Select Page

ফারুকের সাক্ষাৎকার/ মামলা থেকে দূরে থাকার জন্য বন্ধুরা ফিল্মে অভিনয়ের পরামর্শ দেয়

ফারুকের সাক্ষাৎকার/ মামলা থেকে দূরে থাকার জন্য বন্ধুরা ফিল্মে অভিনয়ের পরামর্শ দেয়

আকবর হোসেন পাঠান থেকে পর্দায় নাম ফারুক। আরেক উপাধি পেয়েছিলেন পর্দা থেকেই। মিয়া ভাই। গ্রামীণ আবহে নির্মিত সিনেমায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এ নায়ক। অভিনয় করেছেন সুজন সখী, লাঠিয়াল, নয়নমণি, সারেং বউসহ অসংখ্য নন্দিত চলচ্চিত্রে। কয়েক বছর আগে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছিল অনলাইন সংবাদমাধ্যমে। বর্তমানে সেখানে সাক্ষাৎকারটি পাওয়া যায় না।

রাজনীতির সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন?

পোগোজ স্কুলে পড়ার সময়ই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। ছোটবেলা থেকেই আমার বক্তৃতা শোনার একটা আগ্রহ ছিল। বঙ্গবন্ধু আউটার স্টেডিয়ামে বক্তৃতা দিতেন। প্রায়ই সেখানে গিয়ে শুনতাম। এখন তো গুলিস্তানে লাখ লাখ মানুষ। তখন এত মানুষ কল্পনাও করা যেত না। বরং প্রায়ই দেখা যেত শিয়াল হাঁটাচলা করছে। গুলিস্তান যে সিনেমা হল, ওইখানে বন্ধুরা দল বেঁধে যেতাম। প্রায়ই দেখতাম ভাসানী সাহেব বক্তৃতা দেন। উনার বক্তৃতা শুনতে ভীষণ মজা লাগতো। একদিন ভাসানী সাহেবের বক্তৃতা শুনতে দাড়ালাম, উনি বলছিলেন- ‘এই যে দেখেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া নিজে একটা মেশিন বসাইয়া নিয়াছে। নিজে কাগজ কিনিয়া, সেইখান থেইকা নিজের ইচ্ছামতো খবর ছাপাইয়া পয়সা কামাই করিতেছে। কী লিখিতেছে? রাজনীতিবিদদের গোমর ফাঁস করিয়া দিতেছে। আমার বড় ভয় করিতেছে, কবে না আমার কোমরে হাত দেয়।’ এই যে ঢঙ-ঢাঙ করে বক্তৃতা দেওয়া, এটা কিন্তু ভাসানী সাহেব ছাড়া অন্য কোনো বক্তায় আমরা আর পাইনি। এই রকম বক্তৃতা হলে প্রায়ই শুনতে দাঁড়িয়ে যেতাম। একদিন শুনি দরাজ কন্ঠে একজন বক্তৃতা দিচ্ছে- ‘এ দেশের মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে, এটা হতে পারে না।’ গলা শুনেই চমকে গেলাম। মনে হলো, আরেহ! ক্ষুধার্ত তো আমিও থাকি। কে রে এটা ভাই? গিয়ে দেখি, লম্বা ছিপছিপা, মোছ আছে, চশমা পড়া এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী এই ব্যাটার? সে উত্তর দিলো, ‘মুজিব ভাই’। তখন থেকে এই আস্তে আস্তে যাওয়া শুরু করলাম। মুজিব ভাইয়ের মিটিং হলেই বেশি যেতাম। আস্তে আস্তে স্টেজে উঠেও মাতবরী শুরু হলো। চেয়ারটা সরানো, চেয়ার ঠিকঠাক করা, এইগুলা করে মুজিব ভাইয়ের নজরে পড়ার চেষ্টা চালাতাম। বঙ্গবন্ধু সাহসী মানুষ খুব পছন্দ করতেন। কোনো কিছু হলেই আমরা দাঁড়িয়ে যেতাম- বলেন নেতা, কী করতে হবে। এভাবেই মুজিব ভাইয়ের চোখেও পড়ে যাই। তার প্রতি মিটিং-এ আমি ১৫-২০ জন ছেলেপেলে নিয়ে গিয়ে স্লোগান দেওয়াতাম। দুপুরবেলা ওদের পরোটা-মাংস খাওয়াতাম। ছেলেপেলে নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে টাকা চাইতাম। বলতাম, দ্যান। উনি দুই-চার-পাঁচ টাকা সবসময় দিতেন।

