Select Page

অশান্তি: লুকিয়ে প্রথম সিনেমা দেখার অ্যাডভেঞ্চার

অশান্তি: লুকিয়ে প্রথম সিনেমা দেখার অ্যাডভেঞ্চার

সিনেমা হল থেকে বাহির হয়ে খেলার মাঠে গেলাম। ধুলো-বালিতে গড়াগড়ি খেয়ে বাসায় আসলাম। মা বাবা যাতে মনে করে আমি ফুটবল খেলে এসেছি…

১৯৮৬ সালের ১৭ মার্চ আমার জীবনের মধুময় একটি দিন। এইদিনে নূপুর সিনেমায় বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে জীবনের দ্বিতীয় সিনেমা দেখি। প্রথম সিনেমা দেখেছিলাম ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে, জলসা সিনেমায় ‘মা ও ছেলে’, ভাই-ভাবীর সাথে। আমার মা বাবার কড়া নিয়ম বড় হলে সিনেমা দেখবে, ছোটদের সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা নিষেধ। বড় হওয়া মানে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়া।

রেডিও বিজ্ঞাপন শুনে শুনে সিনেমা দেখার প্রবল ইচ্ছে মনে জাগতো। আমার বাসা থেকে একটু দূরে ছিলো নূপুর সিনেমা। আমি একদিন (১৭ মার্চ ১৯৮৬) স্কুল থেকে বাসায় আসি নূপুর সিনেমার সামনে দিয়ে। হলের সামনে ‘অশান্তি’ ছবির আকর্ষণীয় পোস্টার। পোস্টার দেখে লোভ সামলাতে পারিনি।

বাসায় এসে ভাত খেয়ে, পকেটে সাত টাকা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। এমনভাবে বের হলাম, যাতে মা মনে করে মাঠে ফুটবল খেলতে যাচ্ছি।

পাঁচ টাকা দিয়ে ফ্রন্ট ক্লাসের টিকেট নিলাম। ভয় উত্তেজনা মিলেমিশে মনের মাঝে অন্যরকম অনুভূতি।

বিকেল সাড়ে তিনটায় ছবি শুরু হলো। এজে মিন্টু পরিচালিত, শাবানা নিবেদিত ‘অশান্তি’, অভিনয়ে শাবানা, আলমগীর ও জসিম। মনে ভীষণ ভয় যদি আমার ভাইরা আমাকে দেখে ফেলে। আমার ভাইরাও সিনেমা দেখার পাগল ছিলো। তারা বড় ছিলো, তাই তাদের স্বাধীনতা ছিলো সিনেমা দেখার।

আনন্দ ছিলো সিনেমা দেখবো। ভয় আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার। অন্যরকন অনূভুতি, অন্যরকম ভালোলাগা। শব্দ দিয়ে সেই অনূভুতি প্রকাশ করার আমার যোগ্যতা নাই। কবিসাহিত্যিকরা পারে প্রকাশ করতে।

শাবানা ও প্রবীর মিত্র ভাইবোন। তারা গ্রামে থাকে। তাদের প্রতিবেশী আলমগীর মাকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। আলমগীর পুলিশ অফিসার হিসাবে সদ্য জয়েন্ট করেছে।

আলমগীর মাকে নিয়ে গ্রামে আসে বাবার কবর জিয়ারত করতে। গ্রামীণ বন্ধুর বোন শাবানার সাথে আলমগীরের প্রেম ছিলো। আলমগীরের মা মায়া হাজারিকা শাবানাকে পছন্দ করতো। কবর জিয়ারত করতে এসে পারিবারিকভাবে শাবানা-আলমগীরের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়।

কিছুদিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আলমগীর ও তার মা শহরে চলে যায়।

নারী পাচারকারীদের গডফাদার লম্পট আহমেদ শরীফ গ্রামে বাগানবাড়িতে আসে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। আহমেদ শরীফ শাবানাকে দেখার পর তুলে নিয়ে যায় বাগানবাড়িতে। প্রবীর মিত্র শাবানাকে বাঁচাতে গিয়ে আহমেদ শরীফের হাতে খুন হয়। ভাই প্রবীর মিত্র নিজের প্রাণ দিয়ে বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করে। আহমেদ শরীফ গ্রামবাসীর রোষানল থেকে বাঁচতে জিপে করে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পালিয়ে যায়।

গুণ্ডারা শাবানাকে তুলে নিয়েগেছে এই নিয়ে গ্রামের কিছু নারী-পুরুষ নোংরা রসালো আলাপআলোচনা করতে থাকে। তারা শাবানাকে নষ্টা মেয়ে হিসাবে চিহ্নিত করে।

আলমগীরের চাচী শহরে চিঠি লিখে জানায় শাবানা নষ্টা মেয়ে তাকে যেন পুত্রবধূ না করে। মায়া হাজারিকা মিথ্যা রটনা বিশ্বাস করে।

শাবানা শহরে আসে আলমগীরের ঢাকার বাড়িতে। মায়া হাজারিকা দুর্ব্যবহার করে শাবানাকে তাড়িয়ে দেয়। ঐদিকে আলমগীর গ্রামের বাড়িতে যায় শাবানাকে খুঁজতে। কেউ কারো সাথে দেখা হয় না। হবু শাশুড়ি মায়া হাজারিকার কাছ থেকে দূর্ব্যবহার পেয়ে শাবানা অচেনা শহরে রাতের অন্ধকারে হাঁটতে থাকে। নারী পাচারকারী চক্র শাবানাকে তুলে নিয়ে যায়। এই চক্রের সেকেন্ড বস আদিল। আদিলের প্রেমিকা ক্যাবার ড্যান্সার নূতন।

আদিল যখন শাবানাসহ বেশ কিছু নারীদের বিদেশিদের কাছে বিক্রি করছিলো তখন বিকল্প টেক্সি চালক জসিম সব মেয়েদের উদ্ধার করে।

এই প্রথম আমার জসিমের সিনেমা দেখা। জসিম যে দর্শকদের কাছে কতটা জনপ্রিয় তা তখন বুঝতে। জসিমের পর্দায় উপস্থিতির সাথে সাথে দর্শকেরা হাততালি দিয়ে পরিবেশ অন্যরকম হয়ে গেলো। আমার সামনের এক দর্শক (বয়স ২০ বছর হবে) আসন ছেড়ে নাচতে শুরু করলো জসিমকে দেখে। একজন বলে উঠলো, ‘শালা আদিল্ল্যা বুঝবি এবার জসিমের মাইর কারে কয়!’

জসিম শাবানাসহ সকল নারীদের আদিলের বন্দিদশা থেকে মুক্তি করে দিলো। শাবানার যাওয়ার কোথাও জায়গা ছিলো না। তাই জসিম শাবানাকে নিজের কাছে রেখে ড্রাইভিং ও আত্মরক্ষার কৌশল জুডো শিখালো।

জসিমের জুডো দেখে আমি অবাক! আমার জানা ছিলো না নায়ক কাম ভিলেন জসিম জুডো জানে। আমি বালক বয়সেই জুডোর সাথে পরিচিত।

আদিল তার প্রেমিকা নূতনকে বস আহমেদ শরীফের কাছে রেখে যায়। আদিল জানতো কেন রেখে যাচ্ছে, কিন্তু নূতন জানতো না। আহমেদ শরীফ নূতনকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিছানায় নিয়ে যায়। নূতন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আদিলকে খুন করবে এবং সুযোগ খুঁজতে থাকে।

আদিল আহত জসিমকে খুব মারধর করে, কারণ জসিমের জন্য আদিল নারী পাচার করতে পারেনি। আহত জসিমকে মারধর করে আরো আহত করে আদিল চলে যায়। শাবানা এসে জসিমের অবস্থা দেখে মুন লাইট ক্যাবারে যায় আদিলকে শাসাতে। আদিলের সাথে শাবানার ফাইটিংয়ের সময় নূতন আদিলকে খুন করতে চাইলে, আদিল নূতনকে খুন করে। খুনের দায় পড়ে শাবানার উপর।

থানায় পরিচয় হয় আলমগীরের সাথে। শাবানা মায়া হাজারিকার দূর্ব্যবহারের কথা বলে। আদালতে শাবানা নির্দোষ প্রমাণিত হয়, দোষী হয় আদিল।

শাবানার সাথে আলমগীরের বিয়ে হয়। স্বামী আলমগীর, শ্বাশুড়ি মায়া হাজারিকা, বিপদের বন্ধু ভাই জসিম। এই নিয়ে শাবানার জগত। একদিন স্বামী আলমগীরের বন্ধুর জন্মদিনে গিয়ে দেখে স্বামীর বন্ধু আর কেউ না, ভাইয়ের খুনি আহমেদ শরীফ। শুরু হয় প্রতিশোধের পালা…

টানটান গল্পের রঙিন সিনেমা, অসাধারণ গান সমৃদ্ধ ‘অশান্তি’ দেখে আমি নতুন শান্তি পেলাম। শাবানা, আলমগীর, জসিম, নূতন, আহমেদ শরীফ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ছবি শেষে সিনেমা হল থেকে বাহির হয়ে খেলার মাঠে গেলাম। ধুলো-বালিতে গড়াগড়ি খেয়ে বাসায় আসলাম। মা বাবা যাতে মনে করে আমি ফুটবল খেলে এসেছি… তারপর থেকে শুরু হলো ঘর পালিয়ে সিনেমা দেখার অভিযান।

২১ আগস্ট ২০২২


মন্তব্য করুন