অদ্ভুত, অসাধারণ, অবিশ্বাস্য ‘হাওয়া’
হাওয়া’র কাজ চলাকালীন ছবিটির কনসেপ্ট সম্পর্কে জেনে এবং ছবির স্টিল ফটো দেখে আমি খুবই এক্সাইটেড ছিলাম বড়পর্দায় দেখার জন্য। এরপর ছবির পোস্টার, ট্রেলার, গান দেখে সেই আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিলো বহুগুণ। কিন্তু পর্দায় আমি যা দেখেছি তা সকল প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে।
আমি কল্পনাও করিনি যে, বাংলাদেশের কোন নির্মাতা এমন সিনেম্যাটিক ম্যাজিক ক্রিয়েট করতে পারবে। পর্দায় আমি কোন সিনেমা দেখেনি; বরং দেখেছি একজন ক্রেজি নির্মাতার অ্যামবিশন। হতদরিদ্র বাংলা সিনেমাকে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন মেজবাউর রহমান সুমন তার এই ‘হাওয়া’ সিনেমাটির মাধ্যমে।
‘হাওয়া’ বাংলাদেশের সিনেমাকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে সেখান থেকে বাংলা সিনেমা যেন নতুন পরিচয় পেয়েছে। যারা সিনেমা বিষয়টা বোঝেন এবং সিনেমা নিয়ে নিয়মিত চর্চা করেন তারা খুব ভালোভাবে বুঝবেন যে, ‘হাওয়া’র মতো সিনেমা যুগে যুগে একবার আসে এবং সিনেমায় নতুন স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেয়।
হাওয়ায় কী আছে!
‘হাওয়া’ মেজবাউর রহমান সুমনের একটা পাগলামী!
গভীর সমুদ্রে একটি মাছ ধরা ট্রলারে আটকা পড়া একদল জেলে এবং এক রহস্যময়ী তরুণীর গল্প। নির্মাতা মাইথোলজি, বাস্তবতা, পরাবাস্তববাদের মিশেলে এর গল্প তৈরি করেছেন।
একটি মাছ ধরা ট্রলারে একদল মাঝি তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, হাসি-ঠাট্টা কিংবা নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বে যখন মগ্ন তখন তাদের জালে এক তরুণীর লাশ উঠে আসে। এরপর এক সময় সেই তরুণী জীবন্ত হয়ে ওঠে। গভীর সমুদ্রে একটি মাছ ধরা ট্রলারে একদল পুরুষের মাঝে এক রহস্যময়ী সুন্দরী তরুণী আশ্রয় নিলে গল্পে নতুন মোড় আসে। নির্মাতা এরপর যা দেখিয়েছেন তা কোন বাস্তবতার গল্প নয়। বাস্তবতার সাথে মাইথোলজি আর পরাবাস্তববাদ মিলে এক অদ্ভুত গল্প পর্দায় দেখিয়েছেন তিনি। হয়তো কারো কারো কাছে এই গল্প দুর্বোধ্য ঠেকবে। আমারও মনে হয়েছিলো যে, নির্মাতা গল্পটাকে শুধু বাস্তবসম্মতভাবে পর্দায় তুলে ধরলেই বোধহয় পারফেক্ট হতো। কিন্তু কাল থেকে এখন পর্যন্ত ছবিটার রেশ মাথা থেকে যাচ্ছে না। ছবিটা নিয়েই শুধু ভাবছি। বিশেষ করে গল্পটা নিয়ে।
আসলে স্ট্রেইট বাস্তবতার গল্প তো অনেক দেখেছি। কিন্তু এভাবে মাইথোলজি আর পরাবাস্তববাদের সাথে সমাজ-বাস্তবতাকে তুলে ধরতে তো আগে কখনো দেখিনি! যত ভাবছি ততো যেন মুগ্ধ হচ্ছি।
যত ছবিটা নিয়ে ভাবছি ততো যেন ছবিটা আবার দেখতে ইচ্ছে করছে!