আমি শুনেছি আপনি একবার বঙ্গবন্ধুর পকেট থেকে চুরি করে টাকা নিতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলেন?

হা হা হা! ঠিক শুনছো। একবার বঙ্গবন্ধু বসে আছেন, উনার পাঞ্জাবির পকেটে টাকা দেখা যাচ্ছে। আস্তে করে দুই আঙুল যেই দিলাম, উনি খপ করে আমার হাতটা ধরে বললেন- ‘কী রে! তোরে না টাকা দিলাম?’ আমি বললাম, দিছেন তো, কিন্তু টাকা দেখলে তো আর ভালো লাগে না! এই ঘটনা আমার প্রায়ই মনে পড়ে, সে কারণে একটা ফিল্মে আমি এই ধরনের একটা সিকোয়েন্সও রেখেছিলাম।

লাঠিয়াল চলচ্চিত্রের দৃশ্য ববিতা, রোজী ও ফারুক, পরিচালক করেছেন নারায়ণ ঘোষ মিতা

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নাকি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন?

ছয় দফা আন্দোলনের কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু একদিন আমাদের ডেকে বললেন- ‘তোদের নামে মানুষ নানা ধরনের বিচার-সালিশ দেয়।’ গুন্ডামি করি এটা তো আর বলতেন না, বললেন ‘তোরা যা খুশি তাই করস। মানুষ এগুলা বললে তো আমার ভালো লাগে না।’ আমি বললাম, আমরা যা খুশি তা করি মানে, নেতা? ছাত্র ইউনিয়নের ওরা এটা-ওইটা করে, আমরা তো কিছু করি না। উনি তখন আমাদের বললেন, ‘তোরা কোনো মিটিংয়ে গেলে আমার কাছে মানুষ নালিশ করে তোরা ছাত্র না, বহিরাগত। তোদের মধ্যে ৮০ ভাগই কলেজে পড়স না। এগুলা হবে না, একটা সার্টিফিকেট হলেও নাও, জগন্নাথে ভর্তি হও।’ আমি তখন বললাম, আমি তো ক্লাশ এইটে পড়ি। যদি পরীক্ষা দেই আমার পাশ কেউ আটকাতে পারবে না কিন্তু তাতে লাভ কী? আমার ভবিষ্যৎ কী হবে? বঙ্গবন্ধু কিছু সময় ভেবে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিকই। তোর মতো যারা আছে, তাদের আমি বলমু না। কিন্তু বাকিদের বলবো অন্তত একটা হলেও সার্টিফিকেট নাও। তোরা এ দেশের ভবিষ্যৎ, তোরা সবাই মিলে যদি এ সময়টাকে স্যাক্রিফাইস করতে পারিস তাহলে একটা স্বাধীন দেশ হতে পারে।’ তার এই কথার মধ্যে এমন কিছু ছিলো যে নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবো। ঠিক মতো অক্ষরও লিখিনি, অথচ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিলাম। আমার এইগুলা বলতে কখনো খারাপ লাগে না, নির্দ্বিধায় বলি- আমি ভাই গণ্ডমূর্খ!

পুরান ঢাকার জীবন, মারপিট, রাজনীতিসেখান থেকে চলচ্চিত্রে কেন আর কীভাবে এলেন?

সে সময়ের পুরোনো ঢাকা খুবই সংস্কৃতিমনা ছিল। সেখানে এলাকাভিত্তিক নাটকের আয়োজন করা হতো। কোনো এলাকায় ভালো নাটক করলে অন্য এলাকা থেকে ছেলেপেলে নিয়ে সেটা ভাঙার চেষ্টা করা হতো। আমরা ছিলাম সেই দুষ্টু ছেলেপেলে, যারা নাটক মঞ্চায়নের সময় পচাঁ ডিম ছুঁড়ে মারতাম। নূরা নামে আমার এক বন্ধু ছিল, সে এইগুলার ওস্তাদ। ওর পকেট ভরা সব সময় আণ্ডা থাকতো। ওকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতো- ‘কওয়া তো যায় না, কুন সুমো লাইগা যায়।’ একবার এইচ আকবর সাহেবের একটা নাটক ভেঙে দিয়েছিলাম। উনি এ কারণে সিদ্ধান্ত নিলেন আমার সঙ্গে গণ্ডগোল না করে, পটিয়ে যদি নাটকে ঢুকানো যায় তাহলে এই ঝামেলা থেকে তারা মুক্তি পাবেন।

আমাকে তারা প্রস্তাব দেওয়ার পর আমি বললাম, আপনি আমাকে অন্য যেকোনো কিছু বলেন, সব পারবো। কিন্তু অভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। অনেক কায়দা-বুদ্ধি করে তারা আমাকে এক প্রকার কনভেন্স করলো তাদের সঙ্গে রিহার্সালে থাকার জন্য, কিন্তু আমার শর্ত ছিল আমি থাকবো, কিন্তু অভিনয় করবো না। দেড়-দুই মাস পরে রিহার্সালে গিয়েছি, সেখানেও সব মাতবরী আমার। একদিন হুট করেই ওদের মধ্যে একজন এসে বললো, ‘উমুকে তো আসে নাই, আপনি শুধু ওর জায়গায় দাঁড়াইবেন, কোনো ডায়লগ কইতে হইবো না।’ আমি বললাম পারমু না, আমার ভয় করে। তারা আামরে বললো ‘মিয়াঁ আপনার মধ্যে ভয় বইলা কোনো জিনিষ আছে নাকি?’ তারপর তারা এমন জোরাজোরি শুরু করলো আর না করতে পারলাম না।

দশ-বারো দিন পর আবার একদিন বললো, ‘খালি একটা ডায়লগ বলবেন।’ আমি জানতে চাইলাম, কী ডায়লগ? ওরা বললো- ‘কখন আসলেন?’ আমি বললাম- কখন আইলেন। ওরা বললো, ‘উঁহু দুলু ভাই… কখন আইলেন না, কখন আসলেন!’ পরেরবার ঠিক বললাম। এরপর একটা-দুইটা ডায়লগ দেওয়া শুরু হলো আর আমার মধ্যেও একটা কিওরিসিটি কাজ করলো, আরে শালা! পারুম না কেন? প্রথম প্রথম ডায়লগ মনে থাকতো না। আস্তে আস্তে প্র্যাকটিস করতে করতে মুখস্ত হতে থাকলো। আমার জন্য প্রায় ছয় মাস ওই নাটকের রিহার্সাল করা হলো। নাটকটার নাম ছিল ‘ঘর-মন-জানালা’। লিখেছিলেন আমাদের খুব বিখ্যাত একজন কমেডি অভিনেতা খান জগলু। উনি যেই ক্যারেক্টার করতেন ‘পটলা’, সেটাই আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন, পরে জেনেছি ওইটাই নাকি মেইন ক্যারেক্টার ছিল। আমাদের যত বন্ধু-বান্ধব ছিল সবাই সেখানে অভিনয় করেছিল। এখন যে (তৎকালীন) ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া সাহেব, তিনিও সেখানে অভিনয় করেছিলেন।

সারেং বউ সিনেমায় ফারুক ও কবরী, পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন

ওই নাটক করার পর একজন বিশাল বড় একটা কাপ নিয়ে আসলো। মাইকে তাকে বলতে দেওয়া হলো কেন এই কাপ নিয়ে আসছে। লুঙ্গি পড়া এক লোক মাইকে দাঁড়িয়ে বললো- ‘আমার ভাই দুলু, ওর অভিনয় দ্যাখলাম পটলার। বড় ভালো লাগছে। ভাইয়ের লেইগা কাপটা লইয়া আইছি।’ এটা কিন্তু অনেক বড় ইন্সপেরেশন ছিল। বাড়ির মানুষের অগচরে ওই কাপটাকে যে আমি কত মুছে মুছে রাখতাম, আজ পর্যন্ত সেটা কেউ জানে না।

ছয় দফা আন্দোলনের পর আমার নামে এত মামলা-মোকদ্দমা আসা শুরু হলো যে এগুলো থেকে দূরে থাকার জন্য বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে ফিল্মে অভিনয়ের পরামর্শ দিলো। আমি বললাম সিনেমায় যাওয়া কী মামারবাড়ির মুয়া? আমি বললেই তো আর সিনেমায় যাওয়া সম্ভব না। কয়দিন পর প্যারামাউন্ট রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের নিয়ে চা খাচ্ছি, পাশের টেবিলে এটিএম শামসুজ্জামান সাহেব, এইচ আকবর সাহেব, খোকা বসে কথা বলছিলেন। এইচ আকবর সাহেব তো আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। এটিএম শামসুজ্জামান সাহেব আকবর সাহেবকে বলছিলেন, ‘আপনার তো সবই হলো কিন্তু হিরো তো হলো না। রাজ্জাক সাহেব তো শিডিউল দিতে পারলেন না। আপনি কিছু ভাবসেন আপনার হিরো কে?’ আকবর ভাই নির্দ্বিধায় আমাকে দেখিয়ে বললো- ‘ওই যে দুলু।’ আমি চমকে তার দিকে তাকালাম, সে আরও দৃঢ়ভাবে বললেন- ‘হ, দুলুই তো আমার হিরো।’

এরপর তাদের টেবিলের সঙ্গে আরেকটা টেবিল লাগিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। এ এক কথা বলে, সে আরেক কথা বলে। একজন বললো ‘ফিল্মে ওর নাম কী হইবো?’ আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল ফারুক নামে, সে বলে উঠলো ‘হিরো দুলু নামটা যেন কেমন লাগে। আকবর, পাঠান, দুলু কোনোটাই হিরোর নাম হিসাবে ঠিক না। ফারুক বা এই রকম নাম হতে হবে।’ ওইটাই সবাই সমর্থন করলো- আমার নাম হয়ে গেলো ফারুক।

সুজন সখীসুজন; সারেং বৌ- এর কদম সারেং, লাঠিয়ালের দুখু মিয়া এবং গোলাপী এখন ট্রেনের মিলন– আপনার প্রিয় চরিত্র কোনটি?

সে সময়ের মানুষের মন-মানসিকতা এমন ছিল যে এই ছবিগুলা তাদের ভীষণ ভালো লাগতো। আমার প্রথম সাতটা ছবি ফ্লপ করার পরে আট নাম্বার ছবি থেকে হিট হওয়া শুরু হয়। সেই আট নাম্বার ছবির নামই ‘লাঠিয়াল’। ‘লাঠিয়াল’ যখন করি তখন অনেকেই বলেছে এবার তো নারায়ণ ঘোষ মিতা শেষ। এমন এক লোককে নিয়েছে যে জিন্দিগী ভর গণ্ডগোল করেছে, মারামারি করেছে। অথচ এই লোকটা যে যুদ্ধও করেছে, সেটা একটা মানুষও বলে নাই। ‘লাঠিয়াল’ করার পরে ভাবলাম নেতার হাত থেকে অ্যাওয়ার্ড নেবো। রিলিজ হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। তখন মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ি। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ, আমাদের মন তো ভাঙবেই।

এরপরের ছবিটা ছিলো ‘সুজন সখী’। বাংলা ছবির ইতিহাসে আমার জানামতে, ‘রূপবান’-এর পরে যে ছবিটি ব্যবসা সফল হয়েছে, সেটা ‘সুজন সখী’। এ ছবি রিলিজ হওয়ার পর ‘সুজন’-এর ক্যারেক্টার নিয়ে একটা হইচই পড়ে গিয়েছিল। অথচ ওই বছর পুরস্কার দেওয়ার সময় বলা হলো, আমাকে দেখলে নাকি মনে হয় আমি বঙ্গবন্ধুর কথা খুব বেশি বলি, তাই আমাকে পুরস্কার দেওয়া হবে না। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ বলে আমাকে পুরস্কারটা দেওয়া হয়নি।

‘সারেং বউ’-এর গল্প শহীদুল্লাহ কায়সার সাহেব তৈরি করে রেখেছিলেন। সেটাকে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই আবদুল্লাহ আল মামুন ভাই চলচ্চিত্র রূপ দিয়েছেন। কদমকে নিয়ে আমি খুব একটা প্রাউড ফিল করি না। সারেং জাহাজ চালায় কিন্তু এই সারেংয়ের পরিপূর্ণ জীবনের একটা ফ্লেভার যদি চিত্রনাট্যে না দিতে পারো, তাহলে তার বউয়ের চরিত্রটাও ঠিক পূর্ণতা পায় না। উড়া উড়া কিছু জিনিষ চিত্রনাট্যে আনা হয়েছে যা একজন সারেং সম্পর্কে পূর্ণ ইনফরমেশন দেয় না। আমার মতে চিত্রনাট্যে কদমের ক্যারেক্টারে একটা গ্যাপ আছে, পুরোপুরি আনা হয়নি। এই একটা কারণে কদমকে নিয়ে আমি খুব বেশি কথা কোথাও বলি না। তবে গল্প এবং ছবিটা বেশ ভালো সেটা নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই। রাইটারের চোখে কদম কিন্তু অবহেলিত ছিল না, কেন যেন পরিচালকের চোখে একটু অবহেলিত হয়েছে।

আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমনি’ ছবিতে ববিতা-ফারুক

‘লাঠিয়াল’-এর দুখু মিয়ার ক্যারেক্টার নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে বলা যায় ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড যখন দেওয়া হলো, তখন কেমন যেন একটা দুর্নীতি হলো। আনু দা (আনোয়ার হোসেন) বেঁচে থাকার সময় বহুবার কথাটা বলতে চেয়েছি, আবার ভাবতাম উনি অসুস্থ ছিলেন, এটা শুনলে শকড হবেন। আমার সঙ্গে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল। উনার কোনো দোষ ছিল না আসলে। ফিল্মটা রিলিজ হওয়ার পর সেই সময় যারা অ্যাওয়ার্ড কমিটিতে ছিলেন, তাদের অনেকেই বেঁচে আছেন, সুতরাং নাম বলবো না। তারা তো জানেন, তারা কী করেছিলেন। তারা আমাকে একদিন ডেকে বললেন, ‘ফারুক তুমি মন খারাপ কইরো না, আনোয়ার হোসেন জীবনে আর কখনো অ্যাওয়ার্ড পাবে না, কিন্তু তুমি প্রতিবছর পাবা। তোমার মতো এত বড় অভিনেতা এই বাংলাদেশে এখনো নাই। তুমি একটু স্যাক্রিফাইস করো।’ আমি বললাম, কী স্যাক্রিফাইস? পুরস্কার নিবো না? আচ্ছা, নিলাম না। উনারা বললেন, ‘না। তুমি নিবা, কিন্তু পার্শ্বচরিত্রের জন্য।’ আমি বললাম, এটা তো পার্শ্বচরিত্র না। অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ডও তো যৌথভাবে দেওয়ার নিয়ম আছে, আপনারা কেন ওইভাবে দিতে পারেন না? আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, ওই ছবিতে আমি ছাড়া কে লিড ক্যারেক্টার এটা কেউ যদি আমাকে দেখাতে পারে, আমি আর কোনো কষ্ট রাখবো না। লাঠিয়ালের প্রতি আমার এই দুঃখ রয়ে গেছে বলে আমি এটা নিয়েও কথা বলি না।

‘গোলাপী এখন ট্রেন’ নিয়ে বলবো! ওই ছবি দেখার পর আমাকে একজন অভিনেতা বলেছিলেন, ‘মিয়াঁ ভাই আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এই ছবিতে অভিনয়ের পর আপনি যদি বাথরুমেও বসে থাকেন, সেইখানেই আপনাকে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসবে। শুধু একটি মাত্র সিকোয়েন্স বিষ খাওয়ার, বাংলাদেশে বায়োলজি পারফরম্যান্স কাকে বলে সেটা আপনি শিখাইয়া দিছেন। এই ছবির জন্যও আমাকে পুরস্কার দেয়নি, কারণ একটাই- আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক।

পুরস্কার কি মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থবহ করে?

কখনোই না। আমি মানুষের ভালোবাসার যে পুরস্কার পেয়েছি সেটা কোনো পুরস্কার দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু আমাকে পদে পদে বাধা দেওয়া হয়েছে। পদে পদে অপমান করা হয়েছে কেবলমাত্র আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করি বলে, সেটা আমাকে পীড়া দেয়। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের অনেক জায়গায় গ্যাপ আছে। আমি যখন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড বোর্ডের মেম্বার ছিলাম, তখন প্রোপোজ করলাম শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা না, যারা সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইন করে, যারা প্রোডাকশন বয়-কন্ট্রোলার সবাইকে একটা সম্মাননা দেওয়ার। এরপর তো আর আমাকে কমিটিতেই রাখা হলো না, আমি তাদের কাছে একটা ঝামেলা হয়ে গেলাম। যারা ওইসব পদে বসে আছেন, তারা কারা- যদি এই প্রশ্ন করি, কেউ উত্তরও দিতে পারবে না।

অনেক অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন, ববিতা, কবরী, রোজিনাসহ অনেকের সঙ্গে আপনার অসাধারণ জুটি ছিল। অভিনয় করতে গিয়ে কখনো কারো প্রেমে পড়ে যাননি?

আমি সবার প্রেমেই পড়েছি! এটাই তো স্বাভাবিক। অভিনয় করতে গিয়ে যদি প্রেমেই না পড়ি তাহলে অভিনয় আসবে কী করে? এটা ন্যাচারাল। একটা ফুললেন্থ ছবিতে দীর্ঘ সময় কাজ করবো, আর কোনো সম্পর্ক হবে না, এটাই তো বরং অস্বাভাবিক। কেউ যদি বলে তারা কখনো কাজ করতে গিয়ে প্রেমে পড়েননি, সেই মিথ্যা কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। অনেকে এটাকে বাঁকা চোখে দেখে, কিন্তু সেই সম্পর্কগুলো কিন্তু খুব মিষ্টি ছিলে। প্রেম যে হয়নি, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। প্রেম হয়েছিলে, অনেকের প্রেমেই পড়েছিলাম।

সুজন সখী ছবি কবরী ও ফারুক, পরিচালনা করেছেন প্রমোদকর

গুঞ্জন আছে ববিতা ম্যাডামের সঙ্গে আপনার প্রেমের সম্পর্ক ছিল…

মজা লাগতো মানুষ যখন বলত ফারুক-ববিতার তো সিরিয়াস প্রেম, তারা তো বিয়ে করে ফেলবে। আমার জানা মতে, ববিতার তো প্রেম ছিল আমার বন্ধু জাফর ইকবালের সঙ্গে। আরো অনেকের সঙ্গেই ছিল। আমার সঙ্গে কেবলই সুন্দর একটা বন্ধুত্ব ছিল। এই বন্ধুত্বকে কেউ যদি প্রেম বলে, আমি তাতে মাইন্ড করবো না। এত সুন্দর বন্ধুত্ব ছিল, এটাকে প্রেম বলা জায়েজ। কাজ করতে গেলে অটোমেটিক্যালি একটা উইকনেস গ্রো করে।

প্রফেশনাল জেলাসি নিশ্চয় আপনাদের সময়তেও ছিল? এ রকম কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে?

প্রফেশনাল জেলাসি তো সাংঘাতিক ছিল, কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো নোংরামী ছিল না। আমি কখনো এইসব জেলাসি করি নাই। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রচণ্ড ভালো সম্পর্ক থাকার পরও আমার কেন যেন মনে হতো, উনি এই প্রফেশনাল জেলাসিটা বেশি করতেন। আবার তিনি যে আমাকে ভালোবাসতেন বা স্নেহ করতেন, সেটা নিয়েও আমার কোনো সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আপনি মিয়া ভাই নামে অধিক পরিচিত। কেমন লাগে কেউ এই নামে ডাকলে?

লাঠিয়াল ছবিটা করার পর থেকে এই নামটার সূচনা হয়েছিলো। লাঠিয়ালে আনোয়ার হোসেনকে আমি ‌মিয়া ভাই ডাকতাম। আবার আনোয়ার হোসেনও আমাকে মিয়া ভাই ডাকতেন। একটা সিকোয়েন্স ছিল, আনোয়ার হোসেন আমাকে লাঠি পেটা করছেন। আমি ‘মিয়া ভাই’ বলে জোরে একটা চিৎকার দিই। আমাকে যখন কেউ মিয়া ভাই বলে ডাকে, আমি মনে করি তিনি একদম আত্মার আত্মীয়। এই কারণে এই ডাকটা আমার ভীষণ প্রিয়।

যুদ্ধকালীন সময়ের খুব মনে পড়ে এমন একটা ঘটনা বলবেন কী?

যুদ্ধের তিনমাসের মাথায় একবার আমার খুব ইচ্ছে হলো পোলাও খাবো। রাস্তায় তো বের হওয়া সম্ভব হয় না। আমার এক ছোট ভাই বললো ‘আমি নিয়া আসি।’ আমি বললাম নিয়া আসবি? কিন্তু গিয়া খাইতে পারলে ভাল লাগতো গরম গরম। ও সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘চলেন কোনো অসুবিধা হবে না।’ তার সঙ্গে খেতে গেলাম নবাবপুর রোডের আল-ইসলামিয়া হোটেলে। আমরা খেতে ঢুকার পর হোটেলে গান লাগালো ‘মাঝি বাইয়া যাও রে….’ একটু পর দুইটা জিপ এসে হোটেলের নীচে থামলো। সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে গান পাল্টিয়ে পাঞ্জাবী এক গান লাগানো হলো ‘সাব তো সোনিয়া হ্যায়রে মান মোরিয়া’। আর্মি ঢুকেই একটা লাথি দিয়ে ক্যাশে থাকা লোকটাকে ফেলে দিয়ে বললো- ‘মাঝি বাইয়া যাওরে? বাড়ি ক্যাথায়? ফেরিদপুর? নাম ক্যায়া হ্যায়? শেখ মুজিব? শালা শুয়ার কা বাচ্চা আভি তুম ক্যায়া বাজাইয়া? মাঝি বাইয়া যাওরে?’ আমরা ভেতরে কেবিনে বসে খাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম সেখানেই বোধহয় মৃত্যু হবে, বেঁচে ফিরতে পারবো বুঝতে পরিনি। কিছুক্ষণ পর ওদের সামনেই ‘সাব তো সোনিয়া হ্যায়রে মান মোরিয়া’ গাইতে গাইতে বের হয়ে গেলাম। আমার সাথের ছেলেটা সাদা লুঙ্গি আর টুপি পড়া ছিলো ওরা ভাবছিলো হয়তো নামাজ পড়ে খেতে ঢুকেছিলাম।ওইখান থেকে বের হয়েই চটজলদি এলাকা পার হয়ে গেছি।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন