Select Page

কালিয়া: ঈদের ছবি যেমন হতো

কালিয়া: ঈদের ছবি যেমন হতো

পড়ন্ত কৈশোরের দুরন্ত সময়ের এক ঈদে সিলেট শহরের প্রতিটি সড়কের পাশের দেয়ালে কয়েকটি সিনেমার পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। দারুণ দারুণ সব সিনেমার পোস্টারগুলোর মধ্যে অ্যাকশন কিং-খ্যাত জসিমের ‘কালিয়া’র দুটো বিশাল সাইজের পোস্টার সব বয়সী দর্শকদের নজর কেড়েছিল, যার একটি হলো নিচের ছবিটি।

প্রায় ২৭ বছর পর পোস্টারটি দেখে সেই দিনগুলোর কথা চোখে ভেসে উঠলো। ঈদের দিন থেকে সিলেটের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক সিনেমা হল নন্দিতাতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। প্রতিটি শো’তেই টিকিটের দাম নিয়ে কালোবাজারি/ব্ল্যাকারদের সঙ্গে দর্শকদের গন্ডগোল!

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি দিনগুলোতে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ছিল বাড়তি কিছু দেওয়ার লড়াই আর বাড়তি কিছু পাওয়ার আনন্দের উপলক্ষ। ঈদ মানেই সিনেমাপ্রেমীদের কাছে দল বেঁধে এক-একটি ছবি দেখার আনন্দ। ওই দুই সময়ে সব বাঘা বাঘা প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীরা বছরের সেরা ছবিগুলো মুক্তি দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা করতেন।

চাঁদ রাতে বন্ধুরা মিলে শহরের সবগুলো সিনেমা হল ঘুরে ঘুরে কোন হলে কোন সিনেমা এসেছে তা দেখে আসতাম। সেই সময়ের সিনেমার পোস্টারগুলো ছিল খুবই দারুণ ও বিশাল বিশাল সাইজের, যা দেখে আমরা মুগ্ধ থাকতাম।

১৯৯৪ সালের রোজার ঈদের আগে টেলিভিশনের পর্দায় জসিম-শাবানা-আহমেদ শরীফের একটি বিজ্ঞাপন দেখতাম যেখানে ছবির বিভিন্ন দৃশ্য দেখানোর পর মাজহারুল ইসলাম বলতেন ‘কালিয়া… কালিয়া… কালিয়া… কালিয়া…’।

পরিচালক দেওয়ান নজরুল ও অভিনেতা জসিম সেই সময়ের দর্শকদের কাছে ছিল সুপারহিট জুটির নাম । যে জুটির সিনেমা মানেই পরতে পরতে থাকবে টান টান উত্তেজনা ভরপুর কোন গল্পের ছক। দর্শকেরা যা দেখে পরিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরবে আর বহদিন ধরে সিনেমাটির গল্প বন্ধুদের বলে বেড়াবে। এ জুটির সঙ্গে যদি জননন্দিত শাবানা থাকে তাহলে তো কথাই নেই, সেই ছবি সুপারহিট হবেই হবে। সেই সময়ের একটা শিশুও এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে ।

চাঁদ রাতের সন্ধ্যায় শহরের সবগুলো হল বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে জানতে পারলাম ‘কালিয়া’ চলবে নন্দিতায়। বিশাল সাইজের পোস্টারে আক্রমণাত্মক জসিম, শাবানার রক্তাক্ত চেহারা ও আহমেদ শরিফের ভিলেনী ভঙ্গিমা দেখে পোস্টারটি পছন্দ হয়ে গেলো। মান্না ও রুবেলের সিনেমা বাদ দিয়ে ঈদের দিনই ‘কালিয়া’ দেখার সিদ্ধান্ত হলো।

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা ১৪ জন মিলিত হলাম নন্দিতার সামনে, কিন্তু বন্ধু সুমনকে না দেখে অন্যরা বলাবলি করতে লাগলো ‘সুমন আইলো না?’  সবার দুশ্চিন্তা দূর করে আরেক বন্ধু বললো, ‘সুমন আর আমি প্রায় ১ ঘণ্টা আগে আইছি, সুমন টিকিট কাউন্টারের লাইনে সবার আগে আছে।’ সুমন ছিল আমাদের মাঝে সবচেয়ে ঝানু যে শত মানুষের ভিড় ঠেলে টিকিট কিনতে পারতো।

হলের বাইরে মানুষ আর মানুষ। মানুষের দীর্ঘ জটলা হলের বারান্দা ছাড়িয়ে প্রধান সড়কের মাঝখানে এসে ঠেকেছে, যার ফলে ঈদের দিনেও যানজট লেগে গেছে। সব বাধা পেরিয়ে সিনেমা হলের ভেতরে গিয়ে বসলাম। পর্দা উঠলো … শুরু হলো ‘কালিয়া’।

কাল্লু (জসিম) একজন বেবি ট্যাক্সি ড্রাইভার। যার বোন সোনিয়া ভালোবাসে এক ধনীর সন্তান কে যে সোনিয়ার সঙ্গে প্রতারণা করে। সোনিয়ার সুখের জন্য জসিম প্রেমিক ও প্রেমিকের বাবার পায়ে পর্যন্ত ধরে কিন্তু কিছুতেই তাদের মন গলেনি। সোনিয়া কলঙ্কের অপবাদ নিয়ে না বেঁচে আত্মহত্যা করে। বোনের মৃত্যু জসিম মেনে নিতে পারে না। জসিমের দিকে হাত বাড়ায় অপরাধ জগতের কিং আহমেদ শরীফ। আহমেদ শরীফ জসিমকে অতীতের বেবি ট্যাক্সি ড্রাইভার কাল্লুর নাম নতুন নাম দেয় ‘কালিয়া’ আর শুরু হয় মূল গল্প।

 কালিয়ার দাপটে আহমেদ শরীফের শক্তি আরও বেড়ে যায়। বস্তিবাসীর প্রিয় কাল্লু ভাই যে কালিয়া সেটা তারা জানে না। আহমেদ শরীফের সঙ্গে জসিমের দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখন যখন আহমেদ শরীফ বস্তি উচ্ছেদ করতে আসে। তারা আলাদা হয়ে যায়। শুরু হয় টান টান উত্তেজনা ভরা আরেক গল্প।

এভাবে আড়াই ঘণ্টা টান টান উত্তেজনা নিয়ে দর্শকেরা সেদিন ‘কালিয়া’ দেখে বের হয়। বিনোদনধর্মী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একটা চমৎকার উদাহরণ ‘কালিয়া’, যে ছবিতে দর্শকদের বোর হওয়ার একটু সুযোগ নেই। ১০ মিনিটের একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিল গাঙ্গুয়া যা ছিল দুর্দান্ত। ওই ভয়ানক রূপে গাঙ্গুয়াকে দর্শকেরা আজও মনে রেখেছে। শাবানার কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন দেখছি না। শাবানার কথা বলতে গেলে লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। শুধু এইটুকু বলবো শাবানাকে টপকে যাওয়া যেকোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাছে একটা অনেক কঠিন একটা চ্যালেঞ্জ যা কেউ কোনো দিন করতে পারেনি। শাবানার জায়গায় শাবানায় ছিলেন অসাধারণ।

যে শাবানাকে বছর খানেক আগেই দেওয়ান নজরুল ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমায় জসিমের বড় বোনের চরিত্রে রেখে বাজিমাত করেছিলেন সেই দেওয়ান নজরুল ‘কালিয়া’য় প্রেমিকা চরিত্রে শাবানাকে দিয়ে বাজিমাত করলেন। শাবানা ছিলেন অনবদ্য। বস্তিতে আহমেদ শরীফের লোকজন যখন জসিমকে খুঁজতে এসে না পেয়ে বস্তিবাসীর ওপর অত্যাচার করছিল, শাবানাকে নির্যাতন করছিল তখন শাবানার বলা ‘কালিয়া আমার জীবন, কালিয়াকে আমি আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি, পারলে নিয়ে যা’ সংলাপটিতে শাবানার এক্সপ্রেশন ছিল দুর্দান্ত। অনেক উঁচু মানের অভিনেত্রী ছাড়া এমন একটি দৃশ্য রাগ, ক্ষোভ , সাহস ও ভালোবাসার সংমিশ্রণের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়— যা শাবানা প্রমাণ করেছেন। শাবানা ছিলেন একজন জাত অভিনেত্রী যাকে যেকোনো ভূমিকায় পর্দায় রাখলে দর্শকেরা তা মেনে নিবে এবং শাবানা সেই চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলবেনই কোন সন্দেহ নাই ।

আজ থেকে ২৫ বছর আগে জসিম যে অ্যাকশন দেখিয়েছে আজকের কোন চলচ্চিত্র সেই মানের অ্যাকশন দৃশ্য কল্পনাও করতে পারবে না। আজও ঈদ আসে ঈদে নতুন সিনেমা আসে কিন্তু আরেকটি ‘কালিয়া’ আসে না। ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপনে কী ধরনের বাণিজ্যিক সিনেমা মুক্তি দিতে হয় সে সম্পর্কে সম্ভবত গত দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত প্রযোজক, পরিচালক ও পরিবেশকদের কোন ধারণাই নেই।


মন্তব্য করুন