Select Page

কালজয়ী ‘বেহুলা’

কালজয়ী ‘বেহুলা’

স্বাধীনতা-পূর্ব সময় মানে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে যে কয়টা সিনেমার সাফল্য বাঙালি দর্শক তো বটেই এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের সিনেমা নিয়ে এক নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছিল তার অন্যতম ‘বেহুলা’।

সুচন্দা ও সহশিল্পীদের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন জহির রায়হান

বাংলার প্রচলিত লোককাহিনি, হিন্দু পুরাণ মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যান অবলম্বনে এই সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন কিংবদন্তি জহির রায়হান। এবং প্রযোজনা করেছিলেন ইফতেখারুল আলম।

এর আগে কখনো আসেনি, সোনার কাজল ও কাঁচের দেয়াল নির্মাণ করে প্রশংসা পেলেও বাণিজ্যিক সাফল্য আসেনি। এরপর পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ ও প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’.(দুটোই উর্দু) নির্মাণ করে বাণিজ্য সফল জহির রায়হান এবার ফিরলেন বাংলার জল-হাওয়ায়। নতুন চলচ্চিত্রের গল্প হিসেবে বেছে নেন অতিপরিচিত এ লোককাহিনি। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যান সাদাকালো হলেও সেলুলয়েডে তুলে ধরার তার উদ্যোগ সেই সময় আলোচনায় ছিল।

‘বেহুলা’ চরিত্রের জন্য সূচন্দাকে কাস্ট করেন জহির রায়হান। এটি ছিল সূচন্দা অভিনীত দ্বিতীয় সিনেমা। এর আগে তিনি প্রখ্যাত পরিচালক সুভাষ দত্তের ‘কাগজের নৌকা’য় অভিনয় করে প্রশংসা পান। এবার বেহুলারূপেও পুরোপুরি সফল।

অন্যদিকে লখিন্দরের ভূমিকায় সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়কদের পছন্দ না হওয়ায় নতুন কাউকে নেওয়ার কথা চিন্তা করেন জহির রায়হান। সেই সময়ে স্ট্রাগল করে যারা ইন্ডাস্ট্রিতে পায়ের নিচে মাটি খুঁজছেন তাদের মধ্যে একজন রাজ্জাক। জহির রায়হান সহকারীকে দিয়ে রাজ্জাককে খবর পাঠিয়ে আসতে বলেন। তাকে দেখে প্রাথমিকভাবে পছন্দ হয় জহির রায়হানের। এক সপ্তাহ দাঁড়ি না কামিয়ে আবার দেখা করতে বললেন। সাত দিন পর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে লখিন্দর চরিত্রে চূড়ান্ত করেন রাজ্জাককে। চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে এটিই ছিল তার প্রথম সিনেমা।

‘বেহুলা’র সেটে জহির রায়হান ও সুচন্দাসহ অন্যরা

এর পরেরটুকু সোনালি এক ইতিহাস। ‘বেহুলা’র পরে নায়ক ও অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তিন দশক রাজত্ব করেছেন রাজ্জাক।

সুচন্দা ‘বেহুলা’র শুটিংয়ের একটি মজার ঘটনাও শেয়ার করেছিলেন কিছুদিন আগে। সুচন্দা জানান, ‘এই সিনেমার শুটিং নিয়ে আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করছি। এই কারণে যে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে সিনেমাটি মুক্তি দিতে হবে। তখন আমরা রাত-দিন শুটিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত বোধ করেছিলাম। এই সময় গল্পের প্রয়োজনে শুটিং স্পটে লোহার বাসর ঘর বানানো হয়। আমরা যখন এই সেটে ঢুকব, তখন চাঁদ সওদাগরের কিছু শট নিচ্ছিলেন জহির। এ সময় তিনি আমাদের দুজনকে বলেছিলেন, ঘরের মধ্যে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে। খানিক বাদে আমাদের শট নেবেন। সেটে ঢুকে দেখি রানী সরকার সুন্দর করে সাজানো বাসর ঘরের খাটের ওপর বসে আছেন। এরপর আমরাও সেখানে বসি। একপর্যায়ে দুজন দুটো বালিশে শুয়ে পড়ি এবং কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে যাই তা টের পাইনি।

পরে সবাই বলেছিল আমরা নাকি অঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম। যাহোক, জহির তার অন্য কাজ শেষ করে আমাদের শট নেওয়ার জন্য সেটে ঢুকেই এ দৃশ্য দেখে এবং বাকিদের ইশারায় বললেন, কেউ যেন কোনো কথা না বলে, শব্দ না করে। তিনি নির্দেশ দিলেন পুরো বাসরঘরটি লাইটিং করতে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম, আমার গলার কাছে ঠান্ডা কী যেন একটা নড়াচড়া করছে। অকস্মাৎ তাকিয়ে দেখি, একটি কালকেউটে সাপ। চিৎকার করে উঠলাম সাপ, সাপ বলে। জহির আসলে আমার অজান্তেই আমার ওপর সাপ ছেড়ে দিয়ে শট নিচ্ছিল। এরপর তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম আপনি কথা বলবেন না। ঘুমিয়ে থাকেন আমি শট নিচ্ছি।’খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিচালকের নির্দেশে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এ সময় রাজ্জাক ও আমার হাত পাশাপাশি ছিল এবং আমি তার হাত ধরে ফেললাম চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই। ভয়ে আমি তখন জড়োসড়ো, দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বললাম, ‘রাজ্জাক সাহেব সাপ’। তখন রাজ্জাক বললেন, ‘চুপ, কোনো কথা বলবেন না।’আসলে পরিচালকের ইঙ্গিত তিনি আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সাপ আমার গলা থেকে নেমে গা বেয়ে রাজ্জাকের পায়ের কাছে যখন গেল, তখন জহির বললেন, ‘রাজ্জাক সাহেব পাটা আবার খাটের ওপর ধপাস করে ফেলেন। রাজ্জাক তাই করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই সাপটা ফনা তুললো। এভাবেই বিভিন্ন দৃশ্যগুলোর শুটিং করতে হয়েছে আমাদের।”

এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন ফতেহ লোহানী, সুমিতা দেবী, আমজাদ হোসেন, রানী সরকারসহ অনেকে। পূর্ব পাকিস্তান তো বটেই পশ্চিম পাকিস্তানেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল এই ফোক ছবি। আলতাফ মাহমুদের সুরে সিনেমার গানগুলোও জনপ্রিয়তা পায়। মোট ১৪টি গান ছিল।

১২৭ মিনিট ব্যাপ্তির ‘বেহুলা’কে ঢাকার অন্যতম কালজয়ী একটি সিনেমা বলেই আখ্যায়িত করা হয়।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন