Select Page

আয়নাবাজি: দেউলিয়া প্রযোজনার ফাঁকে এক ফালি রোদ

আয়নাবাজি: দেউলিয়া প্রযোজনার ফাঁকে এক ফালি রোদ
aynabaji

আয়নাবাজি সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিমিত গতির সিনেমা। বিশেষ করে সিনেমার স্পেসটাকে কিভাবে ইউজ করতে হবে সেটার জন্য একটা মাস্টার পিস আয়নাবাজি। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ছিলো সেক্স, ভায়োলেন্স, নাচ, সস্তা প্রেমের বস্তা পচা গল্প অথবা সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর গল্প ছাড়াও যে একটা গতিময় গল্প হতে পারে সেটা অনেক স্ক্রিপ্ট রাইটারকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই সিনেমাটি।

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবসা সফল সিনেমা ধরা হয় বেদের মেয়ে জোসনাকে। তারপর সালমান শাহ্‌‘র কেয়ামত থেকে কেয়ামত অথবা আনন্দ আশ্রু; রিয়াজের মনের মাঝে তুমি; ফেরদৌসের হঠাৎ বৃষ্টি; চঞ্চল চৌধুরী‘র মনপুরা; হালে শাকিব খানের শিকারি ইত্যাদি সিনেমাগুলো বিভিন্ন সময়ে সর্বস্তরের দর্শক মনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে আর এই সিনেমাগুলোর প্রত্যেকটার কনটেন্টই ছিলো প্রেম। কিন্তু আয়নাবাজিই মনেহয় বাংলাদেশে প্রথম সিনেমা যা প্রেমের গল্পকে উপজিব্য না করে ব্যবসায় সফল হতে পেরেছে।

আমাদের সিনেমায় বিকল্প ধারা মূলধারা অথবা আর্ট ফিল্ম কমার্শিয়াল ফিল্ম নামে যে ধারাবাজি চলছে অথবা যৌথ প্রযোজনার নামে যে দেউলিয়াপনা চলছে সেই সব বোদ্ধাদের চাপেটাঘাত করে আয়নাবাজি দেখিয়ে দিয়েছে দেখ সিনেমা এভাবে বানাতে হয়। আমাদের সিনেমাগুলোর অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটা হচ্ছে সিনেমার স্পেসকে ব্যাবহার করতে না জানা। আমাদের বিকল্পধারার সিনেমাগুলো খুর স্লো আর একঘেয়ে হয়ে যায় আর বানিজ্যিক ধারার সিনেমাগুলোতে অযাচিত গতি ব্যাবহার করা হয় যা মাথার উপর দিয়ে যায়। গতির প্রশ্নে আয়নাবাজি প্রচন্ড মাত্রায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। এক সেকেন্ডের জন্যে পর্দা থেকে চোখ সরানো যায়নি।

বর্তমানে যৌথ প্রযোজনার নামে ইন্ডাস্ট্রিতে যে দেউলিয়াপনা চলছে আয়নাবাজি তার বিরোদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ। ভারতীয় ছবি আমদানির অনুমোদন পাবার পর সালমান খান আর জিৎ এর মত তারকাদের সিনেমা যখন সুবিধে করতে পারলো না তখন সিনেমা আমদানিকারকরা বুঝে গেলো সিনেমা আমদানি করে বাংলাদেশ এর মার্কেটে সুবিধা করা যাবে না। তাই তারা ভিন্ন পথে হাটতে থাকলো। ভিন্ন পথের নাম যৌথ প্রযোজনা। রোমিও বনাম জুলিয়েট, অগ্নি 2, আশিকী, শিকারি এদের মধ্যে অন্যতম। এমন কি প্রেম কি বুঝিনি নামে একটা যৌথ প্রযোজনার সিনেমা আয়নাবাজির পাশাপাশি ম্লানভাবে শহরের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলছে। ব্যাবসায়িকভাবে খুব সফল না হলেও যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো মানুষকে আবার হলমুখী করেছে কিন্তু সিনেমার মান নিচের দিকে টানতে টানতে রাস্তায় নামিয়ে এনেছে; মানুষের মনের মধ্যে ধারনা সৃষ্টি করে দিয়েছে সিনেমা মানেই দেশের বাইরে দৃশ্যায়ন হতে হবে; ঝক ঝকে ছবিতে নাচা গানা থাকতে হবে; বস্তা বস্তা সস্তা প্রেমের গল্প থাকতে হবে; দক্ষিণ ভারতকে কপি করতে হবে; ভারত থেকে নায়ক নায়িকা গায়ক গায়িকা আমদানি করতে হবে ইত্যাদি। এই যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোর সাথে রক্ত, অস্তিত্ব, মুসাফির, অচেনা হৃদয়ের মত সিনেমাগুলো লড়ছিল কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে পারছিলো না বাজেট এর সীমাবদ্ধতা, গল্প ও নির্মান দুর্বলতার কারনে। যৌথ প্রযোজনার বাইরে যারা চিন্তা করছে আয়নাবাজি তাদের জন্য অনেক বড় একটা বিকল্প।

