Select Page

সঙ্গীতের মূর্ছনায় জীবনের গল্প

সঙ্গীতের মূর্ছনায় জীবনের গল্প

সময়ের পরিবর্তনের সাথে চলচ্চিত্রে নতুন স্বাদের কাজ দরকার হয়। একদম পুরোদমে বাণিজ্যিক ছবির একটা চাহিদা তো আছেই আবার গল্প বলা শান্ত, সুন্দর ছবিরও আলাদা অবস্থান আছে। নতুন ধরণের স্বাদে পুরনো ফরম্যাটেই নির্মিত হলো বছরের শেষের দিকের মিউজিক্যাল ফিল্ম ‘গহীনের গান।’

সাদাত হোসাইনের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে ‘গহীনের গান।’ ট্যাগলাইন ‘song of the soul’ মানানসই। সাদাত হোসাইনের নামটি এ প্রজন্মের কাছে পরিচিত তাঁর লেখালেখির সূত্রে। নিজের চিত্রনাট্যে ও পরিচালনায় প্রথমবার মিউজিক্যাল ফিল্মের মতো কাজ করা সাহসেরই বলা যায়। তিনি কাজটা মানসম্মতভাবেই করেছেন। ভালো মানের ফিল্ম বলতে যা বোঝায় ‘গহীনের গান’-এ তা আছে।

কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের প্রথম অভিনীত কোনো ফিল্ম এটি। তার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। ফিল্মের অন্যতম প্রধান চরিত্রে তাকে দেখা গেছে।

ডিটেইলে যাবার আগে মিউজিক্যাল ফিল্ম নিয়ে দুটো কথা বলা জরুরি। কেউ কেউ দাবি করছে ‘গহীনের গান’ প্রথম কোনো মিউজিক্যাল ফিল্ম। কিন্তু না এটা ভুল ধারণা। গানে গানে গল্প বলে যাওয়া চলচ্চিত্র এর আগেও হয়েছে। ‘রূপবান, বেদের মেয়ে জোসনা, ঝিনুক মালা’-র মতো ছবিতে গানে গানে গল্প বলা আছে কিংবা ‘মমতাজ’ ছবিতেও। ‘গহীনের গান’-কে বরং ডিজিটাল ফরম্যাটের প্রথম মিউজিক্যাল ফিল্ম বলা যেতে পারে।

‘গহীনের গান’ নামটাই গভীরতা তুলে ধরে। ছবি এগিয়ে যাওয়াটা সাদামাটা হলেও স্টোরি টেলিং-এ একটা ‘poetic presentation’ আছে। সাহিত্যের মানুষ সাদাত তাঁর কাজের মধ্যে সিগনেচার রাখার জন্যই এটা করেছেন সহজেই বোঝা যায়। একটা গল্প থেকে আরেকটা গল্পে যাওয়া হয়েছে কাব্যিকভাবে এমনকি অভিনয়শিল্পীদের সংলাপ বিনিময়ও হয়েছে কাব্যিকভাবে। ছোট পরিসরে সবগুলো গল্প বলা হয়েছে দীর্ঘ কোনো অংশে না গিয়ে।

আসিফ-তানজিকা থেকে গল্প শুরু। তাদের মান-অভিমানের পর্ব থেকে জীবন সম্পর্কে কিছু বাক্য বিনিময় চলতে থাকে। তারপর বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা একজন বৃদ্ধকে দেখার পর তাদের জীবন থেকেই উদাহরণ হিসেবে অন্যদের জীবনের গল্প বলা শুরু হয়। সে গল্পগুলো মূলত পাওয়া-না পাওয়ার জীবনবোধে তাদেরকেই তুলে ধরতে সাহায্য করে। একটা ইন্টার-কানেকশন অনুযায়ী গল্প চলতে থাকে। দর্শক মনোযোগ ধরে রাখলে কানেক্ট করতে পারবে। সব মিলিয়ে তিনজোড়া গল্পকে দর্শক উপভোগ করবে এবং একটা গল্প থাকে একের ভেতর দুই।

১.
– তোমার কাছে আমি কি?
– তুমি গল্প
– জীবন কি?
– জীবনও একটা গল্প
– আমি কি তোমার প্রয়োজন তাহলে?
– তুমি প্রয়োজন হবে কেন?
– তাহলে আমি কি?
– তুমি প্রিয়জন


২.
– নিজেকে পড়তে পারো?
– নিজেকে পড়তে পারা সবচেয়ে কঠিন
– কখনো পড়তে চাওনি?
– না, হয়তো দায়িত্ব বেড়ে যাবার ভয়ে
– আমরা সবাই চাই অন্যজন আমাকে বুঝুক। আমরা স্বার্থপর ও একা।
– আমরা আসলে মুক্ত হয়েও বন্দি
৩.
– আমি আর তোমাকে সহ্য করতে পারছি না
– আমাকে সহ্য না করে যাবে কোথায়?
– দূরে চলে যাবো
– কতটা দূরে?
– যতটা দূরে গেলে ভালো থাকা যায়
কাব্যিক সংলাপ বিনিময়।
৪.
– মেয়েরা আঁকড়ে ধরতে চায়
– আর ছেলেরা?
– ছেলেরা আঁকড়ে ধরতে স্থির থাকতে চায় না
– মানুষ কখন নিজের ভুল দেখতে পারে না জানো?
– কখন?
– না পাওয়াটাকে না বোঝা। না পাওয়া বা অপ্রাপ্তির মাঝেই একটা ভালোবাসা অপেক্ষা করে। না পাওয়াতে চাওয়া বেশি থাকে।
৫.
– তোমার কি মনে হয় সবাই চলে যায়?
– যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে থেকে কি লাভ
– তাহলে ভালোবাসা বোঝা যায় না?
– ভালোবাসা এত কঠিন না যে বোঝা যাবে না। ভালোবাসাকে ভালোবাসার মতো করে বুঝলেই হয়।
৬.
– বিষয়টা খুব অদ্ভুত আমরা কেউই ফেসবুক ব্যবহার করি না
– অনেকেই তো করে না
– তাদের সংখ্যাটা খুব কম
– যা কম তাই তো ভালো
– বেশি কি ভালো হতে পারে না?
– কখনো কখনো হয় তবে বেশির মধ্যে ভালোটা কম থাকতে পারে
সংলাপ বিনিময় পুরো ফিল্মে বিভিন্ন চরিত্রের মুখ থেকে এভাবেই আছে। হেয়ালী লাগবে শুনতে কিন্তু গভীরতা, কাব্যিকতা, জীবনবোধ আছে। সাহিত্য ভালো লাগা লোকদের বেশি স্পর্শ করবে অন্যদেরও করতে পারে যদি কাব্যিকতায় আগ্রহ থাকে।
এর সাথে আরো কিছু সিঙ্গেল ডায়লগ মনে রাখার মতো –
* শিল্পীদের সাথে প্রেম করতে নেই। তাদের কথা যেন গোছানো থাকে কখন কি বলতে হবে। যাতে রাগটা জল হয়ে যায়।
* জগতের সকল গল্পই তো ঐ একইরকম। ভালোবাসার বা ঘৃণার।
* পৃথিবীর গল্পগুলো হারানোর গল্প, ভালোবাসার নয়। সবাই শুধু ছুঁয়ে দিতে চায়, ধরে রাখতে চায় না।
* পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাই অথচ একে অন্যের হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাই না। আমাদের হৃদয়ে রয়ে যায় গহীন গান।

ছবিতে তারুণ্য ও বার্ধক্যের দূরত্ব দেখানো হয়েছে। সৈয়দ হাসান ইমামের সংলাপে-‘কারো কি কেউ থাকে? আমরা নিজেই নিজেদের থাকি। তারুণ্যের অনন্ত সম্ভাবনা থাকে কিন্তু বার্ধক্যের থাকে অনন্ত অবসর। বার্ধক্য তারুণ্য পেরিয়ে এসেছে বলেই সে তারুণ্যকে বোঝে। সব মানুষের জন্য কেউ না কেউ অপেক্ষা করে আর আমার জন্য অপেক্ষা করে বন্ধ দরজার তালা। বৃদ্ধ হলে বন্ধ দরজার তালা খুলে দেখতে হয় একটা মানুষ কতটা অপ্রয়োজনীয়।’ মানুষ শেষ বয়সে পৌঁছে গেলে নিজের ভেতর একা হয়ে যায় কাছের মানুষের অবহেলায় এটা সবসময়ই সত্য এমনকি আজকের সময়ে অনেক বেশি সত্য। ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ডম্যান’ সিনেমার কথা ভাবলে তো একবারেই বোঝা যায়। ‘গহীনের গান’-এর সবচেয়ে টাচি অংশ এটাই ছিল। সাথে এ গানটা-
‘ও বাবা তোকেই দরকার
ওষুধ খেলে কাজ হবে না একটু একটু পর
ও বাবা আমার হাতটা একটু ধর
বুড়ো মানুষ গায়ে ভীষণ জ্বর।’
বৃদ্ধের গল্পটির ভেতর আরো একটি গল্প আছে।

বাসের সামনের সিটের মেয়েটির চুল উড়ছে আর পেছনে বসা ছেলেটি প্রথমত অস্বস্তি বোধ করছে পরে সে চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। খুবই রোমান্টিক ছিল তৃতীয় গল্পের শুরুটা। তমা মির্জা ও আমান রেজা এ গল্পের অভিনয়শিল্পী। এ গল্পের শেষটা উহ্য থাক।

সিনেমাটোগ্রাফি প্রশংসনীয়। শহুরে জীবনেও বৃষ্টিকে সৌন্দর্যের সাথে ক্যামেরাবন্দী করার দক্ষতা দেখিয়েছেন নির্মাতা। ‘এমনো বরষায়’ গানের কিছু শট ক্রিয়েটিভ ছিল। তানজিকার অভিমান ভাঙাতে আসিফের আলগা দাঁত চায়ের মধ্যে খসে পড়ার শটটা ইন্টারেস্টিং ছিল।

মিউজিক্যাল ফিল্মে গানে গানে স্টোরি টেলিং থাকবে তাই গান সংখ্যায় অনেক। প্রত্যেকটা গানই ভালো লাগার। কথা, সুর, গায়কী দারুণ। আসিফ সুন্দর গেয়েছে।
‘তোমাদের শহরে’ গানটি দারুণ প্রতীকী ছিল। আসিফ চেয়ারে বসা বাঁধা অবস্থায়। তানজিকা জানালার ওপাশে। জানালাটা বন্দির প্রতীক হয়ে গেছে। খাঁচার ভেতরে বাইরে দুটি পায়রা। মুক্ত হয়েও যেন বন্দি দুজন। ‘এমনো বরষায়’ গানটি নির্মাণে এগিয়ে থাকবে। গানটিতে বৃষ্টিতে খালি দুটি কাপ প্রথমে দেখা গেল তারপর বৃষ্টি পড়ে কাপ অর্ধেক জলে ভরে গেছে। দারুণ ছিল শটগুলো। শূন্যতার পর আবার পূর্ণতার স্বপ্ন দেখানোর অর্থ প্রকাশ করে দৃশ্যগুলো। বাকি গানগুলোও সিচুয়েশনের সাথে পারফেক্ট।

ছবির নেগেটিভ দিক চরিত্র তৈরি, গল্প বলাতে নেই বলা যায়। অভিনয়ের জায়গায় আসিফকে প্রথমদিকে কিছুটা ন্যাচারাল লাগলেও আস্তে আস্তে একটা আনইজি ব্যাপার লক্ষ করা গেছে। তানজিকা চমৎকার ছিল। বলতে গেলে তানজিকার বিপরীতে অভিনয় করতে আসিফকে চেষ্টাই করতে হয়েছে। সৈয়দ হাসান ইমাম অসাধারণ। প্রশংসনীয় অভিনয় তমা মির্জার। এখনকার বেশি সুযোগ পাওয়া নায়িকাদের চেয়ে তার অভিনয় অনেক বেটার। আমান রেজা, আসিফ আজিম চলনসই।

‘গহীনের গান’ মানসম্মত ডিজিটাল মিউজিক্যাল ফিল্ম। সাদাত হোসাইনের ফিল্মমেকিং-এর সম্ভাবনা দেখানো কাজ এটা। তার সাথে বাস্তবতা মানতে হবে এ ধরণের ফিল্ম সব দর্শকের ভালো লাগবে না। বিরক্ত হয়ে সিনেমাহল থেকে চলেও যেতে পারে দর্শক আবার ব্যতিক্রম কাজ দেখতে পছন্দ করা দর্শকের ভালো লাগবে। এর ভেতর দিয়েই কাজ করে যেতে হবে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্টের জন্য। আরো হোক এরকম কাজ।

রেটিং – ৭/১০


Leave a reply