Select Page

খলনায়কের টিপিক্যাল ধারা ভেঙে আলাদা ইমেজ তৈরি করেন রাজীব

খলনায়কের টিপিক্যাল ধারা ভেঙে আলাদা ইমেজ তৈরি করেন রাজীব

ওয়াসিমুল বারী রাজীব; যাকে সবাই বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিশালী অভিনেতা  রাজীব নামেই চেনেন। যিনি ছিলেন আপাদমস্তক বাংলাদেশি অভিনেতা ও বাংলাদেশি সংস্কৃতির বীরযোদ্ধা।

বাংলা চলচ্চিত্রের ৮০ ও ৯০ দশকের নিয়মিত দর্শকদের কাছে ‘রাজীব’ নামটি খুবই পরিচিত ও প্রিয় একটি নাম। নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি পর্দায় যারা আলাদাভাবে নিজেদের চিনিয়েছেন ও দর্শকদের ভালোবাসা অর্জন করেছেন তাদের অন্যতম রাজীব। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের খলনায়কদের টিপিক্যাল ধারা ভেঙে আলাদা ও শক্তিশালী একটি ইমেজ তৈরি করেছিলেন।

রাজীব ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। সিনেমায় শুরুটা হয়েছিল নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। ১৯৭৯-৮০ সালে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ সিনেমার নায়ক হয়ে চলচ্চিত্রে আগমন। এরপর কাজী হায়াতের ক্ল্যাসিক ছবি ‘খোকন সোনা’র মাধ্যমে দর্শকের মন জয় করেন। ছবিটি সেই সময়ের গতানুগতিক ধারার চেয়ে একটু ভিন্ন ধাঁচের ছিল, যার দেখেছিলেন তাদের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। ছবিতে রাজীব ছিলেন ৮ মাস বয়সী শিশু খোকনের বাবা যিনি অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হন। নবাগত রাজীবের অভিনয় দৃষ্টি কাড়লেও পরবর্তীতে নায়ক হিসেবে আর কোন ছবিতে দেখা যায়নি; বরং শক্তিশালী খলনায়ক হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

১৯৮০ এর দশকে হুঁশিয়ার, ভাত দে, সত্য মিথ্যা, উছিলা, বীরাঙ্গনা সখিনা, প্রতারক, স্বামী স্ত্রী, স্বর্গ নরক, স্বাক্ষর, সন্ধি, সন্ধান, প্রতিরোধ, বিস্ফোরণ ছবিগুলোতে দুর্দান্তভাবে অভিনয় করে খলনায়ক হিসেবে সবার নজর কাড়েন রাজীব। এরপর ৯০ এর দশকে চোরের বউ, বন্ধন, অচেনা, মা মাটি দেশ, খুনি আসামী, বেনাম বাদশা, টাকার অহংকার, দাঙ্গা, ত্রাস, চাঁদাবাজ, প্রেম দিওয়ানা, মহৎ, দুর্নীতিবাজ, মীরজাফর, মিথ্যার রাজা, বিক্ষোভ, জিদ, খলনায়ক, কে আমার বাবা, লুটতরাজ, দেশদ্রোহী, বিদ্রোহী কন্যা, শয়তান মানুষ, হুলিয়া, শেষ খেলা, প্রিয় তুমি, স্বপ্নের পৃথিবী , ভণ্ড সহ অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রের চিরদিনের সেরা খলনায়কদের তালিকায় স্থান করে নেন।

শুধু খলনায়ক বা নেগেটিভ চরিত্রে নয় পজিটিভ চরিত্রেও রাজীব সফল ছিলেন। বাবার আদেশ, অন্তরে অন্তরে, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, জুম্মন কসাই, আসামী গ্রেফতার, বিদ্রোহ চারদিকে ছবিগুলোতে রাজীবের অভিনয় দর্শকদের কাঁদিয়েছিল। বিশেষ করে বাবার আদেশ, অন্তরে অন্তরে, জুম্মন কসাই ছবিগুলোর অভিনয় দেখে যেকোনো দর্শক বিস্মিত হবেন যে, এই লোকটিই অন্য ছবিতে কত ভয়ংকর অভিনয় করেছিলেন।

খলনায়ক রাজীবের শ্রেষ্ঠতম দুটো ছবি কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘চাঁদাবাজ’। ‘দাঙ্গা’ ছবির ভাড়াটে খুনি কালু চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র শাখায়। রাজীবের অভিনয় এতটাই দর্শকদের মুগ্ধ করে যে ‘দাঙ্গা’র নাম উঠলেই দর্শক তার কথা সবার আগে মনে করে। রাজীবের ‘আমি মাইন্ড করলাম’ সংলাপটি সেই সময় মুখে মুখে ছিল। ঠিক এক বছর পর ১৯৯৩ সালে কাজী হায়াতের ‘চাঁদাবাজ’ ছবির জন্য খলনায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছবিতেও রাজীব এতটাই ভয়ংকর যে চোখ দুটো দেখলেই ভয় লাগতো। যেকোনো খল অভিনেতার জন্য ‘দাঙ্গা ও ‘চাঁদাবাজ’ ছবির রাজীবের অভিনয়টা শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় । 

রাজীবের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল চরিত্রের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যাওয়া, সংলাপ বলার ধরন ও কণ্ঠ। দেশের খল অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোরালো কণ্ঠ ছিল রাজীবের, যা তাকে বাকি অভিনেতাদের থেকে আলাদা করেছে। প্রতিটি সংলাপ খুব স্পষ্ট করে বলতেন ।

অভিনয় ছাড়াও বন্ধু মিজু আহমেদের সঙ্গে ‘ফ্রেন্ডস মুভিজ’ নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা খোলেন রাজীব। তাদের প্রযোজিত ছবিগুলোর মাঝে আসামী গ্রেফতার, চালবাজ, রক্তের অধিকার উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৬ সালে পুকুরে ডুবে রাজীবের দুই কিশোর পুত্র জয়-বিজয় মারা যায়; যা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত।

রাজীব ২০০১-২০০৪ সাল পর্যন্ত বিএফডিসির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

রাজীব চারবার জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘হীরামতি’ ছবির জন্য প্রথমবার পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এরপর যথাক্রমে দাঙ্গা (১৯৯১), চাঁদাবাজ (১৯৯৩) ও বিদ্রোহ চারিদিকে (১৯৯৯) ছবির জন্য একই বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন।

রাজীব দীর্ঘদিন লিভার ক্যানসারে ভুগে ২০০৪ সালে ১৪ নভেম্বর মারা যান।  তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু আপন কর্মগুণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দর্শকদের হৃদয়ে ও ইতিহাসে চিরদিনের জন্য বেঁচে আছেন ও থাকবেন। এমন একজন অভিনেতা সব যুগে সবকালে পাওয়া যায় না।

ছবি সংগ্রহ: আজাদ আবুল কাশেম


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

ফজলে এলাহী (কবি ও কাব্য)

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন