Select Page

জসিমকেন্দ্রিক ১৪ সিনেমা

জসিমকেন্দ্রিক ১৪ সিনেমা

জসিম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা অভিনেতা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে শক্ত পাটাতনে দাঁড় করাতে যাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে জসিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অ্যাকশন কিং জসিমের ক্যারিয়ারে অনেক ছবিতেই জসিম কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিল। যেসব ছবির নামকরণ তাঁকে কেন্দ্র করে হয়েছে বা গল্পের কেন্দ্রবিন্দু জসিম ছিল এমন ছবিগুলোকেই আমরা ‘জসিমকেন্দ্রিক ছবি’ বলব। সেসব ছবি নিয়েই এ আয়োজন।

ভাইজান (১৯৮৯)

রায়হান মুজিব পরিচালিত ছবি। বোনের সুখের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক অনন্য নজির স্থাপন করা ভাইয়ের ছবি হলো ‘ভাইজান’। সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘বাপজান, বাজান, ভাইজান’ এভাবে প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে মিশে থাকে অগাধ শ্রদ্ধা। জসিম এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। শাবানার বড়ভাই। শাবানাকে পড়াশোনা করাতে নিজে চানাচুর বিক্রেতা থাকে। মায়ের হত্যাকারী লাটবাহাদুর গোলাম মোস্তফাকে শাস্তি দিতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। একসময় শাবানার বিয়ে হলে শ্বশুর হয় মোস্তফাই। তখন জসিমই লাটবাহাদুর হয়ে ওঠে এবং মোস্তফার পতন ঘটে। জসিম তার সর্বস্ব বিক্রি করে দেয় শাবানার সুখের জন্য এবং নিজের পূর্বের পেশায় ফিরে যায়। অসাধারণ নির্মাণ ও অভিনয়ের ছবি এটি। জসিমের বিপরীতে ছিল অঞ্জনা।

টাইগার (১৯৯৭)

জিল্লুর রহমান পরিচালিত ছবি। ‘টাইগার’ জসিমের অ্যাকশন ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। পাহাড়ি একটি অঞ্চলে পুলিশ অফিসার হয়ে আসে জসিম। সেখানকার যাবতীয় অনিয়মের বিরুদ্ধে জসিম প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আহমদ শরীফকে এক ঘুষিতে দাঁত ফেলে দেওয়ার শটটি ছিল জসিমের সেরা অ্যাকশন দৃশ্য। তার চক্রান্তে জসিম পুলিশ থেকে অপরাধী হয়ে ওঠে এবং তখন তাঁকে বিভিন্ন গেটাপে দেখা যায় প্রতিশোধ নিতে। বিপরীতে ছিল ববিতা।

কালিয়া (১৯৯৪)

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ছবি। বহুল জনপ্রিয় একটি ছবি ‘কালিয়া’। সাধারণ ‘কাল্লু মিয়া’ থেকে ‘কালিয়া’ হয়ে ওঠার জমজমাট ছবি এটি। অপরাধ জগতে একজন সাধারণ মানুষের প্রবেশের গল্প। জসিমকে জোর করে মদ খাওয়ায় আহমদ শরীফের দল। ঐ সিকোয়েন্সটি ছিল সেরা। ভরপুর অ্যাকশন ছবি।  বিপরীতে শাবানা।

গরিবের ওস্তাদ (১৯৯৬)

জিল্লুর রহমান পরিচালিত ছবি। ‘গরিবের ওস্তাদ’-ও বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় ছবি জসিমের। কুলির ওস্তাদ থেকে গরিবের ওস্তাদ হয়ে ওঠে প্রতিবাদী জসিম। বোন শাবনাজের বিয়ের পর তার পরিবারে গেলে আহমদ শরীফ জসিমকে অপমান করে। বড়লোকের বাড়িতে ভাত খেয়ে অপরাধ করেছে জসিম এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেখানে জসিম নিজের পেটে আঘাত করে ভাত বের করে দেয়। এটি ছিল ছবির সেরা একটি সিকোয়েন্স। বিপরীতে ছিল শাবানা।

