Select Page

‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাণের নেপথ্য গল্প

‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাণের নেপথ্য গল্প

১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। পরিচালক আজিজুর রহমান তখন চট্টগ্রামে। ‘অশিক্ষিত’ ছবির শুটিং করছিলেন। ওদিকে ঢাকা বিমানবন্দরে শুরু হয়ে গেল রাজ্যের নাটকীয়তা। এর মধ্যেই পত্রিকা মারফত আরো নাটকীয় এক ঘটনার খোঁজ পেলেন পরিচালক। ঠিক করে ফেললেন, পরের ছবির কাহিনি হবে সেটাই।

সেদিন ঢাকা বিমানবন্দরে জাপান এয়ারলাইন্সের একটা বিমান ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে জরুরি অবতরণ করে। তাদের সঙ্গে জাপান সরকারের দর কষাকষি চলে টানা কয়েকদিন। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় সারা দেশের। ওদিকে স্ত্রী সন্তান সবাই ঢাকায়। সেখানকার খবর জানতে তাই পত্রিকা আনান আজিজুর রহমান। ‘বাংলার বাণী’। ভেতরের পাতায় দুই কলামে ছাপা একটি খবরে চোখ আটকে যায় আজিজুর রহমানের।

নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলের ঘটনা। ছুটিতে এক ছাত্র বাথরুমে আটকা পড়ে। লম্বা ছুটি। তারপরও কৌশলে মাসখানেক বেঁচে ছিল ছেলেটি। কীভাবে কী করেছিল সব লিখে রাখে দেয়ালে। শেষ পর্যন্ত আর শেষ রক্ষা হয়নি। বাথরুমেই মারা যায়। তখনই ঠিক করে ফেলেন, এটা নিয়ে ছবি বানাবেন। সবাইকে বলেনও। ‘অশিক্ষিত’র প্রযোজক ছিলেন বিখ্যাত সুরকার সত্য সাহা। যদিও তার স্ত্রীর নাম গিয়েছিল। তিনি শুনে বলেন, আগে এটা শেষ করো। পরে দেখা যাবে।

১৯৭৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় ‘অশিক্ষিত’। সুপারহিট। আজিজুর রহমানও কোমর বেঁধে নামেন পরের ছবির জন্য। খুঁজতে শুরু করেন প্রযোজক। জনা দশেকের সঙ্গে আলাপও হয়। কিন্তু কাহিনি শুনে কেউ-ই রাজি হন না। নায়িকা নাই, বাথরুমে এক স্কুলছাত্র মারা গেছে, এই ছবিতে দর্শকরা দেখবে কী!

‘ছুটির ঘণ্টা’র পোস্টার ও পরিচালক আজিজুর রহমান

শেষে সত্য সাহাকেই ধরেন আজিজুর রহমান। ‘অশিক্ষিত’ ৩-৪ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। তার থেকে লাখ সাতেক টাকা বিনিয়োগের আবদার করেন। রাজি হন সত্য সাহা। ছবির নাম দেয়া হয় ‘ছুটির ঘণ্টা’। পত্রিকার খবরের সঙ্গে কল্পনার মিশেলে সিনেমার গল্প দাঁড় করাতে থাকেন আজিজুর রহমান। স্কুলের ঘণ্টাবাদক চরিত্রটিকে বানান নায়ক। তার জন্য পছন্দ করেন রাজ্জাককে। কিন্তু নায়িকা চরিত্র কিছুতেই পাচ্ছিলেন না।

এর মধ্যে একদিন খুব সকালে অফিসে গেছেন। কাকরাইল সিনেমা পাড়ায়। একদম ৯টার দিকে। দরজা খুলে দেখেন এক মহিলা টেবিলের ওপর বসে আয়েশ করে বিড়ি ফুঁকছে। তাকে দেখেই ভয়ে লাফিয়ে নামে। কথা বলে জানলেন, মেয়েটি সুইপারের বউ। স্বামীর জ্বর। তাই সে এসেছে। আজিজুর রহমানের মাথায় ততক্ষণে পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। সত্য সাহাকে ফোন দেন। ‘নায়িকা পেয়ে গেছি। স্কুলের ঝাড়–দারনি।’ সে চরিত্রে নেন তার পছন্দের নায়িকাকে। শাবানা। চরিত্র বোঝাতে তাকে এমনকি নিয়ে যান ধোলাইখালের সুইপার পট্টিতেও!

ছবিতে স্কুলে আটকে পরা ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন সত্য সাহা-রমলা সাহার বড় ছেলে সুমন। তার মায়ের চরিত্রের জন্য পছন্দ করা হয় সুজাতাকে। তিনি তখন সাময়িক অবসরে। ছেলে ফয়সালের বয়স মাত্র তিন বছর। ওর জন্মের পর তখনো ফেরেননি অভিনয়ে। একদিন বাসায় আসেন সত্য সাহা ও রমলা সাহা। গল্পটা পছন্দ হয় সুজাতার। সপরিবারে শুটিং যাওয়ার শর্তে রাজি হন।

চিত্রনাট্য প্রস্তুতের পর শুরু হয় লোকেশন বাছাই। পরিচালক চাচ্ছিলেন ছেলেটির বাসা হবে পাহাড়ের ওপরে। স্কুল থাকবে নিচে। তেমনটা পেয়েও যান। রাঙামাটির কাপ্তাইতে। বাঁধের ওপর রেস্ট হাউজ। নিচে স্কুল। জানালা দিয়ে দেখা যায়। আর ঘরের ভেতরের সেট বানানো হয় এফডিসিতে। সেখানে শুটিং হয় আরো ১৫ দিন। তারপর পোস্ট-প্রোডাকশন। সব কাজ শেষ করে জমা দেয়া হয় সেন্সরে।

কিন্তু সেন্সর বোর্ড আটকে দেয় ছবিটি। এটা দেখে নাকি ছেলেমেয়েরা ভয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে! আজিজুর রহমানও ছেড়ে দেবার লোক নন। বিভিন্ন স্কুল থেকে একদল ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে ছবিটা দেখান। ওরা ভীষণ পছন্দ করে ছবিটি। বলে, ওরা মোটেও ভয় পায়নি। বরং অনেক কিছু শিখেছে। হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে ছাড়পত্র না দেয়ার আর উপায় থাকে না বোর্ডের।

১৯৮০ সালের ২ মে মুক্তি পায় ‘ছুটির ঘণ্টা’। কিন্তু মাত্র ২০টি হলে। তাও তারা যেন দয়া করে চালিয়েছিল ছবিটা। প্রযোজকদের মতো একই কারণে শুরুতে আগ্রহ দেখাননি পরিবেশকরাও। তবে পরের সপ্তাহেই দৃশ্যপট একদম উল্টে যায়। প্রথম সপ্তাহে যে হল ২৫ হাজার টাকা বুকিং মানি দিয়েছিল, পরের সপ্তাহে তারাই দেয় ২ লাখ! কোথাও কোথাও চলে ৫ মাস! সব মিলিয়ে ছবিটি ব্যবসা করে ৩-৪ কোটি টাকার।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাবীল অনুসূর্য

চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক

মন্তব্য করুন