মেজবাউর রহমান সুমন আমাদের সরল চিন্তায় ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি আমাদের অভ্যস্ততা ভেঙে দিতে চেষ্টা করেছেন।
একজন ভালো নির্মাতা এটাই করবেন। ভালো নির্মাতার কাজ দর্শকদের পছন্দমতো ছবি তৈরি করা না; বরং তার কাজ দর্শকদের সরল চিন্তায় ধাক্কা দেয়া। তার কাজ দর্শকদের অভ্যস্ততা থেকে বের করে নিয়ে আসা। এভাবেই তো দর্শকের চিন্তা-ভাবনার উন্নয়ন হয়। দর্শক হিসেবে তার ম্যাচিউরিটি তখনই আসে যখন সে তার অভ্যস্ততা থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
মেজবাউর রহমান সুমন এই একটি সিনেমা দিয়েই আমার চোখে বাংলাদেশের এই সময়ের সেরা নির্মাতা হয়ে গেলেন। তার মতো নির্মাতা বাংলাদেশে যুগে যুগে এক-দুইজনও পেয়েছি কি-না সন্দেহ। তার মতো নির্মাতা নিয়মিত সিনেমা বানালে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যে কেউ বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে পারবে।
ছবির গল্প অনুযায়ী ছবির প্রধান চরিত্র গুলতি-রূপী নাজিফা তুষি এবং ট্রলারের প্রধান মাঝি চঞ্চল চৌধুরী। চঞ্চল চৌধুরী ছবিতে সবচেয়ে বেশি স্পেস পেয়েছেন এবং তার অভিনয় ছিলো দুর্দান্ত। আসলে তিনি এ ছবিতে তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় দেখিয়েছেন বললেও ভুল হবে না।
নাজিফা তুষি গল্পের সবচেয়ে প্রধান চরিত্র হলেও পর্দা উপস্থিতিতে চঞ্চলের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্পেস পেয়েছেন। এ ধরনের একটা চরিত্র যে কোন নায়িকার জন্য স্বপ্নের চরিত্র। নাজিফা তুষি একটু দেরিতে হলেও তার প্রতিভার মূল্যায়ন পেয়েছেন বলা যায়। এ ছবিতে এক বেদেনী মেয়ের চরিত্র তার লুক এবং অভিনয় ছিলো মন্ত্রমুগ্ধকর। তুষি যখনই পর্দায় এসেছেন- ছবি অন্য লেভেলে চলে গেছে। এই ছবির জন্য তুষিকে যদি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কিংবা মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার না দেয়া হয় তাহলে বরং এসব পুরস্কারের প্রতিই আমার করুণা হবে।
সময়ের আলোচিত অভিনেতা শরিফুল রাজ তুলনামূলক স্পেস কম পেয়েছেন। তবে এই কম স্পেসেই তিনি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরমেন্স দিয়েছেন। একদম চরিত্রের সাথে মিশে গেছেন যেন!
নাসির উদ্দিন খান ‘পরাণ’ ছবির পর আরো একবার দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন তার স্বভাবসুলভ অভিনয় দিয়ে। আর সুমন আনোয়ারসহ আরো যারা ছিলেন সবাই চরিত্রের সাথে মিশে গেছেন।
ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিলো খুবই খুবই সুন্দর। আর ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটা অন্য রকম আমেজ তৈরি করেছে।
তবে, এখনো আমি মনে করি, ছবিটির সেকন্ড হাফ আরেকটু ইন্টারেস্টিং কিংবা ক্রিস্পি হলে ছবিটা একদম পারফেক্ট ৫* পেতো। সেকেন্ড হাফে কিছু কিছু বিষয় একটু একঘেয়ে লেগেছে। ক্লাইম্যাক্স আর এন্ডিং দারুণ ছিলো বলে ঐটুকু একঘেয়েমি সয়ে নিয়েছি।
গল্পের ঐ একঘেয়েমিটুকু বাদ দিলে ‘হাওয়া’ যেমন আর্টিস্টিক জেম, তেমনি ভীষণ উপভোগ্য সিনেমাও।
এমন সিনেমার স্বাদ আস্বাদন করার রুচি সবার হয়তো এখনো তৈরি হয়নি। তবে মেজবাউর রহমান সুমনের মতো নির্মাতাই যুগে যুগে এসে দর্শকদের রুচি পরিবর্তনে ভুমিকা রাখেন।
মেজবাউর রহমান সুমনদের কাছে তাই সিনেমাশিল্প সবসময়ই ঋণী থাকে, থাকবে।
এই মাতাল করা অদ্ভুত সুন্দর ‘হাওয়া’কে আমি দিবো – ৫ এ ৪.৫*