এবার আয়নাবাজির কিছু গুনগত আলোচনায় আসা যাক। আয়নাবাজির কাহিনী বিন্যাস প্রচন্ড গতি আনতে সক্ষম হলেও চরিত্র বিন্যাসে আয়নাবাজি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারেনি। চরিত্রগুলো সব আয়না কেন্দ্রিক ছিলো। আয়না যখন যেভাবে চেয়েছে চরিত্রগুলো সেভাবেই রঙ বদলেছে। ইউনিভারসিটি থেকে ইংলিশে মাস্টার্স পাশ করা একটা মেয়ে যথেষ্ট ম্যাচিউর্ড। তার টিনেজদের মত হঠাৎ করে তেমন বড়কোনো লজিক্যাল কারন ছাড়া আয়নার মত একটা চাল-চুলোহীন যুবকের প্রেমে পড়ে যাওয়াটাকে একটু বেশি ন্যাকামো মনে হয়েছে। এই ইলেকট্রিক মিডিয়ার যুগে আয়নার পেশাটাকে প্রচন্ড মাত্রায় অবাস্তব বলে মনে হয়। প্রকাশ্যে দিবালোকে কয়েদিদের গাড়ি থেকে আসল কয়েদিকে নামিয়ে প্রক্সি কয়েদি উঠানো গাজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। সাংবাদিক এর চরিত্রটা সারাক্ষণ আয়নার পাশে ঘুরঘুর করলেও কোনো প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বারবার সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও চরিত্রটা শেষ পর্যন্ত মখ থুবড়ে পরে। সিনেমার শেষে মনে হবে সাংবাদিক চরিত্রটা না থাকনে সিনেমার কাহিনীর তেমন কোনো সমস্যাই হত না যদিও সিনেমার পর্দাজুড়ে উল্লেখযোগ্য সময় নিয়ে ছিলো এ চরিত্রের বলিষ্ঠ পদচারণ কিন্তু তা ছিল নিছক সময় ক্ষেপণ। শুরুতে একটা লাশের পায়ে নাম্বার বাথা দিয়ে কেনো শুরু করা হলো আর কেইবা এই মহিলা পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তা স্পষ্ট না।

আয়নাবাজির অন্যতম প্রশংসনীয় দিক এর সিনেমাটোগ্রাফি। বেশকিছু বার্ডস আই ভিউ শট ও এরিয়াল শট দেখা গেছে যা বাংলা সিনেমায় খুব একটা দেখা যায় না। মাছের বাজারের হোল্ডিং লাইট যে এতটা রোমেন্টিক আবহ তৈরি করতে পারে আয়নাবাজি না দেখলে তা বুঝতে পারা দায়। পুরানো ঢাকার গলি গুপচি গুলোর নান্দনিক আবেদন যে এত বেশি তা হয়ত এর আগে কারো ভাবতেও কষ্ট হত। প্রচন্ড আবেদনময় আবহ সংগীত আয়নাবাজিকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। সবশেষে বলতে চাই আয়নাবাজি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করবে যা সৃজনশীল প্রযোজকদের আবার এ শিল্পে বিনিয়োগে সাহস যোগাবে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন