Select Page

আমাদের মহানায়ক

আমাদের মহানায়ক

আবদুল্লাহ ইউসুফ পরিচালিত ‘ইয়ে করে বিয়ে’ (২০/০৪/১৯৭৩) দিয়ে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন বুলবুল আহমেদ, তার অভিনীত শেষ ছবিটি ছিল নূর উল আলম পরিচালিত ‘পরম প্রিয়’ (৩০/০৬/২০০৬)।

বুলবুল আহমেদ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অনেক আগেই বিটিভিতে ১৯৬৮ সালে আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশনায় ‘পূর্বাভাস’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন। সে সময়ে তিনি তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।

অভিনয়ের তৃতীয় চলচ্চিত্র আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ (২৯/০৮/১৯৭৫) দিয়ে মূলত তিনি সবার নজরে আসেন, শুরু হয় চলচ্চিত্রের এক দীর্ঘ সফল পথচলা।

কন্যারাশির জাতক বুলবুল আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার অভয়দাস লেনে। তার ভালো নাম তাবারুক আহমেদ। ১৯৫৭ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন তিনি, ভর্তি হন ঢাকা কলেজে, সেখান থেকে নটরডেম কলেজে বি এ পাশ করে  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করেন তিনি। কলেজ-ভার্সিটি পড়ার সময়ে দু-একটি মঞ্চ নাটকে অভিনয়ও করেন।

‘সীমানা পেরিয়ে’ (১৫/০১/১৯৭৭) ছবির কালু মাঝি থেকে ‘বধূ বিদায়’ (১৯/০৫/১৯৭৮) ছবির সহজ সরল যুবক সাগরের অনবদ্য অভিনয়ের মুগ্ধতায় একজন বুলবুল আহমেদ দর্শকদের ভালোবাসা পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। একে একে করে গেছেন বাবুল চৌধুরীর ‘সেতু’, মোস্তফা মেহমুদের ‘মনের মানুষ’, আবদুল লতিফ বাচ্চুর ‘যাদুর বাঁশী’, সাইফুল আজম কাশেমের ‘সোহাগ’, ‘ঘর সংসার’, ‘বৌরানী’, ‘সানাই’, নিজামুল হকের ‘যৌতুক’, তমিজ উদ্দিন রিজভীর ‘ছোট মা’, আবদুল লতিফ বাচ্চুর ‘সঙ্গিনী’, হাফিজ উদ্দিনের ‘ওয়াদা’, অশোক ঘোষের ‘নওজোয়ান’, আলমগীর কবিরের ‘রূপালী সৈকতে’, ‘মোহনা’, কাজী হায়াতের ‘দি ফাদার’, বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, খান আতাউর রহমানের ‘ডানপিটে ছেলে’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘ভালো মানুষ’, আমজাদ হোসেনের ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, সি বি জামানের ‘পুরস্কার’, ‘শুভরাত্রী’, রাজ্জাকের ‘বদনাম’, ‘আকবর কবির পিন্টুর ‘কালো গোলাপ’, কামাল আহমেদের ‘মা ও ছেলে’, শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’-এর মতো অসাধারণ সব ছবিগুলো।

‘দেবদাস’ ছবির দৃশ্য

তবে এত ছবির মাঝে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেবদাস’ নিয়ে প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলামের সেলুলয়েডের ফিতায় বুলবুল আহমেদ যেন হয়ে গেলেন সবার জীবন্ত ‘দেবদাস’ (২৩/১২/১৯৮২)। ছবিটির জনপ্রিয়তা সঙ্গে তার অসাধারণ অভিনয়ের গুনে একটা সময় তাকে ডাকা হতো বাংলার ‘দেবদাস’ বলে। অভিনয়ের গুনে এ রকম উপাধি অবশ্যই একজন অভিনেতার স্বীকৃতি স্বরূপ, তবে তিনি বোধ হয় প্রথম ভাগ্যবান অভিনেতা যার উপাধি একটি নয় বরং দুটি।

আগের চারটি ছবির সফল পরিচালক আলমগীর কবিরের বাম্পার হিট চলচ্চিত্র ‘মহানায়ক’ (১৯/১০/১৯৮৪) ছবিটিতে রাফ অ্যান্ড টাফ চরিত্রের অনবদ্য অভিনয়ের গুনে তিনি দর্শকদের অফুরন্ত ভালোবাসায় পেলেন বাংলার মহানায়ক উপাধিও, যা এখনো তার নামের পাশে ব্যবহার করা হয়। ‘মহানায়ক’ ছবিটি ছিল তখনকার সময়ের চাইতেও আধুনিক একটি ছবি। বাংলাদেশ-নেপাল-মিয়ানমার-শ্রীলঙ্কায় চিত্রায়িত ছবিটিতে বুলবুল আহমেদের মুগ্ধময় অভিনয় যেন এখনো মানুষের মনে গেঁথে আছে। সঙ্গে ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’ তো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে।

‘বধূ বিদায়’ ছবির দৃশ্য

বুলবুল আহমেদ শুধু অভিনয়ই নয়, করেছেন প্রযোজনা-পরিচালনাও। সমরেশ বসুর উপন্যাস থেকে প্রথমে ‘ভালো মানুষ’ (১৩/০৩/১৯৮১) পরে ‘মহানায়ক’ (১৯/১০/১৯৮৪) প্রযোজনা করেন। প্রথমটির পরিচালক ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম পরেরটি আলমগীর কবির। ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ (১৩/০২/১৯৮৭) ছবিটি দিয়ে প্রথম পরিচালনায় আসেন বুলবুল আহমেদ, পরবর্তীতে করেন ‘গরম হাওয়া’, ‘আকর্ষণ’, ‘কত যে আপন’-সহ কয়েকটি ছবি!

বুলবুল আহমেদ যেমন ছিলেন চলচ্চিত্রের সফল অভিনেতা তেমনি টিভি নাটকেও সফল। অবাক লাগে টিভি নাটকে অভিনয় করেও তিনি সমান জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। সাধারণত পর্দার তারকাদের ঘরের ড্রইংরুমে পেলে তাদের প্রতি আকর্ষণটা অনেকটা কমে যায় তবে সে ক্ষেত্রে বুলবুল আহমেদ ছিলেন একেবারেই আলাদা। দু-ধারাতেই নিজস্ব অভিনয়ের স্টাইলের স্বকীয়তা দিয়ে চলচ্চিত্র ও টিভি দর্শকদের ধরে রাখতে পেরেছিলেন সমান তালে।

‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের দৃশ্য

টিভি নাটকের মধ্যে বিশেষ করে হ‌ুমায়ূন আহমেদের রচনায় মোস্তাফিজের পরিচালনায় ‘এই সব দিনরাত্রি’ (১৯৮৫) ধারাবাহিকের সহজ সরল মনের সফিক চরিত্রে অভিনয় করে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘরের দর্শকদের মনের মাঝে। ওনার উল্লেখ্যযোগ্য নাটকের মধ্যে ‘বরফ গলা নদী’, ‘ইডিয়ট’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাগুন’ অন্যতম!

বুলবুল আহমেদ তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭),  বধূ বিদায় (১৯৭৮), শেষ উত্তর (১৯৮০) ও দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তিনবার ও একবার পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন! এ ছাড়া ‘রূপালী সৈকতে’ (১৯৭৯), ‘দেবদাস’ (১৯৮০), ‘ফেরারী বসন্ত’ (১৯৮৩), ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ (১৯৮৭) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার-সহ আরও অসংখ্য পুরস্কার!

বুলবুল আহমেদের অসংখ্য ছবির মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য— সূর্যকন্যা, সেতু, সীমানা পেরিয়ে, মনের মানুষ, সোহাগ, বধূ বিদায়, ঘর সংসার, ছোট মা, শহর থেকে দুরে, সঙ্গিনী, ওয়াদা, রূপালী সৈকতে, দি ফাদার, স্মৃতি তুমি বেদনা, শেষ উত্তর, গাঙচিল, বৌরানী, ডানপিটে ছেলে, ভালোমানুষ, জন্ম থেকে জ্বলছি, কলমী লতা, সানাই, স্বামীর সোহাগ, দেবদাস, কালো গোলাপ, পুরস্কার, ফেরারী বসন্ত, সময় কথা বলে, মহানায়ক, পেনশন, মা ও ছেলে, শুভদা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, সারেন্ডার, দুই জীবন, শিমুল পারুল, ত্রাস, বিক্ষোভ, এই ঘর এই সংসার ও হৃদয়ের আয়না!

বুলবুল আহমেদ যেমন চলচ্চিত্রের রূপালী পর্দায় আলো ছড়িয়েছেন তেমনি তার অভিনীত অনেকে চলচ্চিত্রের গানও মানুষের মনের গভীরে গেঁথে আছে। যেমন; হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে (মহানায়ক), আমার এই দুটি চোখ (মহানায়ক), বলবো কী আর ওগো তুমি যে আমার (সানাই), যদি বউ সাজো গো (ওয়াদা), সামাল সামাল সামাল সাথী (ওয়াদা), বিমূর্ত এই রাত্রি আমার (সীমানা পেরিয়ে), ঐ ভীরু মন আমার মনে (ভালো মানুষ, ছবিটি বুলবুল আহমেদ অভিনীত হলেও গানটির দৃশ্যে থাকেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও ববিতা), মনটা কেন হঠাৎ করে বাঁধন হারালো (গাঙচিল), দুটি মন যখন কাছে এলো (সঙ্গিনী), তুমি ছাড়া আমি একা (দুই জীবন), দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয় (জন্ম থেকে জ্বলছি), চিরদিন সাথী তোমাকেই  চাই (কালো গোলাপ), এ আকাশকে সাক্ষী রেখে (সোহাগ), ও বউ কথা কও (শিমুল পারুল), একবার যদি কেউ ভালোবাসতো (জন্ম থেকে জ্বলছি), শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে (রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত), একটুস খানি দেখ (বধূ বিদায়) ও ভাপা পিঠারে (শিমুল পারুল)।

‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমায় বুলবুল আহমেদ, রোজী আফসারী ও সালমান শাহ

সুস্থ সুন্দর সব চলচ্চিত্র উপহার দেওয়া আমাদের সবার প্রিয় অভিনেতা বুলবুল আহমেদ ২০১০ সালের ১৪ জুলাই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তাকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। একজন বুলবুল আহমেদ বেঁচে থাকবেন এ দেশের অসংখ্য ভক্তকুলের মাঝে তার অনবদ্য সৃষ্টিশীল চরিত্রের মাঝে!


মন্তব্য করুন