Select Page

ডুব: বিখণ্ডিত আর মৃত্যুর অকাহিনি

ডুব: বিখণ্ডিত আর মৃত্যুর অকাহিনি

ডুব’ আটপৌরে, ছোট, অথচ সুতীব্র এক (বা একাধিক) অতৃপ্ত বাসনাকে সামলেছে। কোনো একটা নগণ্য রচনাতে আমি বলেছিলাম ‘বাসনা’র আগে অতৃপ্ত বিশেষণটা চূড়ান্ত বিচারে অহেতু। বাসনারাজি অতৃপ্ত থাকবার জন্য সংজ্ঞায়িত, নিয়তিপ্রাপ্ত। কিন্তু সেসব আসলে ফ্যালাসি।

একটা অতি সাধারণ, অতি আটপৌরে আকাঙ্ক্ষাও অপূরিত থাকার পর অমোঘ মৃত্যু শাসনভার নিলে অতৃপ্ত ওই লোকটার কেমন লাগে সেটা সম্ভবত গৌণ। লোকটার আর লাগে না। কিন্তু লোকটার কেমন লেগে থেকেছিল এই ভাবনায় এই দৃশ্য ও কাহিনীর ভোক্তাগণ নিবিড় এক শূন্যতায় আচ্ছন্ন হন।

আটপৌরে এই জীবনে, যেখানে সারাক্ষণ অর্থের খোঁজে অভিযাত্রায় থাকি, সেখানে ওই না-পাওয়াটুকু মানুষটিকে না জানি কত ব্যথা দিয়েছিল ভেবে খোদ আমরা ব্যথাতুর হয়ে পড়ি। মানুষটির আর পাবারও সম্ভাবনা নেই যে তাতে আমরা গাঢ় পার্থিব কান্না সামলাতে মনোযোগী হই, যে পার্থিবতা সদ্যমৃত লোকটিকে আর আচ্ছন্ন করবে না। অন্তত এখন পর্যন্ত আমাদের জৈবশাস্ত্রীয় জ্ঞানমতে। সদ্যমৃত লোকটিই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে মৃত্যু অতি সাধারণ, আটপৌরে, একটা ঘটনা মাত্র। একটি হকিকত, যার পর আর বাসনা বিরাজ করে না, কিন্তু মৃত্যুর আগে বিরাজিত-ঘোষিত বাসনারাজি জীবিতকালের সাক্ষীদের উন্মূল করে দেয়।

’ডুব’ একটা হকিকতের কাহিনি। নিরুপায়ত্বের কাহিনি। ক্ষু্দ্র আর সুতীব্র এক বাসনার কাহিনি। কন্যার বান্ধবী বা ‘কন্যাসমা’ এক মেয়ের সঙ্গে “প্রেমযৌনজ” সম্পর্কে জড়ানোর পর জাভেদের উন্মূল আর নিরাশ্রয় হবার কাহিনি। কিন্তু এই জড়ানোও বিশেষ কোনো যুক্তিমালা বা কার্যকারণসম্পন্ন নয়। যেমনটা আমাদের হরহামেশাই ঘটে, তেমনটাই। ঘটে যায়। ‘ডুব’ একজন বাবার সামাজিক-আত্মিক বাবাত্ব থেকে উৎখাত হবার কাহিনি। সন্তান বিশেষত জ্যেষ্ঠা কন্যাসন্তানের কাছ থেকে নতুন দশাতেও ‘বাবা’ ডাক শুনবার আকাঙ্ক্ষার কাহিনি। কিংবা সেসব কথাবার্তার, সম্পর্কের ভাষামালার চর্চার আকাঙ্ক্ষা “পতিত” হবার আগে যা তাঁদের নৈমিত্তিক ছিল। পরিশেষে ‌’ডুব’ মৃত্যুর সারল্য ও নিষ্পত্তিকারী ভূমিকার কাহিনি। এমনকি কাহিনি নয়, ঘোষণাপত্র। মেনিফেস্টো। শূন্যতাবোধ, পূর্ণতাবোধ, অর্থবোধ, নিরর্থকতাবোধ— এসবের চক্রাকার যাত্রাপথে মৃত্যু টুপ করে নিরুত্তাপ সকল অপ্রাপ্তির অবসান ঘটায়। কেবল, যেমনটা বলেছিলাম, সাক্ষীদের কান্না আসে। এত সরল কাহিনিটাকে নিয়ে লক্ষ্য করিনি কেউ সারল্য বজায় রেখেছেন বলবার সময়। সেই পরিস্থিতিটা বেশ চিন্তিত করেছে আমাকে।

