রাজত্ব
মাঝে মাঝে খুব মন চায় বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে রিভিউ লিখে নিজের দেশপ্রেম জাহির করতে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বিচার বিবেচনা করে দেখি আমি তো হাজার টাকা খরচ করে সিনেপ্লেক্সে যেয়ে পিঁপড়াবিদ্যা সিনেমা দেখার মত বোদ্ধা কোন দর্শক নই। আমি তো এখনও সেই বস্তা পঁচা হলে বসে বি-গ্রেডের সিনেমা দেখার দর্শক রয়ে গেছি। আমার লেখা রিভিউ কেন কোন পাঠক খাবে !
আমার বউ আমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। আমি নাকি হাফ-লেডিস নায়ক শাকিব খানের একজন ভক্ত। অবশ্য এর যথাযথ কারণও রয়েছে। আমি বেছে বেছে শাকিব খানের সিনেমা দেখি। আমার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে কয়েক গিগা বাইট মেমোরী জুড়ে রয়েছে শাকিব খানের সিনেমার গানের ভিডিওর বিশাল এক সংগ্রহশালা। সেই হিসাবে আমি অবশ্যই শাকিব খানের একজন অন্ধ ভক্ত। আমিও আমার বউকে বলে দিয়েছি, “হ ! আমি শাকিব খানের মস্ত বড় ফ্যান। তোমার কুন সমস্যা?”
তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি, তাই বলে আমাকে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ভেবে আবেগে কাইন্দা লাওনের মত কোন বিষয় নেই। এইত দুদিন আগেই বউ বলল যে আমার ব্যবহৃত আফটার শেভটা নাকি শেষ হয়ে এসেছে। তাই নতুন একটা কেনার জন্য হাতের মুঠোয় পাঁচশত টাকার একটা নোট গুঁজে দিল। আমিও সুবোধ বালকের মত কালবিলম্ব না করে বউয়ের কথা মত শপিং মলে চলে গেলাম। হাতের কাছে সেলফে রাখা কিউট আফটার শেভ পেয়েও কিনে আনলাম প্রাণ প্রিয় ওল্ড স্পাইস। যেন গালে মাখলেই একটা দারুণ স্পাইসি তীব্রতা অনুভব করা যায়। লোকে বলে গ্লোবালাইজেশনের যুগে নাকি বিশ টাকার এসএমসির সেনসেশনের চেয়ে শত খানেক টাকার ডিউরেক্স কেনা জায়েজ আছে। কিন্তু লোকে বোঝেনা যে স্ট্রবেরী ফ্লেভারের কতটা মূল্য আছে। আমি বলি কি ওহে পাকিজা গার্ডেন প্রিন্ট, জনি প্রিন্ট আর প্রাইডের বাংলাদেশী শাড়ি, তোমরা বরং তোমাদের শাড়ির নাম রাখো হুরমতি। আমি কিনে ধন্য হই। আমাকেও কেউ কান কাটা রমজান হিসেবে স্মরণ করুক।
যাই হোক, ফিরে আসি শাকিব খানের কথায়। মূলত শাকিব খান নিয়ে আলোচনা করা আমার মূল বিষয়বস্তু নয় এখানে। আমার দেখা শাকিব খান অভিনীত রাজত্ব সিনেমাটি নিয়ে একটি রিভিউ লেখাই মূল উদ্দেশ্য। তবে কেউ সিনেমাটির ডাউনলোড লিংক চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না। কারণ বহুকষ্টে টিকেট কালোবাজারীদের চোখে ধুলো দিয়ে সম্পূর্ণ এনালগ হলের ডিসিতে বসে সিনেমাটি দেখতে হয় আমাকে।
সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্থ পুলিশ আর নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের অনৈতিক রাজত্বের বাস্তব চিত্র নিয়ে নির্মিত রাজত্ব সিনেমায় শাকিব খানকে দেখা যায় একজন চাঁদাবাজ হিসেবে। মৃত স্বামীর ভিটা ছেড়ে আসতে না চাওয়া একজন মা গ্রামে থেকে জানে যে তার সুপুত্র শহরে একজন বড় দারোগা হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে ছেলে যে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে টেন পার্সেন্ট সম্রাট নামে সেই ভুল মার ভাঙতে কিছুটা সময় লেগে যায়।
ছেলের বিবাহের লায়েক হয়েছে। তাই মা গ্রামের এক মেয়েও দেখে রাখে। এরই মাঝে ছেলের ডাক আসে মায়ের কাছ থেকে গ্রামে যাওয়ার। শাকিব খান মেয়ে দেখতে গ্রামে যায় তার বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি স্বরূপ হোন্ডায় চড়ে। এই হোন্ডার পুরো ছবিতে একটা ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। ফেরার পথে রাত হয়ে যায়। তারসাথে মহা এক বিড়ম্বনা, মাঝপথে হোন্ডা বিকল হয়ে যাওয়াতে শাকিব খান অগ্যতা বাধ্য হয় একটি অচেনা বাড়িতে প্রাণ প্রিয় হোন্ডাটিকে তার আশ্রয় দেয়ার জন্য। বাড়ির দরজা খুলতেই শাকিব খান বিমোহিত হয়ে যায় নায়িকা ববিকে দেখে।
পরে যখন হোন্ডা ফেরত নেয়ার জন্য সে বাড়িতে যায় ততক্ষণে তার মধ্যে গ্রামের সেই মেয়েকে ভুলে গিয়ে নায়িকা ববিকে বিয়ের কথা মাথায় আসে তার। এরই মাঝে বিয়ের প্রস্তুতীও নিয়ে ফেলে। কিন্তু গিয়ে দেখে রীতিমত তার বাবার সেই হোন্ডা খানা গায়েব। এবং ববি ও ববির বাবা জনাব প্রবীর মিত্র সাহেব দিব্যি অস্বীকার করে যাচ্ছে হোন্ডা সম্পর্কে। শাকিব খান তাদের হোন্ডা চোর হিসেবে থানায় গিয়ে মামলা ঠুকে দেয়। কিন্তু শেষে উল্টো তাকেই অপমানিত হতে হয়। শুরু হয় হোন্ডা খোঁজার মিশন। নানারকম নাটকীয়তার মাঝে হোন্ডা ফিরে পাওয়া যখন দুষ্কর হয়ে ওঠে তখনই সিনেমা টার্ন নেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে।
তবে এরই মাঝে চলতে থাকে নায়িকা ববির মন জয়ের চেষ্টা। কিন্তু ববি মনে মনে শাকিব খানকে তার মন দিয়ে ফেললেও কী এক অজানা কারণে যেন শাকিব খানকে দেখলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। এরই মাঝে চলতে থাকে সিনেমার গানগুলো। সংগীত পরিচালক অদিতের সুর করা চমৎকার শ্রুতিমধুর সব গানের চিত্রায়নেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কিন্তু সমস্যা একটাই। কোন গানই যথাযথ দৃশ্য অনুযায়ী প্রদর্শিত হয়নি। ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী কোন গানই ডিমান্ড করেনা বলা যেতে পারে। তবে গানগুলো খুব এক্সক্লুসিভ হয়েছে। বারবার শোনার মতই গান হয়েছে এক একটা।
যাই হোক এক পর্যায় টুইস্ট ভাঙে পুরো সিনেমার। দেখা যায় এক ক্ষমতাধর নেতার মদ্যপ পুত্র ববির ছোট বোনকে ধর্ষণ করে এবং শাকিব খানের হোন্ডাটি সাথে করে নিয়ে যায়। এই দেশে এখনও যে একজন ধর্ষিতা নিগৃহীত, অধিকার বঞ্চিত, আইনের পেটিকোটের ফাঁকে বিচার বহির্ভূত, ধর্ষিতার পরিবারকে যে কতটা ব্যাঞ্জনার শিকার হতে হয়, সেটা খুব চমৎকার ভাবেই সিনেমার বিরতীর পর থেকে চিত্রায়িত হয়েছে। শাকিব খান যখন পুরো ঘটনা জানতে পারে শুরু হয় ববির বোনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মিশন ইম্পসিবল। সিনেমার এই পর্যায় টেন পার্সেন্ট সম্রাট টেন পার্সেন্ট চাঁদাবাজি ভুলে গিয়ে শুরু করে সমাজের মানুষরূপী কীটদের রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থ ধারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে।
একজন ধর্ষিতার মত পুরো দেশ যেমন ধর্ষণের রাজত্বে বন্দী তখন দরকার এমন একজন সাহসী টেন পার্সেন্ট যুবকের। যার হাত ধরে দেশ হবে অন্যায় অবিচারের রাজত্ব মুক্ত একটি সুন্দর রাজত্বের দেশে। মূলত পরিচালক ইফতেখার চৌধুরী তার রাজত্ব সিনেমাটিতে এই ম্যাসেজটিই দিতে চেয়েছেন।
আমি আগেই বলেছি আমি কোন বোদ্ধা দর্শক নই। কিন্তু সিনেমা বলতে এখনও বি-গ্রেডের সিনেমার জন্য অপেক্ষা করি। আমার আবার ইম্প্রেসের ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার কিংবা টেলিভিশন জাতীয় সিনেমা ঠিক হজম হয়না। আমার তখন প্রয়োজন হয় সজীবের ইসুবগুল ভুষি। আমার আবার ইনোটেও কাজ হয়না। যার ফরমালিন যুক্ত খাবার খেয়ে অভ্যাস তার কি আর সহজে ইনোতে কাজ হবে ? হবেনা। তাই আমি রাজত্ব দেখেই মহাখুশি। মনে মনে ভাবি যাক! এখনও দাঙ্গা কিংবা তেজীর মত সিনেমা বানানো সম্ভব এই দেশে।