Select Page

অস্বস্তির গল্পে স্বস্তির আনন্দ

অস্বস্তির গল্পে স্বস্তির আনন্দ

কমলা রকেট
পরিচালনা : নূর ইমরান মিঠু
অভিনয়ে: তৌকীর আহমেদ, মোশাররফ করিম, জয়রাজ, সামিয়া সাঈদ, সেঁওতি, ডমিনিক গোমেজ, সুজাত শিমুল ও বাপ্পা শান্তনু।
রেটিং : ৩/ ৫

দার্শনিকরা বলেন, কারো কাছে ভাঙা গ্লাসও শিল্পমান বহন করে। ঘোর অমাবস্যাতেও কখনো কখনো তীব্র আনন্দ হয়। শ্রমজীবীর ঘর্মাক্ত শরীরের মাঝেও অনেক শিল্পী নান্দনিকতা খুঁজে বেড়ায়। ‘কমলা রকেট’ ছবিতে ঠিক সেরকমই কিছু অসহনীয় সৌন্দর্য নিয়ে এবারের ঈদে হাজির হয়েছেন ‘পিঁপড়া বিদ্যা’ ছবির নায়ক ও চলচ্চিত্রের নবাগত পরিচালক নূর ইমরান মিঠু।

কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ ও ‘সাইপ্রাস’ নামের দুটি গল্পের মিশেলে ‘কমলা রকেট’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক ও লেখক শাহাদুজ্জামান নিজে। তিনটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির কারণে এবং মুক্তির আগে নাম মাত্র প্রচারণার কারণে অনেক দর্শক এখন এই চলচ্চিত্রের নামটি পর্যন্ত জানেন না। এক্ষেত্রে প্রযোজক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম তার রেওয়াজ অক্ষুন্ন রেখেছে। বিষয়টি হতাশাজনক। আমরা চাই, প্রতিটি চলচ্চিত্রের বিকাশ হোক। সঠিক পরিচর্যা হোক।

শুধু পুরস্কার কিংবা চলচ্চিত্র উৎসব নয়, প্রত্যেক নির্মাতার স্বপ্নে যেন প্রতিটি দর্শক সওয়ারি হয়। প্রতিটি মনে রাখার মত চলচ্চিত্র যেন সত্যি সত্যিই আজন্ম লালিত হয় দর্শকের মানসপটে।

খোলা চোখে দেখলে ‘কমলা রকেট’ নামের লঞ্চকে নিয়ে এই চলচ্চিত্রের গল্প। ঢাকা থেকে মোরেলগঞ্জের যাত্রাপথে এই রকেটেই যাত্রীদের নিয়ে ঘটে যায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। যার বেশিরভাগই নীরেট অস্বস্তির আবরনে মোড়ানো। এই চলচ্চিত্রে কোনো খল চরিত্র নেই। তারপরও কখনো কখনো দু-একটি চরিত্রের ওপর রাগ হয়েছে। পরক্ষণেই অবশ্য আবার ভেবেছি, এসব তো সদ্যপ্রসূত কোনো অলৌকিক চরিত্র নয়। আমাদের আশেপাশে দেখা কত শত আত্মকেন্দ্রিক চরিত্র রয়েছে, যারা শুধুমাত্র নিজের আয়নায় শুধু নিজেকেই দেখতে পায়। অন্যকে আলোকিত করার কিংবা আরেকটু বাড়িয়ে বললে অন্যের জীবনে আঁধার নামিয়ে নিজেকে আলোকিত করার একটা অলিখিত দৌড়ে ছুটে চলে প্রতি নিয়ত। কিন্তু দিনের শেষে যেমন রাত হয়, রাতের পর দিন, সব দৌড় কিংবা সব খেলারও একটি গন্তব্য থাকে। সেই গন্তব্যে গিয়ে কেউ কেউ পেছন ফিরে তাকাতে পারে। হিসাবের খাতা খুলে কাটাকুটি করতে পারে। নিজের ভুলগুলো জলের মত স্বচ্ছ হয়ে তখন ধরা দেয়। ‘কমলা রকেট’ ছবিতেও তেমনটিই দেখেছি।