বাংলার নায়ক (১৯৯৫)

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত জসিমের অন্যতম সেরা অ্যাকশন ছবি। প্রতিবাদী জসিম এ ছবিতে ডনের ভূমিকায় অবতীর্ণ। শাবানার সাথে তার যুদ্ধ চলে। পরিস্থিতি অনুযায়ী তার পরিবর্তন ঘটে। বস্তিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রুদ্ররূপী জসিমকে শাবানার বলা সংলাপ ‘জাগো বাংলার নায়ক জাগো’ সেরা ছিল। বিপরীতে ছিল শাবানা।

হাবিলদার (১৯৯৫)

আবিদ হাসান বাদল পরিচালিত ছবি। সাদামাটা গল্পের ছবি। জসিম পুলিশের একজন হাবিলদার থাকে। নিজের কাজটিকে দায়িত্বের সাথে পালন করে এবং তা করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তার জুড়ি নেই। বিপরীতে ছিল নূতন।

সন্ত্রাসী রাজা (১৯৯৬)

এম এ মালেক পরিচালিত ছবি। জসিমের অ্যাকশন ছবির মধ্যে স্টাইলিশ একটি ছবি। পুরো ছবিতে তাঁর স্টাইলিশ গেটাপ নজর কাড়ে। ডনের ভূমিকায় অবতীর্ণ। নিজের বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতায় তার ভাগ্যে পরিবর্তন আসে। একসময় জসিম তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মিশন শুরু করে। বিপরীতে ছিল নূতন।

রকি (১৯৮৬)

আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ছবি। জসিম এ ছবিতে বক্সার থাকে। ডাবল রোলের ছবি। বাবা বক্সার জসিমকে খলিল খুন করে ষড়যন্ত্র করে। ছেলে জসিমও বক্সার হয়ে ওঠে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে বাবার প্রতিদ্বন্দ্বী বক্সার জাম্বুর বিপরীতেই লড়ে। ঐ সময়ের তুলনায় ছবিটি সুনির্মিত ছিল। ‘রক রকি রকি আমার নাম’ গানটি জনপ্রিয়। বিপরীতে ছিল সুচরিতা।

জিদ্দি (১৯৯৯)

মনোয়ার খোকন পরিচালিত ছবি। সমাজের প্রচলিত অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জসিমের অনবদ্য একটি ছবি। বোন কবিতার অসম্মানকে কেন্দ্র করে রাস্তার গুণ্ডার হাত কেটে ফেলে জেলে যায় জসিম। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে রূপ বদলে ফেলে কৌশলে কবিতাকে বিয়ে করে যে ছিল আহমদ শরীফের ছেলে। নকল লোহার হাতের আঘাতে কবিতা বিয়ের রাতেই খুন হয়। আদালতে মামলা গড়ালেও রায় যায় খুনির পক্ষেই এবং জসিমের বাবা ও ভাই খুন হয় সেদিনই। মৃত্যুর আগে বাবা আনোয়ার হোসেন জসিমকে বলে যায়-‘আজ আর তোকে বাধা দেবো না, মানুষকে মারিস না কিন্তু অমানুষকে ছাড়িস না।’ জসিম প্রতিশোধ নিতে থাকে। শাবানার বাড়ির সামনে উত্যক্ত করা গুণ্ডাদেরও শায়েস্তা করে জসিম। ঐ সিকোয়েন্সটিও অনবদ্য। বিপরীতে ছিল শাবানা।

লালু মাস্তান (১৯৮৭)

এ জে মিন্টু পরিচালিত ছবি। জসিমের প্রথমদিকের অ্যাকশন ছবি। ভিলেন থেকে নায়ক হবার পর যে ছবিগুলো দিয়ে অ্যাকশন হিরোর ইমেজ তৈরি হয়েছিল এ ছবিটি তখনকারই। বস্তি গুড়িয়ে দিতে বুল্ড্রজার নিয়ে আসে গুণ্ডারা সেখানে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়ায় জসিম। পরে ঘটনাচক্রে মাস্তান হয়ে ওঠে। ছবিতে জসিমের গেটাপ ছিল দেখার মতো। বিপরীতে ছিল শাবানা।

জোর (১৯৯৯)

মোতালেব হোসেন পরিচালিত ছবি। এটি জসিমের শেষ ছবি ছিল। বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ ছবিতে জসিমের লিপে আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘আশা ও আশা আমার ছোটবোন’ গানটি অসাধারণ। শাকিল খান ও পপিও ছিল। পপিকে জসিম বোনের জায়গা দেয়।

লাট সাহেব (১৯৯৯)

হাফিজ উদ্দিন পরিচালিত ছবি। জসিম ও শাবানার ভাইবোনের চরিত্রের মধ্যে এটি অন্যতম ছবি। সোহেল রানার সহায়তায় জসিম লাট সাহেব হয়ে ওঠে। অন্য বেশ ধরে কৌশলে বোন শাবানার উপকার করতে থাকে কিন্তু শাবানা ভাইকে চিনতে পারে না। দারুণ উপভোগ্য ছবি।

মাস্তান রাজা (১৯৯৩)

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ছবি। সাধারণ যুবক থেকে মাস্তান জসিম হবার গল্প। ছোটবেলায় মাস্তান গাংগুয়া জসিমের কামাই করা টাকা রাতের অন্ধকারে কেড়ে নিয়েছিল ট্যাক্সের কথা বলে। বড়বেলায় এসে জেল থেকে বের হয়ে সেই গাংগুয়াকেই পথে দেখতে পায় জসিম। তখন তাকে আর তার বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দেয়। ঐ ফাইটিং সিকোয়েন্সটি সেরা ছিল। জসিমের বডি ল্যাংগুয়েজ জাস্ট অসাম সেখানে। এ ছবিতে শাবানা জসিমের বড়বোন এবং জসিমের বিপরীতে ছিল দিতি।

রাজা গুণ্ডা (১৯৯৪)

রায়হান মুজিব পরিচালিত ছবি। এ ছবিতে জসিম পুলিশ অফিসার থেকে ঘটনাচক্রে গুণ্ডা হয়ে যায়। জসিমের ছোটভাই সোহেল চৌধুরী গুণ্ডা থেকে পুলিশ অফিসার হয়ে যায় এবং জসিমকে সঠিক পথে ফেরাতে চেষ্টা করে। আহমদ শরীফের সাথে জসিমের ভিলেন-হিরো কেমিস্ট্রির সেরা ছবি এটি। আহমদ শরীফ বিশেষ এক বাঁশি বাজিয়ে উদযাপন করে ছবির শেষে বাঁশিটি জসিম বাজায় এবং বাজানোর স্টাইল ছিল জাস্ট অসাম। বিপরীতে ছিল দিতি।

এ ছবিগুলো ছাড়াও আরো কিছু ছবিতে জসিম কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিল। রিপিটেড চরিত্র হওয়াতে সেগুলো ততটা উজ্জ্বল না তবে জসিমের অ্যাকশন হিরোর ইমেজে সে ছবিগুলোর অবদান ছিল। এমন আরো কিছু ছবি হলো – ডাকাত, মোহাম্মদ আলী, রাজা বাবু, সাহস, হিরো, দাগী সন্তান, বিস্ফোরণ, হুঁশিয়ার।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশনের প্রতিষ্ঠাতা ছিল জসিম। নায়করাজ রাজ্জাকের ‘রংবাজ’ ছবির মাধ্যমে জসিমের হাত ধরে শুরু হয়। এ ছবিতে রাজ্জাকের সাথে তাঁর ফাইটিং আছে। প্রথমদিকে ভিলেন হয়ে সুনাম অর্জনের পর নায়ক হয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল জসিম। নায়ক জসিমের কেন্দ্রীয় চরিত্রের ছবিগুলো দেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশনকে আরো সমৃদ্ধ করেছে যা এ প্রজন্ম ও ভবিষ্যত প্রজন্মের নায়কদেরও উদ্বুদ্ধ করবে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন