চাকমা গীতের আলোকে
‘প্রথম বৈশাখ মাস দেবায় গল্য কালা
আমারে ছাড়ি মেয়া কারে দেখা ভালা
তুমি ছাড়িলে মেয়া আমি না ছাড়িব
রাত্রি কালে নিদ্রা গেলে স্বপনে দেখিব’
(মেয়াবী বারমাস)
[দেবা-মেঘ। গল্য-করল। মেয়া-বন্ধু]
কোন জাতির আচার, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, প্রেম, দুঃখ, ভূগোল সবচেয়ে বেশি প্রস্ফুটিত হয় তার গানে ও সাহিত্যে। চাকমাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তার না হওয়ার কারণে সাহিত্যে তেমন একটা প্রতিভা চোখে পড়ে না। তবে তাদের যে গানের ভাণ্ডার এবং সুরবৈচিত্রতা— নিঃসন্দেহে মুগ্ধ করবে যে কাউকে। চাকমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে গান। চাকমারা গান নয়; বলে গীত। লোকগীতই তাদের বড় সম্পদ। সবুজ অরণ্য ঘেরা জীবন, মাতাল নির্ঝরিনী, বিবিধ ধর্মীয় উৎসব, জীবনাচার ও পল্লী জীবনের প্রণয় কাহিনী নিয়ে গীত বেধেছেন পল্লীকবিরা। এইসব পল্লীগীত যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। বাংলা বারো মাসের ঋতুবৈচিত্র্যতা ও প্রতিটি ঋতুবৈচিত্র্যতার মধ্যে যে চাকমা জীবনের বহুমুখী রূপ তার স্বর শুনি আমরা লোককবিদের কণ্ঠে—
চাকমা ভিডিও সং ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া ছবি
‘ভাদ্র মাসেতে মেয়া ধানে ধল্য পাক
কোথায় গেলে পাব মেয়া তোর লাক।
মুই যদি মেয়া তোর লাগত পেদুং
বাহু ধরিয়া তোরে কোলে তুলি লদুং।
উরি যাদে ব্যঙ্গমা পক্ষী ব্যাধ হাতে পড়ে
ললাটে লিখন ফল খন্ডাইতে না পারে।
আশ্বিন মাসেতে মেয়া বরিষা অয়ে শেষ
যে দিকে যেয়ে মেয়া, করিম উদ্দেশ।
কালা কালা ককিলা কালা কালা মাথার কেশ
খঞ্জনের বুক কালা ঘুরে নানান দেশ
নানা দিকে করি আমি ভ্রমণ ভুবন
মেয়ার দরশনে পুরাইতুং মন
তুমি ছাড়ি গেলে মেয়া কান্দিতে থাকিব
সন্ন্যাসীর বেশ ধরি উদ্দেশ করিব।’
(মেয়াবী বারমাস)
[ধল্য-ধরল। লাক-দেখা। পেদুং-পাইতাম। লদুং-লইতাম। উরি-উড়ে। অয়ে-হয়। করিম-করব। পুরাইতুং-পুরাইতাম]
চাকমাদের জীবন আদিকাল থেকে প্রকৃতি নির্ভর। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ মেখেই তাদের বেড়ে ওঠা। বর্তমানে কেউ কেউ উন্নত জীবনের সন্ধানে পাহাড় ছেড়ে শহরমুখী। তবে অধিকাংশেই ভুলতে পারেনি তার ঐতিহ্যকে। এখনো কোনো চাকমা বন্ধুকে তার মনের অজান্তে গুন গুন করে গাইতে শুনি—
‘ন সাঙ যেবার এই জাগান ছাড়ি
ইদু আগং মুই জনমান ধরি
এই জাগান রইয়েদে মর মনান জুড়ি…’
[এই জায়গা ছেড়ে আমি যাব না
এখানেই জন্ম-জন্মান্তর থেকে আমি আছি
এই জায়গা আমার মন জুড়ে রয়েছে…]
ভৌগলিকভাবে চাকমারা ভারতের আসাম, মিজোরাম এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বাস করে। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষিত চাকমা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই অধিকাংশের অনেকাংশ এখন জীবিকার তাগিদে চট্টগ্রামের ইপিজেড’র গার্মেন্টস শ্রমিক। চাকমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। প্রাচীন ভারতের তারা সমীহ জাগানিয়া একটা নির্দিষ্ট জাতি হিসেবে পরিচিতি ছিল। তাদের মধ্যে স্বজাতি ও দেশাত্মবোধের প্রতি টান অত্যন্ত প্রকট। যদিও সেই শত শত বৎসর পূর্বে তারা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছিল; বর্তমানে বাংলাদেশকেই তারা নিজের মাতৃভুমি বলেই পরিচয় দেয়। তাদের দেশাত্মবোধ ধরা ওঠে এসেছে গানেও।
‘এই শহর নাঙ্গান রাঙামাত্যা
এই জাগা মে মুই থাং
এই জাগাগান দেগংগে দোল
তারে দো মুইহোস ফাং।’
[এই শহরের নাম রাঙামাটি,
এইখানেতে আমি থাকি
এই জায়গা আমি পছন্দ করি,
এটাকে আমি ভালোবাসি।]
চাকমাদের গীত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে উল্লেখ করতে হবে গায়কদল ‘গেংখুলি’দের কথা। চাকমা সমাজের সঙ্গে তাদের সর্ম্পক অত্যন্ত নিবিড়। বিবাহ, শ্রাদ্ধ বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেংখুলিরা মাত্র্র একটি বেহালা সম্বল করে শ্রোতাদের মধ্যে গানের আসর জমান। মেয়াবী বারোমাস, লক্ষী পালা, রাধামন-ধনপদিসহ প্রভৃতি পালা তারা সুর করে রাত জেগে শ্রোতাদের গেয়ে শুনান। চাকমাদের কাছে আরেকটি চিরস্মরণীয় গীত হলো উদাসী শিবচরণ চাকমা রচিত ‘গোজেন লামা’ বা ‘গোঁসাই পালা’। জনশ্রুতি আছে, উদাসী শিবচরণ চাকমা একজন অলৌকিক শক্তিধর আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। তিনি অদৃশ্য শক্তিবলে নিজ ইচ্ছায় যত্রতত্র যেতে পারতেন। তাঁর লামা বা পালা চাকমা কথ্য ভাষায় রচিত হলেও তার মধ্যে বাংলা ভাষার ‘বিকৃত ছাপ’ রয়েছে দাবি করেন পন্ডিতগণ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গেও এই লামা ভাষার সামঞ্জস্য লক্ষ্যণীয়।
‘তদাৎ বেরেই ধুপ কাপড়
গোজেন চরণত ভজঙর।
আগে ছালাম দ্যং শিবচরণ
মাগং গোজেনর দুই চরণ।
ছেয়ার তলে রাগেদ,
ও কালে তরেদ।
জন্মে জন্মে দেখা ওক্
চিদে মনে একা ওক্।’
(গোজেন লামা-২য় লামা)
[গলায় জড়িয়ে সাদা কাপড়
গোজেনের চরণে ভক্তি জানায়।
আগে সালাম দিচ্ছি শিবচরণকে
চাইতেছি গোজেনের দুই চরণ।
ছায়ার তলে রাখিত,
কালে কালে রক্ষা করিত।
জন্মে জন্মে দেখা হোক
চিত্তে মনে এক হোক।]
লোকসাহিত্য, লোকগান একটি জাতির বড় সম্পদ। তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য পাওয়া যায় এই সম্পদে। বাংলা সাহিত্যে যেমন পুঁথি বা পালা রয়েছে তেমনি চাকমাদেরও রয়েছে পুঁথি ও পালা। বাংলা সাহিত্যে মহুয়া পালা যেমন তেমনি চাকমাদের রাধামন-ধনপুদি। সময়ের সাথে সাথে, ভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব পালার অনেককিছু হারিয়ে গেছে ও পাল্টে গেছে। অবশ্য এখনো যা আছে তার মূল্যও কম নয়। চাকমাদের ‘মেয়াবী বারমাস’ পড়ার পর থেকেই আমি মুগ্ধ হয়ে আছি।
‘চৈত্র মাসেতে মেযা প্রাণ উঠে জ্বলি
অনেক দিন প্রেম করল্লুম মোরে গেলা ছাড়ি।
এমন বয়স কালে মেয় চিতে দিয়া কালি
যৌবন জোয়ারে তুমি কেন দিলে ডালি।
সোনা দিব তোলা ২ রূপা দিব মাপি
এমন সুন্দর মেয়া তুমি মোরে কেনে গেলা ছাড়ি।’
[চিতে- চিত্তে]
সামাজিক মাধ্যমের কারণে বর্তমানে যে কেউ চাইলেই চাকমা গানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠতে পারেন। ইউটিউবে রয়েছে চাকমা গানের বিশাল ভাণ্ডার। বিশেষ করে তাদের ব্যান্ড সঙ্গীত অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সম্প্রতি ইউটিউবের কল্যাণৈ গেংখুলি ব্যান্ডের দুটি গান শোনার সুযোগ হয়েছে। তার একটি ‘কুচপানা কারে কয় (ভালোবাসা কারে কয়)’ অপরটি ‘মনান আগের চান ন লাগে (আগের মতো কিছুই মনে লাগে না)।’ দুটি গানই সুর ও কথায় অত্যন্ত চমৎকার।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১) চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত- বিরাজ মোহন দেওয়ান
২) রাধামন-ধনপুদি