‘ব্যাচেলর’-এর ফারুকী আমাকে বিরক্ত করেছিলেন। সেটার কারণ ব্যাখ্যা করা যায়, জরুরি না জেনেও। ঢাকার ভিজুয়্যাল উৎপাদনে ‘হাস্যরস’ উৎপাদনের যে পেশাগত দায়িত্ব পরিচালকেরা বোধ করে এসেছেন বিগত দশকগুলোতে, ফারুকীর প্রচেষ্টাকে সেই কাতারে দেখেছিলাম বলেই হয়তো। আমার বিবেচনাকে চূড়ান্ত মানি না আমি এক্ষেত্রে। কিন্তু ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’ থেকেই ফারুকীর স্টেটমেন্ট আমাকে আটকায়। ‘ডুব’-এ এসে তিনি নতুন মাত্রায় নিজেকে সাজিয়েছেন। বলছিলাম ‘ডুব’ একটা হকিকতের ছবি, এমনকি নিস্পৃহ হকিকতের। এই নিপাট নির্লিপ্ত বাস্তবতা রচনাকারী মৃত্যু। আর বাস্তবতাটি ছোট তথাপি তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে নিষ্পত্তি ঘটিয়ে দেয়। আসলে সকল আকাঙ্ক্ষাকেই।

মৃত্যুর কিংবা আকাঙ্ক্ষা-(অ)নিষ্পত্তির এই নৈর্লিপ্তি তৈরিতে ফারুকীর প্রচেষ্টা আমাকে প্রায় থমকে দিয়েছে। সেটা দৃশ্যরচনার কারণে নয়, দৃশ্যরচনার মেথডলজির কারণে। ভীষণ সাহসী পদ্ধতি নিয়েছেন তিনি। আমি ঠিক তাঁদের দলে থাকতে পারব না যাঁরা বলবেন ‘আমি মেলা ভালো ভালো ছবি দেখেছি’। কিন্তু বাংলা ছায়াছবির অল্প কিছু দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করতে পারি না আর কোনো দৃশ্যনির্মাতা/কাহিনি-বলিয়ে এত টুকরো-টুকরো করে কোনো কিছু বলতে এসেছেন আমাদের। এটা সফল-বিফল বলার লোক আমি নই। কিন্তু এই ফ্যাগমেন্টেড দৃশ্য/গল্প নির্মাতা তরফে নৈর্লিপ্তির মুড আনবার মুখ্য পদ্ধতি বলে আমার মনে হয়েছে। ছবির বাজার ভাবলে অতিসাহসী এক পদক্ষেপ, নজিরবিহীন প্রায় তো বটেই। ফ্র্যাগমেন্টস সম্ভবত তাঁর আরেকটা আগ্রহের জায়গা থেকে এসেছে, হয়তো। মনুষ্য ভাবনাপ্রণালীতে গাঢ়-বিষাদকর জায়গাগুলো টুকরো টুকরো পাথরের মতো থাকে, নিতান্ত মামুলি হয়ে। মৃত্যুকে অসীম অমোঘ অথচ মামুলি অর্থ দেবার জন্য এই ফ্র্যাগমেন্টস দুর্দান্ত সহায়ক ছিল। আমি অন্তত এই টুকরো ভার বহন করে বের হয়েছি। কিন্তু শব্দের ব্যবহারে সেটাকে পরিপূরক অর্থ দিয়েছেন নির্মাতা। প্রায় সকল আউটডোরেই অবিরাম বাতাস ছিল, দৃশ্যতে তা ঘাস বা পাতা আশ্রয় করেছে। আর ছিল বাতাসের শব্দ। আমার বিচারে দৃশ্য/ঘটনার ফ্র্যাগমেন্টস আর বাতাসের কন্টিউনিটি সারা ছবিতে বিষাদের কাঠামোটি দাঁড় করিয়েছে। এটা সুচিন্তিত না হবার কথা নয়।

ক্র্যাফটের ভালো বিচারক যাঁরা তাঁরা নম্বর দেবেন। কিন্তু আমি করুণ রস (খুবই প্রচলিত শব্দ যদিও) উপভোগ করেছি। আর এই ক্র্যাফটে মামুলি মৃত্যুর অতৃপ্ত বাসনার উপর পর্দা টাঙিয়ে দেয়ার নিতান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিটা দেখে ছবি দেখা শেষ করেছি। আমার তাই ছবির গতি দারুণ মানানসই লেগেছে, নৈর্লিপ্তির সাথে, ফ্র্যাগমেন্টস/টুকরোপ্রবাহের সাথে, মামুলি মৃত্যুর সাথে।

ইরফানের বাংলা উচ্চারণ আমাকে ভোগায়নি। কিছু আসে যায় না এত লোকে এতভাবে বাংলা বলেন। এই মৃত্যু প্রকল্পে তো আরও গৌণ। বরং, মায়া বা সাবেরির বাংলা বলাতে মনে পড়েছে, ফারুকীর দেহে প্রাণ থাকতে তিনি যাকে প্রমিত বাংলা বলে ভাবেন তা তাঁর চরিত্ররা মুখে আনবেন না। বিষাদভার-প্রবাহের মধ্যে অল্প কিছুক্ষণ ফারুকীর একরোখামি মনে করে কৌতুকবোধও করেছি। কিন্তু সেটাও গৌণ। একাধিক চরিত্রের তেমন কোনো সংলাপ নেই তাও খুব ঠিকঠাক এই পরিবেশে।

একটা প্রায়-কিছু-না-বলতে-চাওয়া নিস্পৃহ ছায়াছবিতে সকলের অভিনয় গড়ে নির্মাতার ‘স্টাইল’কে দুর্দান্তভাবে বহন করেছে। প্রাচী (মায়া) বলিষ্ঠ-গম্ভীর-কর্তব্য/অধিকার সচেতন হিসেবে দারুণ। ইরফান (জাভেদ) বিহ্বলতা-নিরর্থকতা-অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতার (হকিকত) মুখোমুখি হিসেবে দ্রবীভূত (দৃশ্যে)। তিশা (সাবেরি) কন্যার অধিকারবোধ, মর‌্যালিটির সামাজিক চাপ, আর ম্যাজিক্যাল পিতার স্নেহলোভী হিসেবে স্পষ্ট। সম্ভবত বাবার কাফনে কান্নার দৃশ্যটুকু ছাড়া তাঁকে অনবদ্য বলা যায়। পার্নো (নিতু) অ্যাডভাঞ্চারাস, সঙ্গপ্রিয়, নন-কনফর্মিস্ট হিসেবে মনোযোগ কাড়ার মতো। নাদের (জাভেদের ভাই) সামান্য উপস্থিতিতে নাজুক মৃত্যুকাতর কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে মায়াকাড়া।

ফারুকী সব চরিত্রের প্রতি নির্মাতার মমত্ব বা দায়িত্ববোধ রেখেছেন। আমার বিবেচনায় নিতুই কেবল কখনো কখনো সমাজের মর‍্যালিটির এসিড টেস্টে পড়েছেন। যেসব লজিকই ফারুকীর থাকুক না কেন, নিতুকে আরো কোমলতা দিলে (যাকে লোকে বলে হিউম্যান করলে) জাভেদের বিহ্বলতা বা মৃত্যুর মামুলিত্ব এই প্রজেক্টে বিঘ্নিত হতো না। নিতুর প্রতি ফারুকী কখনো কখনো সমাজের চশমা দিয়ে তাকিয়ে থেকে থাকতে পারেন।

ছবিটাকে নিয়ে নিন্দা করা শক্ত। এটা প্রায় না বলতে চাওয়া কথার মতো একটা ছবি। নিস্পৃহ, নির্লিপ্ত, এমনকি অনীহ ভঙ্গিতে গল্প করার মতো। টুকরো টুকরো কথা, টুকরো টুকরো ছবি, যেন কোনো স্টেটমেন্ট নেই নির্মাতার। এই যে নির্মাতার যেন কোনো স্টেটমেন্ট/বলার মতো গল্প/প্রচার করার মতো ‘বার্তা’ বা ‘দর্শন’ নেই সেটা একটা প্রবণতা হিসেবে খুব সচরাচর ঘটে না। ছবির শৈলী/ক্র্যাফট/দৃশ্যমালা/সংলাপ সেই ‘না চাওয়াকে’ যেন রচনা করেছে। নির্লিপ্তির শৈলী। সেজন্য ছবিটা নতুন কিসিমের।

জানলাম, আতিক (নুরুল আলম আতিক) কোথায় যেন বলেছেন এত সরল করে বলেছেন ফারুকী। হুম! ভীষণ সরল, ডাউন-টু-আর্থ করে একটা না-গল্প বলেছে ফারুকী। একটা অকাহিনি। মর‍্যাল শাসনে ‘বাস্তুচ্যুত’ একটা মানুষের নিতান্ত মামুলি মৃত্যুগাথা।

আদাবর।। ৩১ অক্টোবর ২০১৭।। ফেসবুক স্ট্যাটাস প্রথমে।। পরে প্রকাশ: ফিল্মস্ট্রিট ম্যাগাজিন, বইমেলা সংখ্যা, ২০২০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন