনে হয়নি । আর চিত্রনাট্যে আদনানের নিজের নাম ব্যবহার দেখে টোটাল বিষয়ে খুব অসহায় বোধ হতে থাকে । জিয়া আমাকে যখন জানায় তার নাটকটির ইউটিউব লিঙ্কে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা তখন আমার আর বুঝতে বাকী থাকে যে এটা একটা খুবই পরিকল্পিত চুরি ।
আদনান খুব গুনী একজন নির্মাতা । এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সিধেল চুরির সাথে তার নাম যুক্ত হওয়া আমাদের টিভি নাটকের জন্য খুব দুঃখজনক ও হতাশাজনক ঘটনা।ইতিমধ্যেই আদনানের বিকাল বেলার পাখি নাটকটি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছে ।মেরিল প্রথম আলো জুরি বোর্ড নিশ্চয়ই ছিনতাই করা চিত্রনাট্যের নাটকটির ব্যাপারে সুনির্দিস্ট তথ্য উপাত্ত পরখ করে তারপরে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
জিয়ার নাগরিক নাটকটি মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিলো । সে হিশাবে নাগরিক নাটকটির মুল সত্ত্ব মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের। তাদের এমন একটি কন্টেন্ট কিভাবে অন্য টিভি প্রচার করে সে বিষয়ে মাছরাঙ্গা তাদের অবস্থান পরিস্কার করবেন বলেও আশা করছি । নাহলে গল্প চুরির এই ভয়াবহ আগ্রাসন আমাদের নাজুক টিভি নাটককে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড়াবে যেখান থেকে আর ফিরে আসার কোন উপায় থাকবে না । কমেন্টে আমি বিকাল বেলার পাখি আর জিয়ার নাগরিক নাটকটির লিঙ্ক দিয়ে দিলাম । আপ্নারাও নাটক দুটি দেখে আপনাদের অবস্থান জানান ।
আদনান আল রাজীব :
যদিও এই বিষয়ে আমার কথা বলার ইচ্ছা ছিলো না, তবুও রেকর্ডের জন্য বলে রাখছি। একটি পত্রিকায় “বিকাল বেলার পাখি”র গল্প নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট প্রসঙ্গে লিখছি
প্রথমত আমার গল্পের এতটা দৈন্যতা তৈরী হয় নাই যে জেনেশুনে কারো প্রচারিত গল্প দেখে আমার গল্প বানাতে হবে। কিছু কিছু জনরার গল্পে কিছু কমন সাদৃশ্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর সব প্রেমের গল্পেই যেমন প্রেমিক প্রেমিকা থাকবে, মনোমলিন্য থাকবে, মিলন বিরহ থাকবে, তেমনী আমাদের মধ্যবিত্ত কমনজীবনের গল্পগুলোতেও একই রকম ক্রাইসিস হাসি কান্না বিরহ থাকবে। জিয়া সাহেবের নাটকটা আমার দেখা হয়ে ওঠে নাই, আমার নাটকের পরেও যদি উনারটা অন এয়ার যেত আমি আমার গল্প বলে অভিযোগ করার মত গাধামী করতাম না। ব্যাপারটা নিয়ে একদমই কথা বলার ইচ্ছা না থাকলেও হাস্যকর কয়েকটি পয়েন্টে দৃষ্টি আটকালো :
১. বীমা কোম্পানীতে জব করে এরকম চরিত্র নিয়ে নাটক হয়ে গেছে বলে আর কেউ এই চরিত্র নিয়ে কাজ করতে পারবে না? এই চরিত্রের আজীবন কপিরাইট কে কিনলো? তারমানে ডাক্তার উকিল এই চরিত্র গুলো বারবার আমরা টিভিতে দেখি সবই নকল ?
২. স্বয়ং স্পিলবার্গও যদি টানাপোড়েনওয়ালা একজন বীমা এজেন্টের জীবন নিয়ে সিকোয়েন্স বানাতো, কোন হবু কাস্টমারের সাথে । তাহলে তারা কি ইনসুরেন্স নিয়ে কথা না বলে কসমোলজি নিয়ে কথা বলতো?
৩. বিকাল বেলার পাখি’র গল্পের প্লট, ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে বীমা’র গল্প বলা হয় নাই এখানে ডিল করা হয়েছে বাবা সন্তানের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প।
যাই হোক এখানে ইনস্যুরেন্সে চাকরীরত মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প নিয়ে আগেও অনেক নাটক হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে তাই বলে কোন ইনস্যরেন্স কোম্পানী সকল গল্পের কপিরাইট নিয়ে নেয় নাই এইটুকু একটা বাচ্চাও বোঝে। সংস্কৃতির চর্চ্চা সবসময়ই উন্মুক্ত থাকবে যুগযুগ ধরে, কারো কেনা সম্পত্তি হয়ে গেলে তো মুসকিল। আগ্রহীরা দুটি নাটকই দেখতে পারেন। দুটি কাজই ভালো লাগলে তো আমাদের দেশের জন্যই ভালো।
ভালো থাকবেন সবাই!
বিকাল বেলার পাখি
নাগরিক