Select Page

গল্প বাছাইয়ে সার্থক ‘অসময়’

গল্প বাছাইয়ে সার্থক ‘অসময়’

দীর্ঘ ইন্ট্রোর পর প্রথম দৃশ্য যখন দেখলাম তখন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হিসেবে কিছু নস্টালজিয়া ধরা পড়লো। বঙ্গতে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ওয়েব ফিল্ম ‘অসময়’-এর প্রথম দৃশ্যের কথা বলছি। চারজনের একটা পরিবার, বড়মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে না পারায় বাবা বকাঝকা করছেন আর ছোটছেলে ভয় পেয়ে জোরে শব্দ করে রিডিং পড়তে শুরু করেছে। পরদিন বাবা অফিস থেকে ফেরার সময়ে ভাইবোন আর মা মিলে টিভি দেখছিলো; বাবা দরজায় নক করতেই টিভি বন্ধ করে দৌড়ে সবাই যার যার টেবিলে পালালো।

হুমায়ুন আহমেদ এর নাটকগুলোর ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারকে সেলুলয়েডে কিছুটা বন্দি করতে পেরেছিলেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। তারপর একটা দীর্ঘ গ্যাপ। এর ভেতর আমাদের নাটকগুলো টিভি থেকে ইউটিউবে যেতে শুরু করেছে, ওটিটি এলো,  ওয়েব সিরিজ আর ওয়েব ফিল্মের জয়জয়কার; এসবের ভেতরে কমপ্লিকেটেড স্টোরি ভাবতে গিয়ে এই সাবলীল আর পরিচিত গল্পগুলোর কথা আমরা যেন ভুলতেই বসেছি। পরিচালক কাজল আরেফিন অমি অনেকদিন পরে এমন কিছু দৃশ্য তুলে আনলেন পর্দায়।

‘অসময়’ মধ্যবিত্ত ঘরের এক মেয়ের প্রাইভেট ভার্সিটিতে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর ইকোনমিক্যালি অসম কিছু বন্ধুদের সাথে মিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন শুরু করা, সেখানে দূর্ঘটনাবশতঃ একটি মার্ডারের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে যাওয়া এবং এই দূর্ঘটনাকে ঘিরে ফাংশন করা কিছু মানুষের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন গল্পকে ঘিরে তৈরি হওয়া একটি ওয়েবফিল্ম। মুশফিকুর রহমান মঞ্জুর প্রযোজনায় এবং কাজল আরেফিন অমির রচনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত ওয়েবফিল্মটি সম্প্রতি বঙ্গতে সর্বোচ্চ ভিউর রেকর্ড করেছে।

আরো পড়ুন: বড়পর্দায় মুক্তি দেয়ার মতো ‘অসময়’

‘অসময়’ যেন ঢাকা শহরকে বারবার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেই আয়নার এক পাশে নগরবাসী আর অন্যপাশে ঢাকা শহর। ২০২৪ সালের ঢাকা শহর পূর্বেকার চেয়ে কিছুটা আলাদা বটে৷ এই ঢাকা শহরে মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বাড়তে বাড়তে এক মেকি পরাবাস্তবতায় বাস করতে হয়; দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বশ্বাস, ক্ষমতার রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের জয়জয়কার; সোশ্যাল সারকামফারেন্সের প্রতিটা স্তরেই ক্ষমতা তীব্রভাবে শাসন করছে। ‘অসময়’ কোথাও একটা গিয়ে বারবার আমাদের সামনে এই ফ্যাক্টসগুলোকে হাজির করিয়ে দিয়েছে। রচনার পরে কমাহীন (,) চিত্রনাট্য লেখা কাজল আরেফিন অমির ‘অসময়’কে ধরতে চেষ্টার জন্য বাহবা প্রযোজ্য।

এই ঢাকাকে পর্দায় বারবার দেখা গেছে ক্যামেরার ইউনিক সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে। মেট্রোরেলের দৃশ্য, রাতের ঢাকা শহর, হাতিরঝিল, ড্রোনের কারিশমা সব মিলিয়ে সিনেমাটোগ্রাফার ফুয়াদ বিন আলমগীর ‘ঢাকা বদলাচ্ছে রোজ’ ধাঁচের ভিজ্যুয়ালাইজেশন হাজির করেছেন। তবে যে মৃত্যুকে ঘিরে গল্পটা এগিয়েছে সে মৃত্যুর দৃশ্যে অর্থাৎ প্রিন্সের মৃত্যুর দৃশ্যে এত নড়বড়ে সিনেমাটোগ্রাফি ছিলো যা দেখে মনোযোগ নষ্ট হবে। লংশটে উর্বির গোটা পরিবারের বেড়াতে যাওয়া, রাতের দৃশ্যে বিভিন্ন লোকেশান এর উপর ফ্রেম এর এংগেল ঠিক করা এ ব্যাপারগুলো নান্দনিক বটে।

কালার গ্রেডিংয়ের দিক থেকে ‘অসময়’ একটি মানসম্মত পরিবেশনা বটে। তার সাথে ছিলো আর্ট ডিরেক্টর জি কে গৌতমের মুন্সীয়ানাও। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে প্রায় প্রত্যেকটা ক্যারেক্টারের জন্যই তার সারকামফারেন্সকে আলাদা ধাঁচে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘অসময়’ এ। ‘অসময়’ এর ইনট্রো ভিডিওটাও বেশ ইউনিক। এডিটর চেষ্টা করেছেন টানটান ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করার। সে চেষ্টাও প্রশংসনীয়। কিন্তু কিছু এডিটের গড়বড় খুব সহজেই চোখে পড়বে। মোখলেস এর ছিনতাইকারীদের হাতে পড়বার মুহুর্তে পেছন থেকে গাড়ি আসা, থেমে যাওয়া, আবার আসা মানে কন্টিনুইটি থাকে নি। ইন্তেখাব দিনারের মেকাপেও ছিলো কন্টিনুইটির অভাব। তার বউয়ের সাথে মারামারি করে ঘর থেকে বের হওয়ার দৃশ্যে মুখে ক্ষতচিহ্ন না থাকলেও পরের দৃশ্যে মদ খাওয়ার সময় যে ক্ষতচিহ্নটা দেখা গেছে সেটাও খাপছাড়া। চিত্রনাট্যের সাথে এডিটের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক সেটায় কমতি দেখা গেছে।

বাংলাদেশের ওটিটি কাজের সাউন্ড ডিজাইনিংয়ে এ মুহুর্তে পরিচালকের আস্থার নাম রিপন নাথ। ‘অসময়’ এও রিপন নাথ তার নামের সুবিচার করেছেন। ফলি, ন্যাচারাল সাউন্ড আর ডাবিংয়ের সমন্বয় ছিলো গোটা সময়েই। বৃষ্টির সাউন্ড, পানি পড়ার শব্দ, গাড়ির শব্দ ইত্যাদি প্রত্যেক দৃশ্যেই খাপে খাপ। জাহিদ নীরবের তৈরি আবহ সংগীত আর চিরকুটের গানকেও ভালো বলা যায়।

আরো পড়ুন: ‘অসময়’ মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প

ওটিটির কাজে সচরাচর বোল্ড ক্যারেক্টারে দেখতে পাওয়া তাসনিয়া ফারিনের জন্য উর্বি তথা সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করা একটা মেয়ের চরিত্রে কাজ করা চ্যালেঞ্জিং ছিলো। তাসনিয়া ফারিন সেরা অভিনয় করেছেন তা বলা কঠিন। কিন্তু চিত্রনাট্যের প্রয়োজন অনুসারে যেটুকু দেওয়ার তা দিয়েছেন। চরিত্রটায় আপ্স এন্ড ডাউন্স ছিলো। ফারিন সে মোতাবেক ভালই  করেছেন। ফারিনের স্ক্রিন প্রেজেন্স এ  আকর্ষণের কিছুটা কমতি ছিলো কস্টিউমের কারণে। কস্টিউম সিলেকশনে আরেকটু চিন্তা করতে হতো ডিজাইনারের।

‘অসময়’ এর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জুটি মোখলেস এবং হালিমের জুটি। সাংবাদিক হালিম চরিত্রে সারাফ আহমেদ জীবন আর মোখলেস চরিত্রে ইরেশ যাকেরের পারফরম্যান্স গোটা সময়জুড়েই দর্শককে বিনোদিত করেছে। তবে সারাফ আহমেদ জীবনের অভিনয়ের কথা বললে অভিনয় এ নতুনত্ব ছিলো বলা যায় না। কেবল গল্পটার সাথে তার কমন অভিনয়ের মেলবন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে। রুনা খান, ইন্তেখাব দিনার সে অর্থে ভালো অভিনয় উপহার দিতে না পারলেও তারিক আনাম খান এর অভিনয় বরাবরই ভালো ছিলো। শুরুর দিকের অতিশয় স্বামীভক্তির নিরস অভিনয় বাদ দিলে মনিরা আক্তার মিঠুর অভিনয় ভালো ছিলো, শাহেদ আলীর আইনজীবী চরিত্রটাও ইন্টারেস্টিং।

বলাবাহুল্য, ‘অসময়’ এর বেশিরভাগ নবাগত জুনিয়র আর্টিস্টদের অভিনয় অত্যন্ত কাঁচা ছিলো। সম্ভবত পরিচালক নিজেও চরিত্রগুলোর উপর বিশেষ নজর রাখেন নি।

‘অসময়’ গল্পের বিচারে একটি কোয়ালিটি কনটেন্ট। কিন্তু চিত্রনাট্যের বিচারে একই বিশেষণ ব্যবহার করা কঠিন। কোর্টরুমের প্লট এ ‘অবজেকশন সাস্টেইন্ড, অবজেকশন ওভাররুলড’ এসব টার্ম এর বাইরে লজিক কিংবা পয়েন্ট দাঁড় করানোর ফ্যালাসিগুলো এতই দূর্বল ছিলো! ছিলো তাড়াহুড়ার একটা ব্যাপারও।  শেষদিকে তাড়াহুড়ো স্পষ্ট, এন্ডিংয়ে তড়িঘড়ি করার কারণও স্পষ্ট। ‘অসময়’ এর ডিউরেশন ছিলো ২ ঘন্টা ৪৬ মিনিটের। এত লম্বা একটা সময় ধরে দর্শককে স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে রাখা ওটিটির এই সময়ে কঠিন। তার উপর এতবেশি সাবপ্লট, কিছুক্ষেত্রে অহেতুক সাবপ্লট আর ডায়ালগ তৈরি করা (থানায় মোখলেস এর সাথে হালিমের অযথা গল্প, উর্বির বন্ধুদের সাথে আলাদা আলাদা দৃশ্য আরোপ করা ইত্যাদি) আর  এতবেশি প্যারালাল স্টোরির এপিয়ারেন্স এখানে যে গল্পে সবগুলো ক্যারেক্টারকে একটা সুতোয় বাঁধতেই সময় চলে যায় বেশিরভাগ। যার কারণে শেষদিকে তাড়াহুড়োয় না গিয়ে পরিচালকের উপায় ছিলো না।

ডায়ালগেও ছিলো গভীরতার অভাব। হেডলাইনে “এমপি হব তাই অভিনয় করতে এসেছি” ধরণের লঘু স্যাটায়ার, কখনো কখনো অভিব্যক্তি কিংবা পরোক্ষ সংলাপের জায়গায়ও সরাসরি ডায়ালগ ডেলিভারি এসব মিলিয়ে চিত্রনাট্য মনোরম বলা যায় না। ছিলো কিছু মৌলিক অসামঞ্জস্য। মেয়েকে ভার্সিটিতে ভর্তি করার পরেরদিনই বাবা তার অফিসে মেয়ের মিডটার্মের গল্প করেন কিভাবে? কিংবা তার পরপরই আবার মেয়ে তথা উর্বির বন্ধুরা তাকে মিডটার্ম সামনে বলেই ট্রিট দেওয়ার ব্যাপার আসে কি করে! সবচেয়ে বড় কথা এই অহেতুক দৃশ্যগুলো না থাকলেও গল্পটাকে ভালোই বলা যাচ্ছিলো, খারাপ নয়। তবে অমি ফিল্মের সিন্ডিকেটি ব্যাপার, কিংবা আইডিয়া চুরি এই ধরণের প্রাসঙ্গিক কিছু জিনিসও হাজির করেছেন চিত্রনাট্যে। আর এতগুলো ক্যারেক্টারকে এস্টাবলিশও করেছেন ভালোভাবেই। এটাও পজেটিভ দিক। কিন্তু ডিউরেশনের চিন্তা করলে এইটুকু ছাড় দেওয়া চলে না।

‘অসময়’ এর সার্থকতাই এখানে যে পরিচালক স্টোরিটেলিংয়ের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের একটা ডকুমেন্টেশন পোর্ট্রে করেছেন। গল্পহীনতার এই সময়ে ‘অসময়’ নিজেও যেন মনে করিয়ে দেয় আমরা ভালো গল্পের কতটা অভাববোধ করছি।


About The Author

সাইদ খান সাগর

সিনেমাকর্মী

Leave a reply