এখানে অদূরদর্শী, মুনাফালোভী ব্যবসায়ী আতিক (তৌকীর আহমেদ) ইন্স্যুরেন্স থেকে টাকা পাবার আশায় নিজের কারাখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে যান। পরিকল্পনা করেন মংলায় বন্ধুর বাসায় আত্মগোপন করে থাকবেন। কিন্তু পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। আতিকের বিষয়টি মুহূর্তেই জানাজানি হয়ে যায়।

‘কমলা রকেট’-এর চিত্রনাট্যকাররা প্রতিটি চরিত্রের চরিত্রায়ণের পেছনে সময়ক্ষেপণ করেননি। তারা বিশ্বাস করেছেন, দর্শকদের মুখে তুলে খাইয়ে দেবার কিছু নেই। এই ভাবনা মাথায় নিয়েই পরিচালক তার গল্পের ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়েছেন কমলা রকেটে। প্রাথমিকভাবে অনেকের কাছে গল্পের গতি কিছুটা স্লথ মনে হলেও গল্পে একবার ঢুকে গেলে জানতে ইচ্ছে হবে, আতিকের মনের লঞ্চ কোথায় গিয়ে থামবে? তার বোধোদয় কি আদৌ হবে?

পরিচালক নূর ইমরান মিঠু অবশ্য তার প্রথম ছবিতে পাণ্ডিত্য জাহির করবার চেষ্টা করেননি। তিনি একটা সময় সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন আরেকটি চরিত্রকে, যিনি তার স্ত্রীর মরদেহ এই লঞ্চে করেই নিয়ে যাচ্ছেন। আতিকের বিবেক কিছুটা দংশন হয়, যখন তিনি জানতে পারেন এই মরদেহ আতিকেরই কারখানায় ভস্মীভূত হয়েছে।

‘কমলা রকেট’ ছবিতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে, শ্রেণীভেদে সবাই সবার থেকে আলাদা বেশভূষা ধারণ করলেও কাম, ক্ষুধা, শীত, গন্ধের মত মৌলিকতার প্রশ্নে, বেঁচে থাকার প্রশ্নে সবাই এক। আমরা সবাই আদম সন্তান। এ কারণেই হয়তো ব্যবসায়ীর বিবেকের দংশনের প্রসঙ্গ চর্বিতচর্বন না করে পরিচালক চেয়েছেন, রাগ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, লোভের ঊর্ধ্বে আমরা যেন পরস্পরকে নিয়ে ভাবি। অন্যের অনুভূতি, বেঁচে থাকার আকুলতাকে যেন অগ্রাহ্য না করি।

আপাতদৃষ্টিতে একজন মন্দ লোকেরও মন আছে। মনন আছে। সেই মননে পচন ধরতে পারে। কিন্তু অস্তিত্ব তো বিলীন হয়নি। সুতরাং জেগে ওঠার এই তো সময়। নতুন করে ভাববার, নতুন করে স্বপ্ন দেখবার এই তো সময়!

পরিচালক নূর ইমরান মিঠু প্রথম ছবিতেই এক অদ্ভুত সরল মাখা গল্প বলেছেন। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমজনতা কিংবা সব শ্রেণীর দর্শকের বিনোদনের জন্য এ ছবিটি নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে ‘বিষাদময় জীবন কাব্য’ হয়তো কাউকে হতাশায় নিমজ্জিত করবে। তবে অন্তর্নিহিত অর্থের খোঁজ করলে, ‘কমলা রকেট’কে মনে হবে খোলা আকাশের মত বিস্তীর্ণ, বিশাল। এই বিশালতায় আকাশের মত মেঘ জমে, রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি হয়, রাগ হয়, লোভ হয়, অনুশোচনাও হয়।

এ ছবিতে বিশেষ একটি দৃশ্যের কথা বলতেই হয়, যেখানে আমাদের পচন ধরা সমাজব্যবস্থা থেকে যে উটকো গন্ধ বের হচ্ছে, তা প্রতীকী অর্থে দেখানো হয়। সেই গন্ধ আমাদের উচ্চশ্রেণীর নাকে সাধারণত পৌছায় না। তবে যখন পৌছায়, তখন নিজেরাই নিজেদের কৃতকর্মের নোংরা গন্ধ পান। আর এই দৃশ্যটিতেই কোনো সংলাপ ছাড়া অসাধারণ অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ। নৈতিক আর আত্মিক স্খলন হারানো একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর চরিত্রে তৌকীর আহমেদ মানিয়ে গেছেন বেশ। আন্ডারটোন অভিনয়ে তিনি বরাবরের মতই বেশ সাবলীল ছিলেন। সফল চলচ্চিত্র পরিচালককে দীর্ঘদিন পর বড়পর্দায় অভিনয় করতে দেখাটাও ছিল আমাদের জন্য বাড়তি পাওনা।

তৌকীর আহমেদের সঙ্গে এক ফ্রেমে পাওয়া গেছে আরেক মেধাবী অভিনেতা মোশাররফ করিমকে। ঘোর অস্বস্তি আর দম বন্ধ পরিস্থিতিতে ‘দালাল মফিজুল সরদার’ চরিত্রে মোশাররফ করিমের অভিনয়ের কারণে গল্প কিছুটা রঙিন হয়েছে। অন্যদিকে জয়রাজের নীরব চোখের গভীরতা বুকের ভেতর স্পর্শ করেছে। অনুভব করেছি তার একাকীত্ব, স্বজন হারাবার প্রগাঢ় বেদনা। ডমিনিক গোমেজ কিছু দৃশ্যে অতি অভিনয় করেছেন। তার চরিত্রটিও অবশ্য বেশ উচ্চকিত ছিল। সেঁওতি বরাবরের মত সাবলীল। চলচ্চিত্রে নতুন হিসেবে সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়িনী সামিয়া সাঈদ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিছুটা ধূসর চরিত্রে সামিয়া বেশ সাহসী ছিলেন এ ছবিতে। সুজাত শিমুল বরাবরের মতই সহজ-স্বাভাবিক, সাবলীল।

‘কমলা রকেট’-এর গান দুটি ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগেনি। বিশেষ করে ‘মোমবাতি’ গানটির সাউন্ড মিক্সিং ও সুর বিরক্তির উদ্রেক করেছে।

এ ছবিতে ড্রোন ক্যামেরায় কিছু এরিয়েল শট মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। ঢাকা থেকে খুলনা চারবার যাতায়াত করে ‘কমলা রকেট’ চলচ্চিত্রের জন্ম হয়েছে। যত্নের ছাপ পেয়েছি নির্মাণে ও গোলাম মাওলা নাবীর চিত্রগ্রহণে। সম্পাদক সামির আহমেদের আন্তরিকতা চোখে পড়েছে। আবহ সংগীত স্রষ্টা পাভেল আরীনের সুর (মোমবাতি গানের ব্যবহার বাদে) বেশির ভাগ দৃশ্যেই অর্থবহ মনে হয়েছে।

সবাইকে এক সুতোয় বন্দী করার জন্য পরিচালক নূর ইমরান মিঠু ধন্যবাদ পেতেই পারেন। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো নির্মাতার অন্য কোনো চলচ্চিত্রের মত মনে হয়নি ‘কমলা রকেট’কে। অণুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে খুঁজলে এ ছবিরও বেশ কিছু কারিগরি অসঙ্গতি চোখে পড়বে।

ব্যবসায়িকভাবে ‘কমলা রকেট’ প্রেক্ষাগৃহ থেকে প্রযোজকের পকেট কতটা ভারী করতে পারবে, সেটি নিয়েও আমি সন্দিহান। তবে এ ছবির সংলাপের মত করেই বলবো, ‘হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান এক মায়ের সন্তান। যার যার কর্ম সে সে করে, কেউ কারো ক্ষতি চায় না।’ আমরাও চাই না নতুন একজন নির্মাতা তার প্রথম পদক্ষেপেই হোঁচট খাক। আমরা চাই নিজেকে ঋদ্ধ করে তরুণ এই নির্মাতা আরো অনেক স্বপ্ন নিয়ে ডানা মেলুক। সাফল্যের সেই ছায়াতলে আমরা যদি একদিন সুশীতল হই, সেটিই হবে আমাদের জন্য বড় পাওনা।

*রিভিউটি সংক্ষেপে সমকাল ২৮ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত।


মন্তব্য করুন